মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


মা সারদা।। সংগৃহীত।

স্বামী অরূপানন্দ অল্পবয়সে সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে একটি আশ্রমে যোগ দেন। সেখানে তাঁকে কঠোর পরিশ্রম করতে হত। থাকা ও খাওয়ার কষ্ট তো ছিলই, তাছাড়া আশ্রমের প্রধান তাঁকে অনেক সময় পীড়ন করতেন। এতসব সহ্য করেও অরূপানন্দ ওই আশ্রমের অধ্যক্ষকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তাই নিদারুণ কষ্ট সহ্য করেও তিনি ওই আশ্রমে অনেকদিন ছিলেন। কিছুকাল পরে আশ্রমের নিয়মকানুন অসহনীয় মনে হওয়ায় তিনি সেই আশ্রম ত্যাগ করে কাশী যাওয়া স্থির করেন। ছোট বয়স খেকেই তাঁর ঠাকুরের প্রতি ভক্তিভাব ছিল। তাই কাশী যাবার পথে বর্ধমানে নেমে তিনি ঠাকুরের জন্মস্থান কামারপুকুর দেখতে যান। সেখান থেকে তিনি জয়রামবাটি গিয়ে শ্রীমার দেখা পান।
মা সারদার অপার স্নেহ পেয়ে তিনি দুঃখী বালকের মতো চোখের জল ফেলতে থাকেন। তিনি শ্রীমাকে তাঁর দুঃখের কাহিনী বলেন। সন্তানের দুঃখে শ্রীমার চোখও জলে ভরে যায়। শ্রীমা তাঁকে অভয় দিয়ে আশ্বস্ত করে দীক্ষা দান করেন আর চিরকালের জন্য তাঁকে মায়ের স্নেহবন্ধনে আবদ্ধ করেন। শ্রীমার অপার স্নেহের অধিকারী হয়ে স্বামী অরূপানন্দ সেখানেই অনেকদিন বাস করেন। তাই তিনি সদা শ্রীমার চরণকমল দেখার সুযোগ পান। শ্রীমার সেবার অধিকার লাভ করে তাঁর স্নেহে আপ্লুত হয়ে নিজের জম্ম সার্থক করেন। কামারপুকুর থেকে কিছুদূরে একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রবোধ চট্টোপাধ্যায় আর তাঁর সহযোগিরা কেউ কেউ শ্রীমার ভক্ত ছিলেন। তাঁরা মাঝে মাঝে জয়রামবাটি এসে শ্রীমাকে দেখে যেতেন। তাঁদের অনেক ছাত্রই একথা জানত।
আরও পড়ুন:

বাংলা বুকের ভিতরে

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৯: সুন্দরবনের পাখি—পানকৌড়ি

একজন বালকের মনে, পরবর্তিকালের স্বামী গৌরীশ্বরানন্দ, তার মাস্টারমশাইকে শ্রদ্ধার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মভাবও দেখা দেয়। সে মাস্টারমশাই কোথায় যান তা অনুসন্ধান করে ঠাকুরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। ক্রমে সে মা সারদার কথাও জানতে পারে। তবে প্রধান শিক্ষক খুব কড়া মানুষ ছিলেন। তিনি ছোট ছেলেদের কিছু না বুঝে শুধু ধর্মকর্ম করা পছন্দ করতেন না। বালকটি তাই গোপনে ঠাকুরের বিষয়ে লেখা গ্রন্থাদি পাঠ করত এবং আলোচনা করত। নবাসন আশ্রমের ব্রহ্মচারি স্বামী জ্ঞানানন্দকে সে বলেছিল যে, তার কাছে ঠাকুরের ছবি রাখার উপায় নেই, তাই সে আশ্রমে ঠাকুরের ছবি দেখে মনে এমন গেঁথে নিয়েছে যে যখনই মনে ভাবে ঠাকুরকে দেখতে পায়। ভাগ্যক্রমে শ্রীমার কৃপাধন্য স্বামী সারদেশানন্দের সঙ্গে তার কথা হত এবং পরে তাঁদের মধ্যে হৃদ্যতা হয়। সন্ন্যাসীদের সঙ্গে সে একদিন লুকিয়ে শ্রীমাকে দর্শন ও প্রণাম করে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪২: যোগমায়া দেবী—এক প্রতিবাদী নারী

