ছবি: প্রতীকী।
মা সারদা আহার হয়ে যাওয়ার পর বিশ্রাম করছেন। তখন শীতের বিকেল। বাইরের বাটিতে ডিসপেনসারিতে সেসময় স্বামী সারদেশানন্দ কাজ করছিলেন। হঠাৎ তিনি খবর পেলেন যে ‘মায়ের পেটে ব্যথা, খুব কষ্ট হচ্ছে’। তিনি ছুটে গিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলেন, ‘কেমন ব্যথা, কখন হয়েছে, কেন হয়েছে, কোথায় কামড়াচ্ছে’ ইত্যাদি। শ্রীমাকে তিনি হোমিও ওষুধ দেবেন। মা সারদা কাতরভাবে উত্তর দিলে তিনি তাড়াতাড়ি ওষুধ এনে খাইয়ে দেন। তবে শ্রীর তাতে মন মানল না। তিনি কাতরস্বরে আবার বললেন, ‘বাবা, বড় ব্যথা, খুব কষ্ট হচ্ছে, পেটে হাত বুলিয়ে দাও’।
শ্রীশ্রীমার আবদার, কি উপায়? তিনি খাটের উপর দেওয়ালের বিপরীত দিকে পাশ ফিরে লেপের তলায় হাত, পা গুটিয়ে শুয়ে আছেন। খাটের নিচে বসে পেটে হাত বোলাতে সুবিধা হবে না। কিন্তু শ্রীমার খাটে বসা কি ঠিক! কি করা যায়, শ্রীমা খুব কষ্ট পাচ্ছেন ভীষণ ব্যথায়, অস্থির হয়ে পড়েছেন।
শ্রীশ্রীমার আবদার, কি উপায়? তিনি খাটের উপর দেওয়ালের বিপরীত দিকে পাশ ফিরে লেপের তলায় হাত, পা গুটিয়ে শুয়ে আছেন। খাটের নিচে বসে পেটে হাত বোলাতে সুবিধা হবে না। কিন্তু শ্রীমার খাটে বসা কি ঠিক! কি করা যায়, শ্রীমা খুব কষ্ট পাচ্ছেন ভীষণ ব্যথায়, অস্থির হয়ে পড়েছেন।
আগে একদিন শ্রীমার ঘরে তাড়াতাড়ি বসতে গিয়ে স্বামী সারদেশানন্দ হাতের কাছে একটি আসন দেখে তাতে বসতে গেলে শ্রীমা খুব সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন, “ওখানা রেখে দাও, বাবা। ওতে আমি বসি। ওই দেখো আসন আছে, ওতে বসো’। গুরুর আসনে বসা মহা অপরাধ। পাছে ছেলের অকল্যাণ হয়, তাই তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তবে ছেলের কাছে আজ তা ভাবার সময় নেই, অন্য কোন উপায়ও দেখা যাচ্ছে না।
তাই তিনি শ্রীমার বিছানার উপর বসেই হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। মাঝে মাঝে তাঁকে আশ্বাসও দিতে লাগলেন। দেখতে দেখতে ব্যথার খানিক উপশম হলে শ্রীমার মুখচ্ছবি বালিকার মতো প্রসন্ন হল আর স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। তারপর হট ওয়াটার ব্যাগ নিয়ে আস্তে আস্তে সেঁক দেওয়া হলে ব্যথার অনেকটা উপশম হয়। এরপর শ্রীমার একটু তন্দ্রা আসছে দেখে সারদেশানন্দ নীরবে উঠে আসেন। তখন শ্রীমা সুখে ঘুমোচ্ছেন দেখে ঘরের সকলের মন আশ্বস্ত হল।
তাই তিনি শ্রীমার বিছানার উপর বসেই হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। মাঝে মাঝে তাঁকে আশ্বাসও দিতে লাগলেন। দেখতে দেখতে ব্যথার খানিক উপশম হলে শ্রীমার মুখচ্ছবি বালিকার মতো প্রসন্ন হল আর স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। তারপর হট ওয়াটার ব্যাগ নিয়ে আস্তে আস্তে সেঁক দেওয়া হলে ব্যথার অনেকটা উপশম হয়। এরপর শ্রীমার একটু তন্দ্রা আসছে দেখে সারদেশানন্দ নীরবে উঠে আসেন। তখন শ্রীমা সুখে ঘুমোচ্ছেন দেখে ঘরের সকলের মন আশ্বস্ত হল।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৮: মা সারদার ‘পরকে আপন করা’
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৫: রবীন্দ্রনাথ ভয় পেতেন মহর্ষিদেবকে
গৃহীমাত্রই জানে হঠাৎ ছোট শিশুর পেটে ব্যথা হলে কি মুশকিল হয় বাড়িতে। বাড়িশুদ্ধ সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে, কিভাবে শিশুকে আরাম দেওয়া যায়। শ্রীমাও অসুখের সময় এমন শিশুদের মতোই হয়ে যেতেন। এই বালিকার মতো ভাব অনেক ছোটখাটো ব্যাপারেও শ্রীমার মধ্যে লক্ষ্য করে ভক্তদের বিস্ময় ও বিশেষ কৌতুহলের উদ্রেক করত। একদিন স্বামী সারদেশানন্দ এক ঘড়া দুধ নিয়ে বিষণ্ণ মুখে শ্রীমার বাড়িতে আসছিলেন। শ্রীমার কাছে দুধের ঘড়া ভয়ে ভয়ে নামিয়ে রেখে প্রণাম করে কাতরস্বরে তিনি বলেন যে, খাঁটি দুধ পাবার জন্য বেশি দাম দিয়ে তার বন্ধু জ্ঞানানন্দ এক নিম্নশ্রণীর লোকের ঘর থেকে এই দুধ সংগ্রহ করেছে। কিন্তু যেতে যেতে চোখে পড়ল দুধে একটি শুকনো সরু মৌরলা মাছ ভাসছে। দেখেই তো ভক্তের মাথায় বজ্রাঘাত হল, দুধ ফেলে দেবার ইচ্ছা হল। পরে অনেক ভেবে নিয়ে আসেন।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৬: যদি হই চোরকাঁটা
