
মা সারদা।
বদনগঞ্জ হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান শিক্ষক প্রবোধবাবু সেই অঞ্চলের সম্মানিত ব্যক্তি। কামারপুকুরে ঠাকুরের জন্মস্হানের কাছে ‘গোঁসাইয়ের ভিটা’ জমি কিনে মন্দির এবং আশ্রম প্রতিষ্ঠার জন্য আগ্রহী হয়ে শরৎ মহারাজ ওই জমির মালিক লাহাবাবুদের সঙ্গে কথা বলার জন্য প্রবোধবাবুর উপর ভার দেন। প্রবোধবাবু তার জন্য বিশেষ চেষ্টা করেন। আর মাঝে মধ্যে কামারপুকুর যাতায়াত করেন। শ্রীমারও এই বিষয়ে আগ্রহ আছে। তাই প্রবোধবাবু মধ্যে মধ্যে তাঁর কাছে এসে কতদূর কি হল খবর দিয়ে যান। আজ লাহাবাবুদের সঙ্গে দরদাম নিয়ে কথা পাকা করে মা সারদাকে প্রণাম ও দর্শন করে প্রবোধবাবু সব বলার জন্য আসবেন।
কামারপুকুর থেকে ফিরতে বেলা হয়ে গেল দেখে ভাবলেন যে শ্রীমার বাড়িতে দুপুরের আগে পৌঁছতে পারবেন না। অসময়ে গেলে বাড়ির সকলের অসুবিধে হবে। তাই শ্রীমাকে শুধু খবরটা জানিয়ে নিজের বাড়ি ফিরে আহার করবেন। তিনি যখন শ্রীমার বাড়ি আসেন, তখন বাড়ির ছেলেরা মধ্যাহ্ন ভোজনের পর বৈঠকখানায় বসে গল্পগুজব করছেন। আর শ্রীমা মেয়েদের নিয়ে খেতে বসেছেন। এমন সময় প্রবোধবাবু চুপি চুপি বৈঠকখানায় ঢুকে দরজা ভেজিয়ে বসলেন। পান চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘আপনারা আমার খাওয়ার জন্য কিছু ভাববেন না। আমি ঘরে গিয়ে খাব। বাড়িতে বিশেষ জরুরী কাজ আছে। এখনই চলে যাব, শুধু মাকে প্রণাম করে বলে যাব যে, কামারপুকুরের খবর খুব ভাল, লাহাবাবুদের সঙ্গে কথা প্রায় পাকা হয়ে গেছে’।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৯: বালিকাভাব মা সারদার

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৫: রবীন্দ্রনাথ ভয় পেতেন মহর্ষিদেবকে
প্রবোধবাবু খুবই বিচক্ষণ ব্যক্তি খবর নিয়ে যখন জানলেন যে, শ্রীমা খেতে বসেছেন, তখন একটু তামাকের ব্যবস্থা করতে বললেন। শ্রীমার খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করবেন। আর সকলকে সাবধান করে দিলেন যে, তাঁর আসার কথা শ্রীমাকে যেন জানানো না হয়। নাহলে শ্রীমা ব্যস্ত হয়ে নিজের আহার ছেড়ে তাকে খাওয়াবেন। বেলা হবে ভেবে তিনি আগেই ভরপেট জলখাবার খেয়ে এসেছেন। এখনও তাঁর মুখে পান দেখে সকলে নিশ্চিন্ত হলেন। তাঁর তামাকপ্রীতি সকলেরই জানা। তাই ভালোভাবে তামাকের ব্যবস্থা করা হল। তিনি একটি মোড়াতে বসে আরাম করে তামাকে টান দিয়েছেন, তখনই বাড়ির ভেতর থেকে শ্রীমার ডাক শোনা গেল, ‘বাবা, প্রবোধকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও, পাতে ভাত দেওয়া হয়েছে। হাত,মুখ ধুয়ে এসে খেতে বলো’।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৭: পাঞ্চালীকে আশীর্বাদ করে আলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন গান্ধারী