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৬: কোমলপ্রাণা মা সারদা

ভক্তিমান ছেলেটিকে দেখে শ্রীমা খুশি হয়ে তার পরিচয় জানতে চান। নিজের কৃপাপাত্র সন্তানের ছাত্র জানতে পেরে তিনি আনন্দিত হন। ছেলেটিকে আদর করে প্রসাদ খেতে দেন। ছেলেটি মনে ভাবে, যদি তার মাস্টারমশাই শ্রীমার কাছে তার আসার কথা জানতে পারে, তাহলে তিনি খুব রাগ করবেন। একইসঙ্গে তার মনে তাই আনন্দের মধ্যেও শঙ্কা দেখা দেয়। সে তখন তার সঙ্গে আসা সাধুদের কাছে মনের কথা জানালে তাঁরা শ্রীমার কাছে সবিনয় নিবেদন করেন যে, ছেলেটির মাস্টারের কাছে যেন কখনও কথাপ্রসঙ্গে তার আসার কথা জানানো না হয়।

শ্রীমা মৃদুহাসিতে অভয় দিলে সকলে নিশ্চিন্ত হন। এইভাবে শ্রীমার মমতা লাভ করে ক্রমশ মা সারদার কাছে তার যাওয়া- আসা বেড়ে গেল। আর অচিরেই সে মা সারদার কৃপাও পেল। তার মধুর চরিত্র ও ব্যবহারের জন্য খুব তাড়াতাড়ি সে শ্রীমার বাড়ির সকলেরই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। সে শ্রীমার বিশেষ স্নেহ পেয়েছিল। পরে ছেলেটির মাস্টারমশাই শ্রীমার প্রতি তার অশেষ ভক্তি ও তার জন্য মা সারদার বিশেষ মমতার কথা জানতে পারেন, তখন তিনিও অতিশয় আনন্দিত হন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

মুভি রিভিউ: স্ত্রী-২ ছবিতে স্কন্দকাটা দৈত্য আক্রমণ করছে আধুনিক নারীদের

সেখানেই একজন প্রৌঢ় বয়স্ক ভক্ত এক অপরাহ্ণে শ্রীমাকে দেখতে আসেন। তিনি সম্ভ্রান্ত লোক হলেও শ্রীমার ঘরের ভিতরে নীচে একটি আসনে বসেছেন। আর মা সারদা নিজের বিছানার উপর বসে আছেন। তিনি ঠাকুরের বিষয়ে নিজের কিছু লেখা শ্রীমাকে নিভৃতে শোনাচ্ছিলেন। শ্রীমাও মাঝে মাঝে নানা বিষয়ে নিজের মন্তব্য রাখছিলেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে তার অল্পবয়স্ক ভক্তিমান ছেলেও ছিল। সে তার বাবার কাছে বসে দুপক্ষের কথা শুনছিল।

শ্রীমা তাই দেখে তার উপর সন্তুষ্ট হলেন। বাবা তার ছেলের সৎ চরিত্র ও ধর্মভাবের প্রশংসা করে শ্রীমার কৃপা আর আশীর্বাদ চাইলেন। মা সারদার মন তো সন্তানের প্রতি করুণায় পূর্ণ। তিনি তখনই সন্তানের প্রতি বিশেষ অনুকম্পা প্রকাশ করে তাকে দীক্ষা দিলেন। বাকিরা শুধু দেখলো গদগদচিত্তে বালকটি শ্রীমায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়েছে। আর তার বাবাও প্রেমাশ্রুপূর্ণ চোখে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রীমার একজন বাল্যসখী ছিলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৩: আধুনিকতার নিরিখে দ্রৌপদী ও অর্জুন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

দু’জনের মধ্যে খুব ভাব ছিল। একদিন তাঁরা একসঙ্গে এক বিছানায় শুয়েছিলেন। বাল্যসখীর মনে শ্রীমার কৃপা পাবার বাসনা হওয়ায় তখনই মা সারদা সেই শায়িত অবস্থাতেই সখীকে দীক্ষামন্ত্র দিয়ে ধন্য করেন। একবার দূরদেশ থেকে এক রোগা ছেলে ঠাকুরের জন্মতিথিতে উপস্থিত হয়ে শ্রীমার কৃপা চাইলে সকলের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি ছেলেটিকে দীক্ষা দেন। সাধারণত, ঠাকুরের জন্মতিথিতে শ্রীমা কাউকে দীক্ষা দিতেন না। সেই সময় তাঁর শরীরও ভালো না থাকায় সকলে আপত্তি করেন। মা সারদা তাদের বলেন, ‘কত কষ্ট করে এসেছে বহু দূর থেকে, পরে কি হয় বলা যায় না, নিরাশ করতে পারলুম না, তাই আজই দীক্ষা দিলুম। ঠাকুরের কৃপায় তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হল’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content