শুক্রবার ২ মে, ২০২৫


মা সারদা।

ঠাকুরের মহিলা ভক্তদের মধ্যে প্রথম শিষ্যা ছিলেন যেমন গৌরীমা, তেমনই শ্রীমার প্রথম শিষ্যা হলেন দুর্গাপুরী। শ্রীমার কাছে বাল্যকাল থেকেই তাঁর অবাধ যাতায়াত। শ্রীমা স্বেচ্ছায় তাঁকে বাল্যবয়সেই দীক্ষা দেন। চোদ্দ পনেরো বছর বয়সেই একান্তভাবে তাঁর আগ্রহে তিনি দুর্গাদেবীকে সন্ন্যাসদীক্ষা দেন। দুর্গাদেবী ছিলেন গৌরীমার পালিত কন্যা। তিনি আবাল্য সন্ন্যাসিনী ছিলেন। সারদেশ্বরী আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা গৌরীমা ছিলেন প্রথম অধ্যক্ষা। আর পরে মাতাজি দুর্গাপুরী হয়েছিলেন আশ্রমের দ্বিতীয় অধ্যক্ষা। অতি শৈশবেই তাঁর লেখাপড়া শুরু হয়। গৌরীমাই তাঁকে লালন পালন করেন। দুর্গাদেবী তাঁর পাঁচবছর বয়স পর্যন্ত অন্নগ্রহণ করেননি। দুধ আর ফল খেয়েই ছিলেন। যখন তিনি পাঁচবছরে পড়লেন সেই সময় গৌরীমা তাঁর বিয়ের কথা পাড়লেন।
দুর্গাদেবীর মা তখন বেঁচে নেই। দিদিমা জানালেন যে, মেয়ের বাবার অনুমতি আগে দরকার। তাই গৌরীমা গেলেন মেয়ের বাবার কাছে। তবে প্রথমে পাত্রের নাম শুনে মেয়ের বাবা ও ঠাকুমা রাজি হলেন না তাঁদের মতে এই বিয়ে অসম্ভব। তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্মণ পরিবার। গৌরীমার সঙ্গে অনেক শাস্ত্রীয় তর্কের পরে তাঁরা রাজি হলেন। ঠিক হল যে, মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা পাত্রের দেশে যাবেন। পাত্রীর বাবা আর দিদিমার সঙ্গে গৌরীমা ও তাঁর কিছু শিষ্য শিষ্যা যাবেন। যাবার আগে মা সারদা মেয়েকে দিলেন যৌতুক। হাতের সোনার চুড়, বেনারসি শাড়ি, আর পাত্রের জন্য দিলেন ধুতিচাদর ও আরও কিছু জিনিস এবং দিলেন তাঁর আশীর্বাদ। শ্রীমার পায়ের ধুলো নিয়ে সকলে যাত্রা করলেন শ্রীক্ষেত্রে। সেখানে গিয়ে আবার পুরীর পাণ্ডা ও পুরোহিতদের সঙ্গে আলোচনার সময় তাঁরাও এই বিয়ের প্রস্তাব প্রথমেই নাকচ করে দেন। এরপর আবার পণ্ডিতদের সঙ্গে গৌরীমার শাস্ত্রীয় তর্ক হওয়ার পর সকলে গৌরীমার কাছে শাস্ত্রযুদ্ধে হেরে যান।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৫: ঠাকুর বলতেন—‘যে সয় সে রয়’

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৪৮: রান্নার জ্বালানি নারী স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ?

এ বার পুরোহিতেরা জানালেন যে, যদি প্রভু জগন্নাথের ‘আজ্ঞামালা’ পাওয়া যায়, তাহলে তাদের এই বিয়েতে কোনও আপত্তি থাকবে না। তারপরে তারা প্রভু জগন্নাথের গলায় একটি ফুলের মালা পরিয়ে দিলেন। বারোজন পাণ্ডা মাটিতে শুয়ে ধর্নাও দিল। তারা সেই অবস্থাতেই প্রভুর আজ্ঞার অপেক্ষায় রইল। দেখা গেল যে, প্রভুর মালাটি আপনাআপনি খুলে পড়ে গেল। অসংখ্য দর্শনার্থী আনন্দে জয়ধ্বনি দিতে লাগল। এবার পাণ্ডারা আর এই বিয়েতে আপত্তি করল না। তারা রায় দিল যে, ‘এ মেয়ে লক্ষ্মীর অংশ’। বিবাহ স্থির হওয়ার পর কিন্তু আপত্তি জানালেন উড়িষ্যার রাজা। তিনি বললেন যে, এই বিয়ে হলে রাজ্যের অমঙ্গল হবে। তবে যদি প্রভু জগন্নাথ তাঁকে ‘আজ্ঞামালা’ দেন, তবে প্রভুর ইচ্ছা জেনে তিনি আপত্তি করবেন না। তখন রাজার পক্ষ থেকে সুন্দর একটি মালা আবার প্রভুর গলায় পরানো হয়। তবে এবার দেখা গেল যে, আরও শীঘ্র জগবন্ধুর গলার মালাটি খুলে পড়ে গেল। অগণিত কণ্ঠে আবার উল্লাসধ্বনি উঠল। আর কোন পক্ষেরই আপত্তি রইল না।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৭: পাতি সরালি

