মা সারদা।
শ্রীমার জনৈক ভক্ত তাঁর প্রসাদ পাবার জন্য অতি ব্যাকুল হল। মা সারদা একটি সন্দেশ হাতে নিয়ে ঠাকুরকে দৃষ্টিভোগ দিয়ে এবং নিজের জিহ্বাগ্রে সেটি ঠেকিয়ে ভক্তকে খুব আনন্দের সঙ্গে দিলেন ও বললেন,’বাবা, খাও প্রসাদ’। স্বামী সারদেশানন্দ ঠাকুর এবং শ্রীমার দেশ দেখে কলকাতায় ফিরছিলেন। মা সারদা তখন উদ্বোধনে আছেন। নবাসন আশ্রমের ভক্তরা তাঁর হাত দিয়ে মা সারদার জন্য ‘ভাবদিঘি’ নামক জায়গার বিশেষ মুলো পাঠালেন। শ্রীমা এই মুলো পছন্দ করতেন। কারণ, কড়া মাটির মিষ্টি মুলো। তিনি যখন জয়রামবাটিতে থাকেন, তখন ভক্তরা তাঁকে ওই মুলো দিয়ে আসতেন। তাই তিনি এই মুলো পাবেন না ভেবে ভক্তরা দুঃখ পান। এখন যখন সেই সুযোগ এসেছে অনেক খোঁজ করে ভক্তরা কয়েকটি মুলো সংগ্রহ করলেন। এখনও মুলোর সময় হয়নি বলে মুলো পুষ্ট হয়নি। অনেক খুঁজে তাঁরা মাঝারি মাপের মুলো জোগাড় করেছেন। সেগুলোই যত্ন করে শ্রীমার জন্য বেঁধে দিয়েছেন। সারদেশানন্দ আরামবাগ থেকে চাপাডাঙা হয়ে মার্টিন কোম্পানির গাড়ি ধরবেন।
কলকাতা থেকে আসার সময় শ্রীমা তাঁকে বলেছিলেন, ‘বৌমার’ অর্থাৎ মণিবাবুর মার সঙ্গে দেখা করে যাওয়ার জন্য। তাই তিনি আরামবাগ থেকে বায়ুগ্রামে মণিবাবুর বাড়িতে গেলেন। তাঁকে দেখে মণিবাবুর মা ভারি খুশি হলেন। আর যখন শুনলেন যে, শ্রীমা বলেছেন তাকে দেখে যেতে,তখন পরম যত্নে নানারকম রান্না করে তাঁকে খাওয়ালেন। মণিবাবুর মা একটি রাত থেকে যাবার জন্য স্বামী সারদেশানন্দকে অনুরোধ করলেন। তিনি শ্রীমার জন্য একটি খাবার জিনিস তৈরি করে দেবেন যেটি শ্রীমা খেতে খুব ভালবাসেন। শ্রীমার শরীর এখন ভালো যাচ্ছে না। তিনি আমবাতের ব্যথায় বড় কষ্ট পাচ্ছেন জেনে মণিবাবুর মার মন ছটফট করে উঠল তাঁকে দেখার জন্য। কিন্তু তার মেয়ে অসুস্থ, তাই এখনই যেতে পারবেন না। এইজন্য শ্রীমার জন্য পছন্দের খাবার তাঁর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। শ্রীমার জিনিস নিয়ে যাওয়া ভাগ্যের কথা। স্বামী সারদেশানন্দ তাই পরমানন্দে তাঁর পূর্বের চেনা বন্ধু মণিবাবুর সঙ্গে ঠাকুর আর শ্রীমার প্রসঙ্গে আলোচনা করে রাত কাটিয়ে দিলেন।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৪: শ্রীমার গৃহী ভক্তদের সন্ন্যাসদীক্ষা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০২: দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি
পরদিন সকালে ফেরার সময় মণিবাবুর মা খুব সন্তর্পণে ভাল করে বাঁধা একটি বিস্কুটের টিন তাঁর হাতে দিলেন। সারদেশানন্দ সন্ধ্যার সময় উদ্বোধনে এসে দেখেন যে শ্রীমা শুয়ে আমবাতে কষ্ট পাচ্ছেন। একজন সেবিকা ওষুধ মালিশ করছেন। শ্রীমা তাঁকে দেখেই খুব খুশি হয়ে উঠে বসলেন। তাঁর কাছ থেকে সকলের খবর জানতে চাইলে সারদেশানন্দ জয়রামবাটি, কামারপুকুর আর অন্যান্য জায়গার ভক্তদের কুশলসংবাদ ও তাদের প্রণাম জানিয়ে শ্রীমার জন্য আনা মুলোর বাণ্ডিল আর বিস্কুটের টিন তাঁর হাতে দিলেন। সেই ভাবদিঘির মুলো দেখে মা সারদার কি আনন্দ! যেন কত বহুমূল্য জিনিস। ভুলে গেলেন ব্যথার কথা, ছোট মেয়ের মতো আনন্দে অধীর হয়ে তিনি টিনটি খুলে দেখে কি খুশি! তাঁর আনন্দ দেখে শ্রীমার প্রিয় বস্তুটি কি, তা জানার জন্য তাঁর ভক্তেরও আগ্রহ হল।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৭: রাতচরা
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৫: ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এবং চলচ্চিত্র
