
মা সারাদা।
বড়দিনের ছুটিতে মা সারদার কাছে থাকবেন বলে সুধীরাদি সরলাবালাদের নিয়ে কাশী যান। শ্রীমা তখন কাশীতে রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি যোগেনমা আসতে পারল না বলে আক্ষেপ করতে লাগলেন। যোগেনমার অসুখ হয়েছিল, তাই সরলাদেবীর বড় ভাবনা হয়েছিল। সুধীরাদি কিছুক্ষণ কথা বলে যে ভাড়াবাড়ি তাদের থাকার জন্য ঠিক করা হয়েছে, তা দেখতে গেলেন। শ্রীমা এরমধ্যে একটু ঘুমিয়ে পড়েছেন। বাড়ি প্রায় নিস্তব্ধ। সকলে বিশ্রাম করছেন। এমন সময় বারান্দা থেকে গান শোনা গেল…’আমার মা কোথায় গেলে?
অনেকদিন দেখি নাই মা,
নে মা আমায় কোলে।
তুই গো কেমন জননী,
সন্তানে হও এত পাষাণী।
নে মা আমায় কোলে।
তুই গো কেমন জননী,
সন্তানে হও এত পাষাণী।
দেখা দে মা, আর কাঁদাস নে তনয়া বলে।‘ গানটা এত মৃদুস্বরে ভেসে আসছিল যে সরলাদেবীর মনে হল, কে যেন খুব দূরে কাঁদছে। শ্রীমা হঠাৎ উঠে বললেন, ‘কে গান গাচ্ছে? চল তো মা বারান্দায় গিয়ে দেখি’। দেখতে গিয়ে চমকে উঠলেন সরলাবালা। একটি মেয়ে গানটি গাইছে আর তার চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে। শ্রীমা সেখানে বসতেই মেয়েটি তাঁকে প্রণাম করে বলল যে, তার অনেকদিনের আশা পূর্ণ হল। ‘আজ আমার কি আনন্দ হচ্ছে বলতে পারছি না, মা’।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯২: শ্রীমার সঙ্গে এক মেমসাহেবের কথোপকথন

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৮: গার্হস্থ্যজীবনে জ্যেষ্ঠ রামচন্দ্রের ভাবমূর্তি, তাঁর দেববিগ্রহে উত্তরণের একটি অন্যতম কারণ?
শ্রীমা তাকে আশীর্বাদ করে পরিচয় জানতে চাইলেন। সে বলল, ‘আমি আপনার ভিখারিণী মেয়ে, মা’। শ্রীমা বললেন যে, সে কোথায় থাকে। সে জানাল, অন্নপূর্ণার দরজায়, নয়তো দশাশ্বমেধঘাটে বেহারীবাবার মন্দিরের কাছে বসে থাকে। শ্রীমা বললেন, ‘ভিক্ষেতে তোমার বেশ চলে তো?’ মেয়েটি বলল, ‘আপনার আশীর্বাদে বেশ চলে যায়। এসবের জন্য কোনও ভাবনা নেই। অন্নপূর্ণার দয়ায় এখানে কেউ তো উপোস করে থাকে না, মা। কিসে একটু ভক্তি হয় তাই ভাবি, মা’।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-২৪: তিন্দুক-জাতক: সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৫: ঝোপ টিকরা
শ্রীমা শুনে বলেন, ‘তা হবে বইকি, মা, তুমি এমন স্থানে রয়েছ। এখানে বাবা বিশ্বনাথ, মা অন্নপূর্ণা সাক্ষাৎ বিরাজ করছেন। তাঁদের কৃপায় সব হয়ে যাবে’। তিনি মেয়েটিকে একটা গান গাইতে বললেন। সে গাইল…
মা, আমারে দয়া করে
শিশুর মতো করে রাখ,
শৈশবের সৌন্দর্য ছেড়ে
বড় হতে দিও নাকো।
সুন্দর সরল প্রাণ,
মান অপমান নাহি জ্ঞান,
হিংসা নিন্দা লজ্জা ঘৃণা,
কিছুই সে জানে নাকো’।
শিশুর মতো করে রাখ,
শৈশবের সৌন্দর্য ছেড়ে
বড় হতে দিও নাকো।
সুন্দর সরল প্রাণ,
মান অপমান নাহি জ্ঞান,
হিংসা নিন্দা লজ্জা ঘৃণা,
কিছুই সে জানে নাকো’।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৪৭: চায়ের দেশের বিনি-মিনির কথা

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫৫: রবীন্দ্রনাথ, মণিপুরী নৃত্য ও ত্রিপুরা
গান শুনে শ্রীমা বলেন যে, আহা! কি চমৎকার গান। মেয়েটি বলল, ‘অনেকদিন ধরে আপনাকে দেখবার বড় সাধ ছিল। আপনি এখানে আছেন শুনে আসব ভাবি, কিন্তু ভয় করে পাছে কেউ কিছু বলে’। শ্রীমা বললেন, ‘কেউ কিছু বলবে না, যখন ইচ্ছা এসো’। তিনি মেয়েটিকে প্রসাদ দিতে বললেন। সে যখন ফিরে যাচ্ছে, তখন তিনি তাকে বললেন, ‘আবার এসো মা’।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১০: অন্ধকারে, চুপিসারে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’
পরে শ্রীমা সরলাদের বলেন যে, মেয়েটির বেশ ভক্তি আছে। কাশীতে সরলাদেবীরা রোজ দুবেলাই শ্রীমার কাছে যেতেন। একদিন তারা বিকেলে গিয়ে জানতে পারল যে, শ্রীমা অদ্বৈত আশ্রমে ভাগবত পাঠ শুনতে যাচ্ছেন। তাদের দেখে শ্রীমা বলেন, ‘আমরা মঠে ভাগবত শুনতে যাচ্ছি, কে একজন কথক পাঠ করবেন। তোমরা যাবে? চল না’। সরলাদেবীরাও তাঁর সঙ্গে গেলেন। ঘণ্টা দুই পাঠ হল। পাঠ শেষে মা সারদা একটি টাকা দিয়ে প্রণাম করে এসে কথাপ্রসঙ্গে বললেন, ‘আহা, কি চমৎকার পাঠ। কথকটি বেশ বলেছেন’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।