রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


মা সারদা।

দক্ষিণ ভারত থেকে মা সারদার ফেরার পর বেলুড়মঠে তাঁকে অভিনন্দন জানানো হয়। তাঁর গাড়ি দেখামাত্র ন’টি বোমা ছোঁড়া হয়। আর অসংখ্য ভক্তবৃন্দ দু’ দিকে সারিবদ্ধভাবে ‘সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে….’ প্রভৃতি মাতৃস্তব গাইতে আরম্ভ করে। শ্রীমা তাঁর সঙ্গিণীদের সঙ্গে সেই সারিবদ্ধ স্তুতির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসেন। যদিও প্রকাশ্যে তাঁর সর্বাঙ্গ এমনভাবে বস্ত্রাচ্ছাদিত ছিল যে দেখে মনে হয়েছিল কোনও মূর্তিকে সচল করা হয়েছে।
মহারাজের আদেশ ছিল যে, কেউই তখন শ্রীমার চরণস্পর্শ করতে পাবেনা। তাঁর ভয়ে শ্রীমার নিকটে যাওয়ার সাহস কেউ করেননি। কিন্তু স্বামী সুবোধানন্দ হঠাৎ মা সারদার পাদস্পর্শ করতেই মহারাজ বলে ওঠেন, ‘ধর, ধর’। এদিকে যাঁকে ধরা হবে, সেই খোকামহারাজ কোথায় যে উধাও হলেন, তা কেউ ঠাহর করতে পারলেন না। চারদিকে হাসির রোল পড়ে গেল। মা সারদাকে দোতলার একটি ঘরে বসানো হল। পুরুষভক্তদের বসার জন্য উঠোনে সতরঞ্চি পাতা হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬২: শ্রীমার দক্ষিণ ভারত থেকে প্রত্যাবর্তন

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৪: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গিরা শাক ও যদু পালং

মহারাজ একটি বেঞ্চে বসে কালী কীর্তনের দলটিকে কীর্তন শুরু করতে বললেন। তিনি একটি আলবোলা হুঁকায় ধূমপান করতে করতে কীর্তন শুনছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হুঁকার নলটি তাঁর হাত থেকে খসে পড়ল, তিনি সমাধিস্থ হলেন। সবাই অবাক হয়ে সমাধিমগ্ন মহারাজের দিকে চেয়ে রইলেন। দু’ ঘণ্টা অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তাঁর সমাধি না ভাঙলে শ্রীমার কথানুযায়ি একজন সাধু তাঁর কানে নামগান শোনাতে লাগলেন। তারফলে সমাধির ঘোর কিছুটা কাটল। গায়কের দলকে লক্ষ্য করে তিনি বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, চলুক, চলুক’।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৮: চরম শত্রুর সঙ্গেও মতের মিল হলে বন্ধুত্ব হয়, আবার মতের মিল না হলেই শত্রুতা

মনে হল যেন তিনি খানিকক্ষণ অন্যমনস্ক ছিলেন মাত্র। এরপর ঠাকুরের বালভোগ অনুষ্ঠিত হয়। শ্রীমা তার থেকে খানিক গ্রহণ করে বাকি সবটাই নীচে পাঠিয়ে দেন। শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী সেই প্রসাদের থালা হাতে পেয়ে নাচতে লাগলেন। গিরীশ ঘোষ বললেন, ‘ঠাকুরের প্রসাদ শ্রীমার স্পর্শে মহাপ্রসাদ হয়েচে, আমি থাকতে এ মহাপ্রসাদ আর কাউকে বিতরণ করতে দেব না। কিছু ভক্তকে বিতরণ করে থালাটি তিনি শরৎবাবুর হাতে ফিরিয়ে দিলেন।

আহারের পর বিশ্রাম করে সন্ধ্যায় শ্রীমা যখন মঠ থেকে বিদায় নিলেন, তাঁর সম্মানে আবার ন’টি বোমা ছোঁড়া হল। ১৩১৮ সালের পাঁচই জ্যৈষ্ঠ শ্রীমা কলকাতা থেকে জয়রামবাটি পৌঁছন এবং সাতাশে জ্যৈষ্ঠ বারবছরের রাধুর সঙ্গে পনের বছরের মন্মথ চাটুজ্যের বিয়ে দেন। বিয়েতে রাধুর সারা শরীর অলঙ্কারে মোড়া থাকলেও বরপক্ষীয়রা প্রতি বিষয়ে শরৎ মহারাজের থেকে বেশি টাকা দাবি করে নিয়েছিলেন। কেদার দত্ত এতে আপত্তি করায় শ্রীমা তাকে সেখান থেকে ডেকে সরিয়ে নেন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা

বিয়ের পরদিন বর ও কন্যাপক্ষকে প্রভূত ভোজনে আপ্যায়িত করা হয়। অনিমন্ত্রিত হয়েও গরীবদুঃখীরা যখন খেয়ে বাড়ি ফিরছিল, তখন পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে শ্রীমা তাদের খাওয়া দাওয়া কেমন হল জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। তারা ‘বরকনে সুখে থাকুক’ বলে আশীর্বাদ করে চলে গেল। তারপর দিন মা সারদার একহাজার টাকাসুদ্ধ বড় কালো বাক্সটা রাধুর শ্বশুরবাড়িতে যায়। বাক্সটা তিনিই রাধুকে দিয়েছিলেন। তবে তার মধ্যে টাকাটা যে আছে, তা খেয়াল করেননি।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১০: মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধ’রে

বরকনে বিদায় নিলে স্বয়ং ঠাকুর শ্রীমাকে দেখা দিয়ে বললেন, ‘একহাজার টাকা রাধুর বাক্সে দিয়ে দিলে?’ পরে বিভূতিবাবু তাজপুরে গিয়ে সেই টাকা নিয়ে আসেন। রাধুর বিয়ের আগে কৃষ্ণচন্দ্র সেনগুপ্ত শ্রীমাকে বলেছিলেন যে, মাস্টারমশাই মর্টনস্কুলের অধ্যক্ষ। তাঁকে বলা হলে তিনি সুপাত্র খুঁজে দেবেন। উত্তরে শ্রীমা বলেন, ‘আপনা থেকে ছেলে জুটবে তো জুটুক, আমি কাউকে বন্ধনে ফেলার জন্য বলব, তা কখনো হবেনা’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content