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৭: ভাগ নুনিয়া, ভাগ
প্রবোধবাবু তাড়াতাড়ি কোলকের আগুন ফেলে দিয়ে হাসিমুখে বললেন, ‘পরে এসে ভাল করে তামাক খাব, মা কি করে টের পেলেন আমি এসেছি, বোধ হয় আমাদের কথা শুনতে পেয়েছেন’। প্রবোধবাবু শীঘ্র ঘাটে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে গিয়ে দেখেন যে, শ্রীমা তাঁর ঘরের বারান্দায় বসে মেয়েদের সঙ্গে একপাশে খাচ্ছেন। বারান্দার অন্যধারে আসন জল দিয়ে পাতায় ভাত তরকারি দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৪: ত্রিপুরার মাণিক্য রাজাগণ সর্বদা সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করে গিয়েছেন

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮১: সুন্দরবনের পাখি—বেনে বউ
প্রবোধবাবু জোড়হাতে বারান্দার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই শ্রীমা মৃদু হেসে ‘এসো বাবা’ বলে নিজের পাতা থেকে ভুক্ত ডালভাতে তরকারি কিছুটা মেখে একটা ডেলা তাঁর হাতে দিয়ে বললেন, ‘বসো ওখানে, খাও, তোমার জন্য দেওয়া হয়েছে। ভাত, তরকারি সবই বেশি ছিল, যথেষ্ট আছে, কোনো ভাবনা করো না, পেটভরে নিশ্চিন্তে খাও’। প্রবোধবাবুর মনপ্রাণ আনন্দে ভরে গেল। তিনি অবাক হয়ে ও খুশি মনে আসনে বসে খেতে আরম্ভ করলেন। শ্রীমাও ছেলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটু একটু মুখে দিচ্ছেন, ছেলেও মায়ের সামনে বসে কথা বলতে বলতে আনন্দে খেতে লাগলেন। কামারপুকুরের ভাল খবর শুনে শ্রীমা খুব খুশি।
আরও পড়ুন:

শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৯: টাকা-পয়সা থাকলে চোর-ডাকাতকেও লোকে সম্মান দেখায়
খাওয়ার শেষে মুখ ভরে পান চিবোতে চিবোতে বৈঠকখানায় এসে প্রবোধবাবু আবার মোড়ায় বসে বলেন, ‘এবার তামাকের আগুনটা ভাল করে আনুন, নিশ্চিন্ত হয়ে খাই। আপনাদের ঠকিয়েছিলাম। কিন্তু মার কাছে পারলাম না। এখানে প্রসাদ পাব বলেই সকালে কামারপুকুর থেকে বের হয়েছিলাম। কিন্তু রাস্তায় অন্য লোকের সঙ্গে কথাবার্তায় দেরি হয়ে গেল। তাই গাঁয়ের ভিতরে এসে ভাল করে হাতমুখ ধুয়ে পান জোগাড় করে মুখে দিলুম যাতে মুখ শুকনো না দেখায়। চুপি চুপি বৈঠকখানায় ঢুকলাম, দেখি আপনাদের খাওয়া-দাওয়া হয়েছে কিনা। মনে ছিল যে, আপনাদের খাওয়া না হলে একসঙ্গে খাব। নয়তো, বাড়ি ফিরে গিয়ে খাব। তা আজ দেরি হওয়াতে ভাগ্যবলে খুব লাভই হল। মায়ের প্রসাদ এভাবে পাওয়া গেল, আগে এলে এটা হত না। আর এরকম কখনও ভাগ্যে জোটেনি, জুটবেও না। মায়ের কৃপায় আজ প্রাণের সাধ মিটেছে। এখন নিশ্চিন্ত হয়ে তামাক খাই আর গল্প করি, আসুন’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।