বুধবার ২ এপ্রিল, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

মা সারদা তাঁর ইহজীবনের শেষের দিকে প্রায়ই অসুস্থ হতেন। তবে তাঁর ঠাকুরের মতোই শরীরের অসুস্থতা মনের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ঠাকুরের স্নেহধন্য ভক্ত বলরাম বসুর পুত্র রামকৃষ্ণ বসু তাঁর দেহত্যাগের দু’চারদিন আগে একটি উইল করে যান। তখন শ্রীমা অসুস্থ হয়ে উদ্বোধনে ছিলেন। ওই উইল তৈরির পরদিন বিকেলেই শ্রীমার সেবিকা সরলাদেবী তাঁর কাছে উইলের কথা জানিয়ে বলেন যে, রামবাবু তাঁর উইলে ঠাকুরসেবা আর সাধুসেবার জন্য প্রচুর টাকার ব্যবস্থা করেছেন।
একথা শুনে শ্রীমা স্বামী সারদেশানন্দের মুখের দিকে চেয়ে বলেন, ‘গরীবদুঃখীর জন্য কিছু করলে?’ রামবাবুর উইলে গরীবদুঃখীদের সেবার জন্য রামকৃষ্ণ মিশনকে অর্থসাহায্যের উল্লেখ আছে, তা সারদেশানন্দের জানা ছিল না। তবে গরীবদুঃখীদের প্রতি শ্রীমার দরদ দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে তাঁর পানে চেয়ে রইলেন। এর মধ্যে একবার শ্রীমা তাঁর অসুস্থতার সময় কলকাতা যেতে চাননি বলে “মায়ের দ্বারী” শরৎ মহারাজ নিজে জয়রামবাটি এসে মাসাধিককাল থেকে উদ্বোধনে ফিরে যাওয়ার জন্য দিন স্থির করেন। সেইমতো সেদিন সকালে তিনি শ্রীমাকে প্রণাম করে ও তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে বাকি সকলের সঙ্গে হেঁটে কামারপুকুর গেলেন। সেখান থেকে পরের দিন যোগেনমা ও গোলাপমা গরুরগাড়িতে কোয়ালপাড়া আশ্রমে যাবেন আর শরৎ মহারাজ পালকি করে বদনগঞ্জ হাইস্কুল পরিদর্শনে যাবেন। দুপুরবেলায় মহারাজ শ্যামবাজারে ভক্ত হেডমাস্টার প্রবোধবাবুর বাড়িতে আহার সেরে সন্ধ্যায় কোয়ালপাড়া যাবেন। অতিশয় ভক্তিমান প্রবোধবাবু মহারাজের জন্য অনেক খুঁজে এক বিশাল সেকেলে পালকি ও আটজন জোয়ান বেহারার ব্যবস্থা করেছেন। স্কুল পরিদর্শন করে খেতে অবেলা হয়ে গেল।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯o: মা সারদার কথায় ‘ঈশ্বর হলেন বালকস্বভাব’

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৪: মনের ইচ্ছে থাকলেই কার্যসিদ্ধি সম্ভব

শরৎ মহারাজ শ্রীমায়ের স্বভাবপ্রাপ্ত মাতৃভক্ত। তিনি নিজের সুবিধার জন্য অপরকে উদ্ব্যস্ত করতে চান না। শ্যামবাজারে ভক্তদের অধিক আগ্রহে আর উৎসাহে তাঁর সেবার জন্য নানা আয়োজনে দেরি হয়েছিল। তাদের চিন্তিত দেখে মহারাজ তাদের আশ্বস্ত করেন যে, তাড়া করার দরকার নেই। মহারাজের সঙ্গীদের পছন্দ না হলেও তারা তাঁর জন্য কিছু বলতে পারলেন না। দেরি হলেও সকলে আনন্দ করে খেলেন ও বিশ্রাম নিলেন। বিশ্রামের পর দেখা গেল যে কোয়ালপাড়া ফিরতে রাত বেশি হয়ে যাবে। তাই ঠিক হল, রাতে মহারাজ জয়রামবাটি এসে থেকে পরদিন ভোরবেলায় কোয়ালপাড়া যাবেন। সন্ধ্যায় গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে তিনি পালকি থেকে নামলেন। মহারাজ শ্রীমা ও ঠাকুরের জন্মস্থানে খালি পায়ে যাতায়াত করেন। জুতো হাতে নিয়ে তিনি যখন শ্রীমার বাড়ি পৌঁছলেন, তখন রাত হয়েছে। এর আগেই স্বামী ভূমানন্দ এখানে এসে তাঁদের রাত্রিবাসের কথা জানিয়ে বলেন যে, আহারাদির প্রয়োজন নেই।
আরও পড়ুন:

উপন্যাস: আকাশ এখনও মেঘলা, পর্ব-৯: আকাশ এখনও মেঘলা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৭: সুভদ্রাপুত্র অভিমন্যু ও দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্র, কে বা কারা রইলেন পাদপ্রদীপের আলোয়?

