শ্রীরামকৃষ্ণ দেব ও মা সারদা।
ভক্তের মনের ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্য স্বয়ং জগৎজননী রণজিৎ রায়ের কন্যা রূপে জন্ম নেন। তাঁর দীঘি আরামবাগের দেড়ক্রোশ দক্ষিণপূর্বে ডিহিবায়রা গ্রামে অবস্থিত। সেই দীঘিতেই বালিকা বয়সে তাঁর মেয়ে অন্তর্হিত হন বলে প্রসিদ্ধি আছে। একবার বারুণীর মেলা উপলক্ষে গিয়ে মা সারদা সেই দীঘিতে স্নান করেন এবং বিশালাক্ষী মায়ের মন্দির দর্শন করেন। ১৩১০ সালে শ্রীমা কলকাতা যাবার সময় স্বামীজির শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর বর্ধমানের বাড়িতে দু’দিন থাকেন। সেখানে তিনি সর্বমঙ্গলা দেবী ও অষ্টোত্তর শিবমন্দির আর দক্ষিণ মশানের কালী দর্শন করতে যান। সেই দক্ষিণের মশানে কালীমূর্তির বিপরীত দিকে স্থিত ভৈরবের মূর্তির শ্রীমা খুব প্রশংসা করেন।
বিষ্ণুপুরে পোকাবাঁধ, লালবাঁধ, কৃষ্ণবাঁধ প্রভৃতি বিখ্যাত দীঘিগুলো অবস্থিত। বিষ্ণুপুর কামারপুকুর থেকে প্রায় চোদ্দ ক্রোশ দূরে অবস্থিত। প্রথম দিকে শ্রীমা বিষ্ণুপুর হয়ে যাবার সময় পোকাবাঁধ বা কৃষ্ণবাঁধে বিশ্রাম নিতেন। স্বামী সদানন্দ ১৩১৫ সালের চৈত্রমাসে বিষ্ণুপুরে গিয়ে প্রায় দুই মাস থাকেন। তাঁর সৎসঙ্গে সুরেশ্বর সেন ও তার পরিবারের সকলেই ঠাকুরের ভক্ত হন। ১৩১৮ সাল থেকে বিষ্ণুপুর হয়ে যাবার পথে মা সারদা সুরেশ্বরের বাড়িতে বিশ্রাম নিতেন।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৮: গুরুরূপে মা সারদা
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— দুধি লতা ও পঞ্চরতি লতা
একবার বিষ্ণুপুরে গিয়ে সেখানে শ্রীমা লালবাঁধের ধারে সর্বমঙ্গলার মন্দিরের প্রাঙ্গণে বসে বলেছিলেন যে, ঠাকুরের কথা তো আজ সত্যি হল। তিনি বলেছিলেন, ‘ওগো, বিষ্টুপুর গুপ্তবৃন্দাবন, তুমি দেখো’। শুনে মা সারদা বলেন যে, তিনি মেয়েমানুষ, কি করে দেখবেন? ঠাকুর উত্তর দেন, ‘না গো, দেখবে, দেখবে’। মা সারদা শৈলানন্দকে বলেছেন যে, তিনি দুবার নিজের মাসীর বাড়িতে গেছেন। সেখানে দোলযাত্রায় বগড়ী-কৃষ্ণনগরের কৃষ্ণরায়জীর মন্দিরও দর্শন করেছেন। তাঁর মাসীর বাড়ি সেখান থেকে একক্রোশ দূরে পিয়াশালা গ্রামে।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: সরলাদেবী—নির্ভীক এক সরস্বতী
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৪: স্বার্থান্বেষীকেও চিনতে শেখায় এই গ্রন্থ
একবার রথযাত্রায় গণেন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্রীমা মাহেশে যান। সেখানে প্রায় সারা দিন থেকে প্রসাদ খেয়ে রথের রশি টেনে তিনি কলকাতায় ফেরেন। ওই দিন রাধু আর নিতাইবাবুর মা তাঁর সঙ্গে মোটরগাড়িতে যান। যোগীনমা সহ শ্রীমার মহিলা ভক্তেরা মাহেশে নৌকা করে গিয়েছিলেন। মা সারদা তাঁর ভক্ত গিরিজা গুপ্তকে বলেছিলেন, ‘কালীঘাটের মা প্রত্যক্ষ দেবী। একদিন আমি তাঁকে দর্শন কত্তে গিয়েছি, অঞ্জলি দিয়ে প্রণাম করে প্রসাদী সিঁদুর নিয়ে এলুম। বাইরে বেরিয়ে ভাবলুম, এখানে সধবা মেয়ে অনেক আছে তাদের প্রসাদী সিঁদুর একটু একটু দিয়ে দি। সামনে সামান্য ঘোমটা দিয়ে একটি মেয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার কপালের মাঝখানে সিঁদুর দিতেই সে শিউরে উঠে মাথা সরিয়ে নিল। সে ব্যথা পেয়েছে ভেবে বল্লুম, এ কি মা, এমন কচ্চ কেন? কপালে লেগেছে? মেয়েটি খানিক চুপ থেকে আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকাল। তখন দেখতে পেলুম, তার কপালে আর একটি চোখ, তাতে সিঁদুর লেগেচে। আহা, মা কী দেখালে! এই বলতে বলতে আমার চোখ বুজে এল। তারপরেই চেয়ে মেয়েটিকে আর দেখতে পেলুম না’।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২৩: রাজসভায় মিথিলার সঙ্গীতজ্ঞ
ভক্তের পরিবারের আমন্ত্রণে ১৩১৭ সালের ১৮ অঘ্রান তিনি কলকাতা থেকে রওনা দিয়ে পরদিন ভক্তশ্রেষ্ঠ বলরাম বসুর উড়িষ্যার জমিদারি কোঠারে যান। সেখানে সরস্বতী পুজো উপলক্ষে তিনি দুমাসের কিছু বেশি দিন থাকেন। এই পুজোর সময় সেখানে যাত্রাগান হয়। সেই যাত্রায় দুটি বালক ঠাকুর সেজে অপূর্ব নৃত্যকলা দেখায়। আর তাই দেখে শ্রীমা এতটা মুগ্ধ হয়েছিলেন যে পরদিন রাতেও ওই যাত্রার অনুষ্ঠান আবার করতে হয়।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৭: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে/২
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?
শ্রীমার আদেশে দ্বিতীয় দিন পুজো করে তৃতীয় দিন প্রতিমার বিসর্জন দেওয়া হয়। কোঠারের তৎকালীন পোস্ট মাষ্টার অবস্থাবিপাকে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তার জন্য তিনি অনুতপ্ত হয়ে স্বধর্মে ফিরে আসতে চাইলে সেবকেরা মা সারদাকে সব জানান। তখন শ্রীমার অনুমতি নিয়ে দেবেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সরস্বতী পুজোর আগের দিন বলরাম বসুদের গৃহদেবতা শ্রীরাধাশ্যামচাঁদ জীর মন্দিরের সামনে প্রায়শ্চিত্ত করে কৃষ্ণলাল মহারাজের হাত থেকে গায়ত্রীমন্ত্র সহ উপবীত ধারণ করেন। তিনি মুণ্ডিত মস্তকে পৈতে কাঁধে এসে মা সারদাকে প্রণাম করতেই শ্রীমা তাকে প্রতি নমস্কার করলেন। আর পরদিন তাকে দীক্ষিত করে শ্রীমা নিজের একটি কাপড়ও দেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।