সারদেশানন্দ উদগ্রীব হয়ে দেখলেন, সেই মহামূল্য বস্তুটি হল মণিবাবুর মার দেওয়া ‘চালভাজা’। এ’যেন সেই দ্বাপরযুগে দ্বারকাধীশের সঙ্গে দেখা করতে যাবার সময় বন্ধু সুদামার নিয়ে যাওয়া চালভাজা। সুদামার কোমরে লুকিয়ে রাখা সেই পুটলি খুলে শ্রীকৃষ্ণও এমনই আনন্দের সঙ্গে খেয়েছিলেন। স্বামী জ্ঞানানন্দও প্রায় শ্রীমার বাড়িতে নানা জিনিস নিয়ে যেতেন। ওই সব জিনিস আনতে তাঁকে অনেক অসুবিধায় পড়তে হত, পরের কাছে হাত পাততেও হত। তাঁর বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ এটা পছন্দ করতেন না। কারণ তাঁরা জানেন যে, মা সারদা এসব ভালবাসেন না, তিনি এর থেকে সামান্যই নেন। বেশিভাগটাই অন্যে পায়। এইজন্য তাঁরা বন্ধুকে কটাক্ষ করতেও ছাড়ে না। সময়বিশেষে জ্ঞানানন্দ শ্রীমাকে খাওয়ানোর জন্য ভালো ভালো খাবার তৈরি করিয়ে নিয়ে যান। শ্রীমা খুশি হয়ে সেগুলি ঠাকুরকে ভোগ দিয়ে তাঁর সন্তানদেরই পেট ভরে প্রসাদ খাওয়ান। নিজের মুখে কিছুটা স্পর্শ করিয়েই খুব প্রশংসা করেন। বন্ধুদের সমালোচনায় শ্রীমার ভক্তের উদ্যম না কমলেও তাঁর মনে কিছুটা ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
আরও পড়ুন:
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১৪: আমি তাইতে কি ভয় মানি!
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৩: হৃদয়পুরের লক্ষ্যপূরণ ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’
একদিন স্বামী জ্ঞানানন্দ বাইরে থেকে শ্রীমার কাছে এমনই জিনিস নিয়ে গেছেন। তাঁর পরিশ্রম আর কষ্ট দেখে কেউ দুঃখ করে বললেন, ‘কেন এতো কষ্ট করা’। শ্রীমা তার কথা শুনে সায় না দিয়ে আর্দ্রস্বরে বললেন, ‘ভক্ত না দিলে ভগবানকে কে দেবে, বাবা’। একথা শুনে জ্ঞানানন্দের মন আনন্দে ভরে উঠল। তিনি জিনিস নিয়ে আগের থেকেও ঘনঘন যাতায়াত করতে লাগলেন। তবে কিছুদিন বাদেই আবার অসুবিধায় পড়লেন। শ্রীমাকে খাওয়ানোর জন্য তিনি দূরদেশ থেকে সুগন্ধি সরু চাল জোগাড় করেছেন। আর জনৈক ভক্ত মহিলাকে তাই দিয়ে ভাল পিঠে তৈরি করিয়েছেন। বিকেলবেলায় যখন সেই পিঠে নিয়ে রওনা দেবেন,তখন কোন ব্রাহ্মণ ভক্ত বললেন যে, মা সারদা ব্রাহ্মণবিধবা। তিনি নিষ্ঠাচারে থাকেন, তিনি রাতে চালের জিনিস মুখে দেবেন না। শুনে ভক্তের মন ভেঙ্গে গেল, তাও ঠিক করলেন যে শ্রীমার জন্য তৈরি করা খাবার তাঁর কাছেই নিয়ে যাবেন, শ্রীমা যা ইচ্ছা তাই করবেন। চিন্তিত ও দুঃখিত মনে তিনি পিঠে বহন করে সাত মাইল চলে সন্ধ্যার আগে জয়রামবাটি পৌঁছলেন। সেখানে শ্রীমার সামনে খাবার রেখে তাঁকে সভয়ে সব জানালেন। শ্রীমাও সব স্থিরভাবে শুনলেন। তাঁর সন্তান চোখে জল নিয়ে বলল, ‘অনেকদিনের সাধ ছিল, মা এই পিঠে মুখে দেন’।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে
সন্তান কম মনোযোগী কিন্তু অতি সক্রিয়? সহজ উপায়ে বাড়িতেই এর চিকিৎসা সম্ভব
শ্রীমা আনন্দের সঙ্গে বললেন,’ বাবা, মুখে দেবো বইকি। তুমি এতদূর থেকে বয়ে নিয়ে এসেছ, কত কষ্ট করে তৈরি করিয়েছ, আর একজন দূরদেশ থেকে কষ্ট করে পাঠিয়েছে। রাতে ঠাকুরকে দিয়ে মুখে দেবো। তুমি এজন্য চিন্তা করো না’। তারপর আর এক সন্তান সারদেশানন্দকে দেখে হেসে বললেন, ‘ছেলেদের জন্যে আমার কোনও নিয়মকানুন থাকে না’। সন্তানদের হৃদয় আনন্দে ভরে গেল। রাতে তারা শ্রীমার হাতে পিঠে প্রসাদ পেটভরে খেলেন। সন্তানের খাওয়া হলেই মায়েরও খাওয়া হয়, মাও সন্তানের জন্যই খান।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।