বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

শূর্পনখা অরণ্যচারিণী, স্বেচ্ছাগামিনী, স্বেচ্ছারূপিণী। ইচ্ছা মতো রূপ ধারণ করে সে মোহিনী মায়ায় বাঁধতে চেয়েছিল অরণ্যচারী আর্য পুরুষের হৃদয়। অপরিচিত পুরুষের কাছে কামনার উদগ্র প্রকাশে লজ্জা পায়নি সে, বাধা পায়নি মনে। সে কেবল রামের কাছে অকপটে মেলে ধরেনি তার মনের বিহ্বলতা, বরং সীতাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে তাকে সরিয়ে দেবার কথাও ভেবে নিয়েছিল। এমন অসম্ভব ভাবনার প্রকাশে কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বোধ করেনি সে।
রাম শূর্পনখার মনোগত অভিলাষ বুঝতে পেরে, সীতার প্রতি তার ঈর্ষ্যাকাতরতা আর প্রবল প্রতিহিংসার ভাব দেখে কৌতুক বোধ করলেন।
একটু হেসে সীতাকে দেখিয়ে তাকে বললেন, “আমি বিবাহিত। ইনি আমার প্রিয় ভার্যা। এমন সপত্নীর উপস্থিতি তো তুমি সহ্য করতে পারবে না। আমার কনিষ্ঠ ভাই লক্ষ্মণ এখনও অবিবাহিত। সে খুবই সৎ, পরাক্রমশালী, প্রিয়দর্শন। লক্ষ্মণই সব দিক থেকে তোমার যোগ্য পতি হবে। বিশালাক্ষি, তুমি এঁকেই প্রার্থনা করো। আমার মতো কদাকার, বিবাহিত পুরুষ কি তোমার উপযুক্ত হতে পারে?”

রামের বাক্য মনে ধরল রাক্ষসীর। বাক্যের মধ্যে নিহিত পরিহাসের তীক্ষ্ণ ঝলক সে উপলব্ধিও করতে পারল না। সঙ্গে সঙ্গে রামকে পাওয়ার আশা ছেড়ে সে লক্ষ্মণের প্রতি মনোযোগ দিল। লক্ষণকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তুমিই আমার পতি হওয়ার উপযুক্ত। তুমি আমাকে বিবাহ করলে দণ্ডকারণ্যে সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে পারবে।”
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৫: রাক্ষসী মায়ায় ঘনাল কি বিপদের ছায়া

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৯: কুরদার ইকো রিসর্ট—অনাবিস্কৃত এক মুক্তা

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৫: প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নবপ্রজন্ম-মীনমিত্রের পরামর্শে গ্রামগঞ্জেও মাছচাষ বিকল্প আয়ের দিশা দেখাতে পারে

অজানার সন্ধানে, মিথ্যার সঙ্গে আপোষ না করে ছাড়েন চাকরি, দিন কাটে অনাহারে, কে এই ভারতের ফেভিকল ম্যান?

লক্ষ্মণ বুঝতে পেরেছেন রামের কৌতুক। তিনিও পরিহাস করেই বললেন, “আমি হলাম আমার অগ্রজ ভ্রাতার দাসানুদাস। তাঁর কাছে আমি পরাধীন। কিন্তু তুমি হলে স্বাধীন রমণী। তুমি কেন এমন দাসের স্ত্রী হয়ে দাসীবৃত্তি করবে? তার থেকে ভালো হয়, ঐশ্বর্যশালী, বিদ্বান, পূজনীয় আমার এই অগ্রজেরই কনিষ্ঠা ভার্যা হয়ে যাও তুমি। তখন এমনও হতে পারে যে, তিনি তাঁর কদাকার, বৃদ্ধা, দীর্ঘকালের বিবাহিত পত্নীকে পরিত্যাগ করে তোমাকেই পেতে চাইবেন! কোথায় তোমার এই দিব্য সৌন্দর্য আর কোথায় মানুষের সাধারণ রূপ— দুইয়ের মধ্যে কি তুলনা চলে?
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৯: উন্নয়নের কাণ্ডারী নির্ণয়ে পিতৃতান্ত্রিক পক্ষপাতিত্ব

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৪: স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের ‘রাত-ভোর’

ভানুসিংহের পদাবলীর ভাষা এবং বিষয় মাহাত্ম্য

লক্ষ্মণের কথা মনে ধরল শূর্পনখার। এ বিদ্রূপ বাক্যেরও অর্থ ফুটল না তার মনে। এমন পরিহাসকেও সত্য বলে ধরে নিয়ে সে আবার ছুটে গেল রামের কাছে। কামার্ত কণ্ঠে বলে উঠল— “রাম, আমি তোমাকেই পেতে চাই। তুমি চিরকালের জন্য আমার স্বামী হও। সীতার কি প্রয়োজন তোমার জীবনে? কিন্তু তুমি এই কুৎসিত বৃদ্ধা পত্নীকে নিয়ে এতই মগ্ন যে আমাকে গ্রাহ্যই করছ না। তুমি দেখো, আমি এখনই তোমার চোখের সামনে একে খেয়ে ফেলব।” এ কথা বলে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সীতার দিকে উল্কাবেগে ছুটে গেল শূর্পনখা।

রাম বুঝতে পারলেন, ক্রূরপ্রকৃতির এই বনবাসিনী রাক্ষসরমণীর সঙ্গে পরিহাসের ফল কতটা ভয়ংকর হতে পারে। দেখতে পেলেন সীতা প্রায় মূর্ছিত অবস্থায় কোনরকমে বেঁচে আছেন। তিনি পরিস্থিতি সামলানোর জন্য দ্রুত লক্ষ্মণকে নির্দেশ দিলেন। প্রমত্ত শূর্পনখাকে নিরস্ত করতে রামের নির্দেশে লক্ষ্মণ খড়্গের আঘাতে তার নাক-কান ছেদন করলেন।
আরও পড়ুন:

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১২: স্ট্যানলি ম্যাথুজ— একজন কিংবদন্তি, লড়াই আবেগ আর মেহনতী জনতার বন্ধু

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৩৬: গিরিশচন্দ্রের ‘বিষাদ’ নাটকটি প্রথম অভিনীত হয় এমারেল্ড থিয়েটারে

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৯: পাকা আম খাবেন, নাকি কাঁচা আম

প্রচণ্ড আর্তনাদে দশদিক ত্রস্ত করে রক্তাক্ত দেহে শূর্পনখা গভীর বনের ভিতর চলে গেল, যেন বর্ষার ঘনঘোর মেঘগর্জনে কেঁপে উঠল বনরাজি। ব্যর্থ প্রেম, প্রত্যাখ্যাত কাম, আহত দেহ বয়ে নিয়ে সে চলল জনস্থানে। জনস্থানে থাকে তার মহাবলশালী ভাই খর। সঙ্গে থাকে বীরবিক্রম অগণিত রাক্ষস। তাদের কাছে গিয়ে ভয়ে, ক্রোধে, যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন হয়ে আছড়ে পড়ল মাটিতে। দণ্ডকারণ্যে রাম, লক্ষ্মণ, সীতার উপস্থিতির কথা জানিয়ে নিজের আঘাতের কথা সবিস্তারে বলল সে। এ আঘাতের প্রতিশোধ চাই তার। কঠোর প্রতিশোধ।—চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content