মহারাজ আবার আসায় সকলে খুব খুশি। কিন্তু তাঁর বিছানাদি কোয়ালপাড়ায় চলে গিয়েছিল। শ্রীমা নিজের ঘর থেকে বিছানা দিয়ে ভাল করে বিছানা করে দিতে বললেন। মহারাজ শ্রীমাকে প্রণাম করে বললেন যে, অবেলায় খাওয়া হয়েছে, রাতে কিছু খাওয়ার দরকার নেই। শ্রীমা শুনে একটু মিষ্টি মুখে দিয়ে জল খেতে বলেন। একেবারে খালি পেটে ছেলেরা রাতে শোবে, এটা শ্রীমার সহ্য হবে না। মা সারদার কথায় সকলে মিষ্টিমুখ করে বৈঠকখানায় গল্প করতে লাগল। পালকি বেহারাদের রাতে থাকার জন্য প্রসন্নমামার বৈঠকখানায় ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর তাদের জলখাবারের জন্য আগেই ভূমানন্দ মহারাজ এক টাকা দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৩: সাত-সহেলি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৭: লুকাবো বলি, লুকাবো কোথায়?

শ্রীমা যখন বেহারাদেরও খাবার ব্যবস্থা করতে বলেন, তাঁকে জানানো হয় যে, সেসব হয়ে গিয়েছে। সকলের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে জেনে শ্রীমা খুশি হয়ে শুলেন। আর সবাই শরৎ মহারাজের সঙ্গে বদনগঞ্জ স্কুলপরিদর্শন ও প্রবোধবাবুর বাড়ির সাদর অভ্যর্থনা নিয়ে গল্প শুনতে লাগলেন। হঠাৎ শ্রীমার ঘরের দিকের সদরদরজায় আওয়াজ শোনা গেল, ‘ওগো, তোমরা সব শুয়ে পড়লে, আমাদের জলখাবার দিলে না?’ ভূমানন্দজী সামনের দরজা খুলে বাইরে গিয়ে তাকে চুপ করতে বলেন। শ্রীমা সারদেশানন্দকে বেহারাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন। তিনি তাড়াতাড়ি বৈঠকখানার পিছনের দরজা দিয়ে ছুটে ভাঁড়ারে গিয়ে এক হাতে মুড়ির টিন ও অন্য হাতে গুড়ের পাত্র নিয়ে এলেন। সেই লোকটির কাপড়ে যথেষ্ট মুড়ি আর গুড় দিলেন। তারপর ভূমানন্দজী তাদের নিয়ে প্রসন্নের বৈঠকখানায় গেলেন।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৮: সকালবেলাই হাঁটতে হবে?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৭০: বিচারক

এদিকে এই আওয়াজে শ্রীমার নিদ্রার আবেশ কেটে গিয়েছিল। তিনি সারদেশানন্দকে বললেন, ‘বাবা, বেহারাদের জলখাবার দেওয়া হয়নি?’ সারদেশানন্দ জানালেন যে, দেওয়া হয়েছে। তখন শ্রীমা খুশি হয়ে পাশ ফিরে শুলেন। এদিকে ভূমানন্দ মহারাজ বেহারাদের উপর রাগ করে বললেন যে, আগেই তাদের টাকা দেওয়া হলেও তারা কেন শ্রীমার ঘুম ভাঙালো। তখন কাতর হয়ে বেহারাদের সর্দার জানালো যে, পাড়ার লোকেরাই বারবার বললে, মায়ের বাড়িতে এসে কিনা রাতে মুড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছ? যাও, দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেই পেটভরা মুড়িগুড় পাবে। পরে একথা শুনে শরৎ মহারাজ খুব কৌতুক বোধ করে হেসে বললেন, ‘মায়ের বাড়ির মুড়িগুড় তো ওদের পাওনা, ওরা ঠিকই আদায় করেছে। যাঁরা বেশি সাবধান হয়ে টাকা আগাম দিয়েছিল তাঁরাই তো ঠকেছেন’। এমন অপরিচিত বেহারাদের প্রতিও শ্রীমার ছিল অসীম স্নেহ।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content