
মা সারদা।
উদ্বোধনে একদিন সকালে পুজোর ঘরে স্বামী অরূপানন্দ মা সারদাকে বললেন, ‘মা, যদি ঈশ্বর বলে কেউ থাকেন তাহলে এই জগতে এতো দুঃখকষ্ট কেন? তিনি কি দেখছেন না? তাঁর কি এসব দূর করবার শক্তি নেই?’ তখন শ্রীমা বললেন, ‘সমস্ত সৃষ্টিই সুখদুঃখময়। দুঃখ না থাকলে সুখ কি বোঝা যায়? আর সকলের সুখ হওয়া কি করে সম্ভব? সীতা বলেছিলেন রামকে, “তুমি সকলের দুঃখকষ্ট দূর করে দাও না কেন? রাজ্যে যত প্রজা আছে সকলকে সুখে রাখ। তুমি তো ইচ্ছা করলেই পার। তখন রাম বলেন যে, সকলের সুখ একসঙ্গে কি হয়? সীতা বললেন, না, তুমি ইচ্ছা করলেই হয়, যার যা অভাব হয়, রাজভাণ্ডার থেকে দিয়ে দাও। রাম বলেন, আচ্ছা, তোমার কথামতই হবে। তিনি লক্ষ্মণকে ডেকে বললেন, যাও, রাজ্যের মধ্যে সকলকে জানাও, যার যা অভাব থাকে চাইলেই রাজকোষ হতে পাবে”।
সবাই এই খবর শুনে এসে দুঃখ জানালে। রাজকোষ অবারিত, সকলে বেশ সুখে দিন কাটাতে লাগল। রামের এমনি মায়া যে শীঘ্র যে দালানে রাম, সীতা থাকতেন, তার ছাদ ফেটে জল পড়তে আরম্ভ করল। মেরামতির চেষ্টায় লোকজন ডাকতে পাঠালেন। কিন্তু কোথায় লোকজন? কুলি, মজুর কি আর আছে? রাজ্যে কুলি, মজুরের অভাবে প্রজাদের ঘরের দুয়ার কাজকর্ম সব নষ্ট হতে চলেছে, একথা প্রজারাই জানালো। তখন নিরুপায় হয়ে সীতা রামকে বললেন, “আর ভিজে ভিজে কষ্ট সহ্য হয় না। যেমনটি ছিল, তুমি তেমনটি করে দাও। তাহলে মজুর পাওয়া যাবে। সকলের একসঙ্গে সুখ হওয়া সম্ভব নয়। রাম বললেন, তাই হোক”। তখন দেখতে দেখতে সব আগের মতো হল। মজুর, মিস্ত্রী সব পাওয়া গেল। সীতা বলেন, “ঠাকুর, এ সৃষ্টি তোমারই খেলা। চিরদিন কেউ সুখী থাকবে না, সব জন্ম কারও দুঃখে যাবে না। যেমন কর্ম, তেমন ফল, তেমন যোগাযোগ।”
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮৮: মা সারদার কাছে ভক্তের ঠাকুরের কথাশ্রবণ

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৮: এখানে দিন-রাত-শীত-গ্রীষ্ম-আলো-অন্ধকার, সব কিছুরই হিসেব আলাদা
অরূপানন্দ সব শুনছিলেন, তিনি বলেন যে, সবই কর্ম থেকে হয়? শ্রীমা বলেন যে, কর্ম না তো কি? ‘দেখছো না, এই যে মেথর বিষ্ঠার ভার বইছে? অরূপানন্দ বলেন যে, ভালমন্দ কাজের প্রবৃত্তি কোথা থেকে আসে? এ জন্মে বলবে তার পূর্বজন্ম থেকে, সে জন্মে বলবে আবার তার আগের জন্ম থেকে, আদি কোথায়? শ্রীমা বললেন, ‘ঈশ্বরেচ্ছা ছাড়া কিছুই হবার সাধ্য নেই, তৃণটিও নড়ে না। যখন জীবের সুসময় আসে, তখন ধ্যানচিন্তা আসে। কুসময়ে কুপ্রবৃত্তি কুযোগাযোগ হয়। তাঁর যেমন ইচ্ছা তেমনি কালে সব আসে। তিনিই তার ভিতর দিয়ে কাজ করেন। নরেনের কি সাধ্য? তিনি তার ভেতর দিয়ে সব করলেন বলে তো নরেন সব করতে পেরেছিল? ঠাকুর যেটি করবেন তাঁর সব ঠিক করা আছে। তবে ঠিক ঠিক যদি কেউ ওঁর উপর ভার দেয়, উনি তা ঠিক করে দেবেন। সব সয়ে যেতে হয়। কারণ কর্মানুসারে সব যোগাযোগ হয়’।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১৯: আপনামাঝে শক্তি ধরো নিজেরে করো জয়

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৪: প্রকৃতির সান্নিধ্যে কি গ্লানিমুক্তি সম্ভব? লক্ষ্মণের আবেগ কি সাধারণের মধ্যে সহজলভ্য?
অরূপানন্দ বলেন যে, কর্মের দ্বারা কি কর্মের খণ্ডন হয়? শ্রীমা বলেন, ‘তা হবে না? তুমি একটি সৎকাজ করলে তাতে তোমার পাপটুকু কেটে গেল। ধ্যান, জপ, ঈশ্বর চিন্তায় পাপ কাটে। যখন ঠাকুর চলে গেলেন, একা, একা বসে ভাবতুম, তখন কামারপুকুরে রয়েছি, ছেলে নেই, কিছু নেই, কি হবে? একদিন ঠাকুর দেখা দিয়ে বললেন, “ভাবছো কেন? তুমি একটি ছেলে চাচ্ছ, আমি তোমাকে এই সব রত্ন ছেলে দিয়ে গেলুম। কালে কত লোকে তোমাকে মা, মা বলে ডাকবে”।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯o: ছাতারে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৮: দুর্গম গিরি কান্তার ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’
বৃন্দাবনে যাওয়ার সময় তাঁর ইষ্টকবচটি হাতে ছিল। আমি পুজো করতুম। তারপর উটি মঠে দিলুম। এখন মঠে পুজো হয়। ঠাকুর বলেছিলেন যে, কবচটি সঙ্গে রয়েছে, যেন না হারায়’। অরূপানন্দ শুনে বললেন যে, ওই কবচটি এবার ঠাকুরের তিথিপুজোর দিন হারিয়েছিল। ফুল, বেলপাতার সঙ্গে গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়। কারও খেয়াল ছিল না। ভাটায় গঙ্গার জল কমে গেলে রামবাবুর ছেলে ঋষি ওখানে খেলতে গিয়ে দেখতে পেয়ে কুড়িয়ে নিয়ে আসে। মা সারদা বললেন, ‘এটা তাঁর ইষ্টকবচ, সাবধানে রাখতে হয়’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।