মা সারদা।
মা সারদা যে গান শুনতে ভালোবাসতেন তা প্রসঙ্গক্রমে আগেই বলা হয়েছে। শ্রীমা যখন কলকাতায় তাঁর নতুন বাড়িতে পদার্পণ করেন, তখন প্রতিদিন সন্ধ্যা আহ্নিকের পর দোতলায় মহিলা ভক্তদের সঙ্গে বসে নীচের বৈঠক থেকে স্বামী সারদানন্দের গাওয়া শ্যামাসঙ্গীত ভাব বিভোর হয়ে শুনতেন। শ্রীমা বলতেন, গানের তুল্য কি জিনিস আছে? তাঁর কথা ‘গানে ভগবানকে পাওয়া যায়’।
শুধু গান শোনার জন্য তিনি বাউল ও বৈরাগীদের ডেকে এনে খাওয়াতেন, তাদের টাকা-পয়সাও দিতেন। এই যেমন হরিদাস বৈরাগী বেহালা বাজিয়ে মা সারদাকে গান শোনায়, “কি আনন্দের কথা উঠে/ লোকের মুখে শুনি/ সত্য বলো শিবানী/অন্নপূর্ণা নাম কি তোর কাশীধামে?” তেমনই সাতবেড়ের লালু কৈবর্ত একতারা বাজিয়ে শ্রীমার উঠোনে নেচে নেচে বাউলগানের আসর জমিয়ে দেয়, “সংসারকে সার ভাবে যে, সেই তো মূঢ়/এই ভবের মাঝে ভেবে দেখ কে কার বাবা, কে কার খুড়ো/ এখন আলবোলাতে টানছ তামাক, শব্দ হচ্ছে গড়র গড়র / যখন বৃদ্ধকালে দন্ত যাবে, খেতে হবে মুঁড়ির গুঁড়ো।”
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৪: লোকশিক্ষক মা সারদা
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭১: মহাভারতে বর্ণিত পোষ্যপ্রাণী ও পালকপিতার সম্পর্কের বাঁধন, আজও খুঁজে পাওয়া যায় কী?
স্বামী ঈশানন্দের স্মৃতিকথন থেকে জানা যায়, এই সকল গান শুনে শ্রীমা খুব হাসতেন আর বেশ উপভোগ করতেন। মা সারদা নিজেও ভাল গান গাইতে পারতেন, তিনি সুগায়িকা ছিলেন। এই বিষয়ে দুর্গাপুরী দেবী লিখেছেন, “মাতাঠাকুরাণী সঙ্গীতানুরাগিণী ছিলেন, নিজেও গাহিতে পারিতেন। তাঁর কণ্ঠ ছিল অতি মধুর। তবে পাছে কেহ শুনিতে পায়, এই জন্য নিম্নকণ্ঠে গাহিতেন”। তবে নীচু স্বরে গান করেও তিনি নিজেকে গোপন রাখতে পারেননি।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩১: হেমন্তবালা দেবী— রবি ঠাকুরের পত্রমিতা
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৭: গাড়ি থেকে নেমেই ছবি বিশ্বাস বললেন, ‘তোদের ছবির নামই তো পথে হল দেরি’
একদিন রাতে নহবতের ঘরে বসে তিনি গান করছিলেন। ঠাকুর না জানি কেন সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। যেতে যেতে তিনি শুনে ফেললেন মা সারদার গান। পরের দিন ঠাকুর হাসতে হাসতে সারদা মাকে বলেন, “কিগো, কাল যে তোমাদের খুব গান হচ্ছিল শুনলুম। তা বেশ, বেশ”। এরপর, একবার এক নৌকো যাত্রায় ঠাকুরের অনুরোধে শ্রীমা তাঁকে গান গেয়ে শোনান। শ্রীমার মহিলা ভক্তদের আবদারে অবশ্য তাঁকে মাঝে মাঝে গান গেয়ে শোনাতে হত। রাধুর অনুরোধে মা সারদাকে গাইতে হত, “বন থেকে বেরুল টিয়ে/সোনার টোপর মাথায় দিয়ে, অথবা ঝিকিঝিকি তারা/বনকে বাদুরা”।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বন লেবু ও টাগরি বানি
আবার শ্রীমা কীর্তন গাইতেন, “কেশব কুরু করুণা দীনে কুঞ্জ কাননচারী / মাধব মনোমোহন, মোহন মুরলীধারী”। মা সারদার ঘনিষ্ঠ ভক্তদের কাছ থেকে তাঁর যে কয়েকটি প্রিয় গানের সন্ধান পাওয়া যায়, তার মধ্যে রয়েছে, “গিরি, গণেশ আমার শুভকারী, বিপদবারণ তুমি নারায়ণ, বার বারে যত দুঃখ দিয়েছ, দিতেছ তারা / সে কেবলি দয়া তব জেনেছি মা দুঃখহরা’। আর সীতার সেই অন্তরবেদনার গান, ‘বহু সাধনার গুণে পেয়েছিলেন নবদুর্বাদল শ্যাম / হারায়েছি বিনা যতনে ধিক এ জীবন…।”
আরও পড়ুন:
গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-২: অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া দুলিছে যেন?
বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১৩: অদ্বিতীয় সম্রাট
মা সারদা সংসারের নানা কাজ, সঙ্ঘের নেতৃত্ব করা, নিজের সাধনভজনের মাঝেও তাঁর সুকোমল মানসিক বৃত্তিগুলোকে শুকিয়ে যেতে দেননি। এই জন্য পরিণত বয়সেও, শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি কিশোরী মেয়ের মতন বৃষ্টির মধ্যে উঠোনে নেমে ছোটদের সঙ্গে ভিজে ভিজে শিল কুঁড়িয়ে অনাবিল আনন্দে মেতে উঠেছেন। আবার কখনও সাপুড়ে ডেকে পাড়ার ছোটদের জড়ো করে সাপ খেলার আসর বসিয়েছেন। দোলের দিনে ছোটদের সঙ্গে আবির খেলেছেন। কখনও বা ছোটদের বায়নায় সুর করে ছড়া আবৃত্তি করেছেন। আবার বড়দিনে ছোটদের নিয়ে চিড়িয়াখানায় বেড়াতেও গেছেন। মেয়েদের আবদারে তাদের সঙ্গে বসে তাসও খেলেছেন। মেয়েদের নিয়ে কখনও পালাগান শুনতে গেছেন সেই ছোটবেলার মতো। এমন পালাগান শুনতে গিয়েই তো ছোটবেলায় সকলের মাঝে শ্রীমা ঠাকুরকে চিনেছিলেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।