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১১০: বনবাসী রামের নিরাসক্ত ভাবমূর্তির অন্তরালে, ভাবি রামরাজ্যের স্রষ্টা দক্ষ প্রশাসক রাম

মন্দিরেই বিবাহসভা প্রস্তুত হল। এখন বলা যাক, পাত্রী দুর্গাপুরীদেবীর পাত্র কে ছিলেন? শ্রীমার মন্ত্রশিষ্যা কুমারী দুর্গাদেবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাত্র ছিলেন স্বয়ং জগন্নাথদেব। পাঁচবছরের সেই ছোট মেয়েটির রীতিমতো হিন্দুশাস্ত্রমতে যজ্ঞানুষ্ঠান করে বিয়ে শুরু হল। একদল পুরোহিত পাত্রপক্ষের হয়ে পৌরোহিত্য করলেন আর গোবিন্দশৃঙ্গারী প্রমুখ কন্যাপক্ষের হয়ে বিবাহ কার্য সম্পন্ন করেন। সবশেষে মালাবদলের সময় মেয়েকে কোলে করে পুরোহিতরা জগন্নাথদেবের বাঁদিকে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তারপর তারা মালাবদলের পর্ব সমাধা করে বিবাহ শেষ করলেন।
আরও পড়ুন:

আকাশ এখনও মেঘলা/১৪

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৫: সর্বত্র বরফ, কোত্থাও কেউ নেই, একেবারে গা ছমছম করা পরিবেশ

পাত্র এবং পাত্রী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। অগণিত মানুষ বিনা আমন্ত্রণেই এই বিয়েতে দর্শনার্থী হয়েছিলেন। তাদের উল্লাসে মন্দিরপ্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে উঠেছিল। কন্যাপক্ষ থেকে সকলকে মহাপ্রসাদ বিতরণ করা হয়। জখন্নাথদঃবের অভিভাবক উড়িষ্যার রাজা, রানিদেরও মহাপ্রসাদ পাঠানো হয়। এরপর রাজা নববধূকে আশীর্বাদ করার জন্য রাজপ্রাসাদে নিমন্ত্রণ করেন। তবে গৌরীমা এই বিয়ের প্রীতিভোজের আয়োজন করেছিলেন বৃন্দাবনধামে। বৃন্দাবনের গোবিন্দজীর মন্দিরে বিরাট ভোগের আয়োজন করা হয়। এক মন দুধের পায়েস আর প্রচুর মিষ্টান্ন ও নানা সুখাদ্য তৈরি করে গৌরীমা সেদিন গোবিন্দজীকে ভোগ দেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৭: পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যাঁর জীবনের আকাশে কখনও শত্রুতার মেঘ জমেনি

এরপর বহু সাধু, সন্ন্যাসীকে প্রীতিভোজে নিয়মানুসারে পায়েস পরিবেশন করা হয়। সেদিন দুর্গাদেবীও তাঁর ছোট হাতে পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠান শেষে গৌরীমা নতুন বৌকে নিয়ে শ্রীমার বাড়িতে এসে উঠেছিলেন। মেয়েকে ঘিরে মহিলারা বলতে লাগল, ‘কি দেখেছিস বল?’ শিশুর মতো সরল ছোট মেয়েটি শুধু বলতে পেরেছিল, ‘আমি যখন জগন্নাথদেবের বাঁ পাশে দাঁড়িয়েছিলুম, আমার হাতটা তাঁর ভুঁড়িতে লেগেছিল, কি তুলতুলে’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content