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮১: সুন্দরবনের পাখি—বেনে বউ
এখন শ্রীমা যেমন আদেশ করবেন, রাখার হলে রাখবেন, ফেলার হলে ফেলবেন। তার বন্ধুটির মনে খুব ইচ্ছা ছিল যে খাঁটি দুধে ঠাকুরের পায়েস ভোগ হবে। আর শ্রীমা একটু মুখে দেবেন। কিন্তু হায়! সব সাধে বাদ পড়ল। শুনে মা সারদাও ব্যথা পেলেন, বিষণ্ণ হয়ে বললেন, ‘বাবা, ফেলে দিতে হবে না, ছেলেপিলে আছে, তারা তো খেতে পারবে’। ঠাকুরের ভোগে এ দুধ লাগবে না! ছেলেরা কতদূর থেকে কষ্ট করে এনেছে। তাই শ্রীমা বাড়ির সকলের মতামত জানতে চাইলেন যে, এই দুধে পায়েস করে ঠাকুরকে ভোগ দেওয়া চলবে কিনা। অবুঝ বালিকার মতো তিনি একে, তাকে, রাঁধুনিকে, এমনকি কাজের বৌকে পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। তিনি বিষণ্ণমুখে প্রশ্ন করছেন, ‘হ্যাঁগা, এ দুধ কি ঠাকুরকে দেওয়া চলবে না?’
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৬: রাজনৈতিক পরিসরে অখ্যাতি ও সন্দেহর আবিলতা থেকে কি মুক্তি সম্ভব?
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৯: টাকা-পয়সা থাকলে চোর-ডাকাতকেও লোকে সম্মান দেখায়
শুনে কেউ গম্ভীরভাবে বললেন, ‘তা কি হয়, মাছ পাওয়া গেছে দুধের ভেতর, ও দুধ তো ভোগের অযোগ্য হয়ে গেছে’। শ্রীমা খুব দুঃখিত হয়ে মলিন বদনে বসে আছেন। এমন সময় তাঁর ‘মুরুব্বি’ বাড়ির গিন্নীঠাকুরন যেন, নলিনী দিদি বাইরে থেকে এসে ভেতরে ঢুকতেই শ্রীমা তাকেও জিজ্ঞাসা করলেন। সব শুনে বেশ ‘মুরুব্বিয়ানা’ ফলিয়ে গলা ছেড়ে নলিনী দিদি বলে উঠল, ‘কি হয়েছে, পিসিমা, দুধের? কি করে চাষিবাসীর ঘরে একটা ছোট শুকনো মাছ পড়ে গেছে, তাকে তুলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। দুধের কি হয়েছে তাতে? ঠাকুরকে কেন দেওয়া চলবে না? খুব চলবে। কলকাতার গয়লারা দুধে কত কি মেশায়, কে তার খোঁজ রাখে? সেই দুধেই তো সব মিষ্টি হয়, পায়েস হয়, ঠাকুর-দেবতাকে ভোগ দেয় সবাই’। শুনে ভক্তটির মনে হয় যে, নলিনী দিদি ঠিক বলেছে।
আরও পড়ুন:
শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১২: দর্দরজাতক
কলকাতার দুধের কি বিচার আছে, কত কি মেশায় তাতে! তা যখন ঠাকুরকে দেওয়া যায়, তখন এ দুধও ঠিক চলবে, এ তো আরও খাঁটি দুধ। তখন নলিনী দিদির যুক্তিপূর্ণ কথায় শ্রীমা খুব খুশি হয়ে সায় দিলেন ও নিশ্চিন্ত হয়ে ঠাকুরের পায়েস ভোগের ব্যবস্থা করলেন। তারপর ঠাকুরকে ভোগ দিয়ে সেই ভোগ নিজহাতে পরিবেশন করে সকলকে খাইয়ে তাঁর প্রাণে আনন্দ আর ধরে না। সত্যই তিনি বালিকার মতো উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন আজ, বার বার করে বলে ক’য়ে সকলকে খাওয়াতে লাগলেন। ভাল দুধ পাবার জন্য বাজারে চলতি দামের থেকে বেশি দাম দিয়ে দুধ কেনা তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন যে, এরূপ দাম বাড়ালে তো পয়সার লোভে আরও বেশি দুধে জল দেবে, তাছাড়া জিনিসের দর বাড়িয়ে দিলে অন্য লোকের কষ্ট হয়। পয়সা হাতে থাকলেই এমন অতিরিক্ত দামে জিনিস কেনা খুবই অন্যায়, তাতে লোকের মনে ঈর্ষা, বিদ্বেষের সঞ্চার হয়। সেইজন্য এই বিষয়ে সাবধান করে দিতেন, কখনও কেউ কিনে ফেললে অপরের কাছে বেশি দামে কেনার কথা প্রকাশ করতে নিষেধ করতেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।