মা সারদা।
জাগতিক ব্যবহারে মা সারদা কারও মনে যাতে আঘাত না লাগে, তাই সকলের মন বুঝে চলতেন। অপরদিকে জগতের কোনও বস্তুরই তাঁর অপেক্ষা নেই। সর্বদা তাঁর আত্মস্থ অবস্থা। শ্রীমার এই অদ্ভুত ভাবাতীত অবস্থা যোগীনমা ও গোলাপমাই বেশিরভাগ সময় প্রত্যক্ষ করতেন। তাই তাঁদের মন সর্বদা যেন শ্রীমার কাছে রয়েছে। আর তাঁদের দৈনন্দিন ব্যবহারে একদিকে যেমন শ্রীমাকে ইষ্টদেবীজ্ঞানে শ্রদ্ধা ও ভক্তির অন্ত ছিল না।
অন্যদিকে শ্রীমাকে মেয়ের মতো নীরোগ ও আরামে রাখার জন্য ছিল যত্ন ও উদ্যম। শ্রীমাও তাঁদের উভয়ভাবেই সেবাভক্তি, বাৎসল্য স্বীকার করতেন ও তাঁদের আনন্দ দিতেন। স্বামী বিবেকানন্দ যাঁকে সারদানন্দ সন্ন্যাসনাম দিয়েছেন। সেই মায়ের দ্বারী শরৎ মহারাজ মহাভাবময়ী শ্রীমাকে উভয়রূপে মা ও মেয়েভাবে যুগপৎ দেখেছেন। উদ্বোধনে দ্বারসংলগ্ন ঘরে বসে মহারাজ পাহারা দিতেন। যাতে যেকোন ব্যক্তি হোক না, যখন তখন গিয়ে শ্রীমাকে বিরক্ত করতে না পারে। তাঁর বিশ্রামের যেন ব্যাঘাত না ঘটে। অনধিকারী ব্যক্তি শ্রীমাকে অযথা স্পর্শ করে তাঁর পবিত্রদেহে পীড়া উৎপাদন করতে না পারে, হুজুকের অবকাশ না পায় সেদিকে মহারাজের সদা লক্ষ্য ছিল।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮০: শ্রীশ্রীমার অনুগ্রহ
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৭: ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগে মহর্ষি পেলেন চরম দুঃসংবাদ
শ্রীমার একখানা ছবি পাওয়াও তখন কঠিন ছিল। যেহেতু শ্রীমা অন্তরালে থাকতে চাইতেন, তাই শরৎ মহারাজ সর্বপ্রকারে যত্নশীল ছিলেন। আবার যখন কোনও ভক্তকে শ্রীমা স্বয়ং বিশেষ কৃপা করতেন, তখন বিনম্রচিত্তে মাথা নত করে বলতেন, ‘ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন’। গোলাপমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল যে, কোনও ভাবুক ভক্ত ভাবের আতিশয্যে শ্রীমার অস্বস্তি উৎপাদন না করে। তাই যখন একজন ভক্ত শ্রীমার শ্রীচরণে অঞ্জলি দিয়ে প্রণাম করে ন্যাস প্রাণায়াম করে অনেকক্ষণ ধরে পুজো করতে লাগলেন।
আরও পড়ুন:
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৬: ‘রাজর্ষি’ অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ‘বিসর্জন’ নাটক
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৩: সুন্দরবনের পাখি—চড়াই
গোলাপমা তাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘এ কি কাঠের ঠাকুর পেয়েছ যে, ন্যাস-প্রাণায়াম করে তাঁকে চেতন করবে?’ মা যে ঘেমে অস্থির হয়ে যাচ্ছেন। দেখে গোলাপমার প্রাণ অস্থির হয়ে উঠল। শ্রীমাকে তাড়াতাড়ি তুলে নিয়ে গিয়ে গায়ের চাদর খুলে দিয়ে তবে শান্ত হলেন। এতো সতর্ক দৃষ্টি রাখা সত্ত্বেও শ্রীমা কখনও কখনও অবাঞ্ছিত ব্যক্তিকেও কৃপা করেন সব নিয়ম ভেঙে। তার জন্য নিজে কষ্ট সহ্য করেন আর তাই দেখে নীরবে গোলাপমা ও যোগীনমা চোখের জল ফেলেন। স্বামী সারদেশানন্দ বলেন যে, মেয়ে কাঁদেন মার জন্য, মা কাঁদেন মেয়ের জন্য, উভয়েরই পরস্পরের প্রতি সমান টান। এ এক মা মেয়ের অদ্ভুত লীলা। ‘লীলা’ বলা হয়, যখন ফলভোগের জন্য কর্ম করা হয় না, জগৎ কল্যাণের উদ্দেশে কাজ করা হয়। তাই ঈশ্বর ও অবতারের ক্রিয়াকে লীলা বলে। কিন্তু মানুষ কর্ম করে ভাল বা মন্দ ফলভোগের জন্য। কারণ, মানুষের কাজে ফলের ইচ্ছা থাকে। ঈশ্বর তো পূর্ণকাম, তিনি নিজের ইচ্ছার জন্য কর্ম করেন না। তাঁর কেবল শরণাগতি বা বিশুদ্ধপ্রেম ও শুদ্ধা ভক্তি চাই। যে ভক্তি ও প্রেমানন্দ বৃন্দাবনের গোপীভাবে আছে। এই উপাসনাকেই ‘রসোপাসনা’ বলে।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৮: কপোত-কপোতী
রস বা আনন্দস্বরূপতা কেবল ভগবানেরই বৈশিষ্ট্য। তাই তো তিনিই এক থেকে বহু হয়েছেন, ‘একঃ অহম্ বহু স্যাম্’। জয়রামবাটিতে তখন শ্রীমা ম্যালেরিয়ায় অসুস্থ। শরৎ মহারাজ, যোগীনমা, গোলাপমা গেছেন কলকাতা থেকে অতি ব্যস্ত হয়ে, সঙ্গে দুজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, আর সেবক, সেবিকা নিয়ে। হোমিওপ্যাথ কাঞ্জিলাল, আর অ্যালোপ্যাথ সতীশবাবু আসছেন শুনে শ্রীমার ভাবনা বাড়ল। নিজের অসুখের কথা আর মনে নেই। বলছেন, ‘এই মোটা শরীরে এতদূর আসা, শরতের না জানি কত কষ্ট হয়েছে। যোগেন, গোলাপ, তারাই বা কত কষ্ট করে আসছে’। আবার কোনও সন্তানকে কাছে ডেকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘হ্যাঁগা, শরতের কেন এত কষ্ট করে আসা’? ভক্তটি নানা কথা বলে শ্রীমার অবুঝ মনে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করছেন। তাঁদের সকলের পৌঁছানোর সময় কাছে চলে এলে শ্রীমা আরও অস্থির হয়ে পড়লেন। ‘বেলা হল, রোদে তারা কত কষ্ট করে এতদূর হেঁটে আসছে’।
আরও পড়ুন:
পৌষ সংক্রান্তি
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৭: পাণ্ডবদের নিজরাজ্যে প্রত্যাবর্তন ও রাজ্যার্দ্ধপ্রাপ্তিতে, সদর্থক চিন্তার অবদান
সকলের বিষ্ণুপুর থেকে কোয়ালপাড়া অবধি ঘোড়ার গাড়িতে এসে সেখান থেকে জয়রামবাটি হেঁটে আসার কথা। তাঁরা শ্রীমার বাড়ি পৌঁছলেন। শরৎ মহারাজ বাইরের ঘরে অপেক্ষা করতে লাগলেন। যোগীনমা ও গোলাপমা ভেতরে শ্রীমার শয্যার পাশে গেলেন। যোগীনমাকে দেখেই তিনি বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁগা যোগেন, তোমাদের কেন এত কষ্ট করে আসা’? যোগেনমাও চোখের জলে বললেন, ‘তোমায় না দেখে যে থাকতে পাচ্ছিলুমনি মা। অসুখ শুনে প্রাণ ছটফট কচ্ছিল, তাই ছুটে এলুম’। চিকিৎসা, যত্নে ও ঔষধে শ্রীমা তাড়াতাড়ি সেরে উঠলেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।