ছবি: সংগৃহীত। সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
ভরত যাত্রা করলেন সাগরতুল্য বিপুল সৈন্যবাহিনী আর মায়েদের সঙ্গে নিয়ে। সঙ্গে নানা জীবিকার নানান লোকজন। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তাঁরা এসে পৌঁছলেন গঙ্গাতীরে শৃঙ্গবেরপুরে। নিষাদরাজ গূহ দূর থেকে অনুমান করলেন, এ ভরতেরই বাহিনী। মনে তাঁর আশঙ্কা জাগল, দুর্বুদ্ধি ভরত নিশ্চয়ই রামের সন্ধানে আসছেন তাঁকে হত্যা করবেন বলে। নিষ্কলঙ্ক ভরতের চরিত্র সম্পর্কে মানুষের এই ধারণা কৈকেয়ীর অবদান। সুমন্ত্র পূর্বেই পরিচিত ছিলেন নিষাদপতি গূহর সঙ্গে। তাঁর পরামর্শে ভরত এগিয়ে এলেন নিষাদপতির কাছ থেকে রাম-লক্ষ্মণ-সীতার দণ্ডকারণ্যে বর্তমান অবস্থান জেনে নিতে। বৃদ্ধ রাজা যথোচিত সমাদর করলেন সসৈন্য ভরতের। অনুরোধ জানালেন রাত্রিবাসের জন্য।
কিন্তু রামের সন্ধান দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর দ্বিধাগ্রস্ত ভাব প্রকাশ করেই ফেললেন ভরতের কাছে। বললেন, “রাজপুত্র, আমি নিজে যাব রামের কাছে তোমাকে নিয়ে। কিন্তু তোমার কোনও দুরভিসন্ধি নেই তো? তোমার এই বিপুল সৈন্যবাহিনী তো আমার যথেষ্ট সন্দেহ জাগিয়ে তুলছে।” ভরতের মন ব্যথায় ভরে উঠল। তাকে এমন করে ভুল বুঝেছে সকলেই। রাজ্যসুখলোভী মাতৃচরিত্রের কালিমায় কলঙ্কিত হয়েছে সে। তার অন্তরের কথা না জেনেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে সকলে। কিন্তু এ যন্ত্রণা বুঝতে দিলেন না তিনি গূহকে। তাঁকে আশ্বস্ত করে জানালেন, “রাম আমার অগ্রজ, তাঁকে শ্রদ্ধা করি পিতার মতোই। আমি তাঁকে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছি।” সেকথা শুনে ধন্য ধন্য করে ওঠেন নিষাদপতি। তাঁর মনে হয়, ভরতের মতো জগতে আর কে আছে, যে বিনা চেষ্টায় হাতের মুঠোয় পাওয়া রাজত্ব স্বেচ্ছায় ত্যাগ করতে চায়!
পরদিন পূবের আকাশে রক্তিম আভা দেখা দিল। গূহর নির্দেশে নৌকা নিয়ে যাত্রার প্রস্তুতি নিল নিষাদেরা। বশিষ্ঠ ও অন্যান্য মুনিরা, ভরত, শত্রুঘ্ন এবং রাজমহিষীরা গঙ্গা পার হলেন স্বস্তিক নামক আরামদায়ক সুসজ্জিত নৌকায়। নৌযোগে আরও অন্যান্য লোকজন, যানবাহন, পণ্যসামগ্রী নিয়ে যাওয়া হল পরপারে। সৈন্যরা কেউ নৌকায়, কেউ ভেলায়, কেউবা সাঁতার কেটে পার হল পুণ্যতোয়া গঙ্গা। সূর্যোদয়ের তৃতীয় মুহুর্তে ভরতের বাহিনী প্রয়াগে পৌঁছে গেল। রামের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় ক্রমেই এগিয়ে এল কাছে।
পরদিন পূবের আকাশে রক্তিম আভা দেখা দিল। গূহর নির্দেশে নৌকা নিয়ে যাত্রার প্রস্তুতি নিল নিষাদেরা। বশিষ্ঠ ও অন্যান্য মুনিরা, ভরত, শত্রুঘ্ন এবং রাজমহিষীরা গঙ্গা পার হলেন স্বস্তিক নামক আরামদায়ক সুসজ্জিত নৌকায়। নৌযোগে আরও অন্যান্য লোকজন, যানবাহন, পণ্যসামগ্রী নিয়ে যাওয়া হল পরপারে। সৈন্যরা কেউ নৌকায়, কেউ ভেলায়, কেউবা সাঁতার কেটে পার হল পুণ্যতোয়া গঙ্গা। সূর্যোদয়ের তৃতীয় মুহুর্তে ভরতের বাহিনী প্রয়াগে পৌঁছে গেল। রামের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় ক্রমেই এগিয়ে এল কাছে।
আরও পড়ুন:
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৫: রাজ সিংহাসন কি মন ভোলাল ভরতের?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫২: বইয়ের সব কপি কবির নির্দেশে বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল
কিন্তু রাম-লক্ষ্মণ-সীতা এখন কোথায় যাপন করছেন তাঁদের নিভৃত বনবাসজীবন? সেই যে নিষাদরাজার দেশ ছেড়ে গঙ্গা পার করে তাঁরা প্রয়াগের কাছে গভীর অরণ্যানীর কোলে এসে ঠাঁই নিলেন, তারপর কোথায় কিভাবে কাটছিল তাঁদের অরণ্যচারী দিনগুলি? এর মাঝে ঘটে গেল শোকতপ্ত পিতার মৃত্যু, ভরতের প্রত্যাবর্তন, তাঁর রাজ্য প্রত্যাখান—কত ঘটনাপ্রবাহ বয়ে গেল অযোধ্যার বুকে, কোনও খবরই তাঁদের কাছে পৌঁছল না। তাঁরা প্রথমে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থলে ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে এলেন। মুনিবর তাঁদের পরামর্শ দিলেন, সেখান থেকে দশ ক্রোশ দূরে চিত্রকূট পর্বতের পাদদেশে এক রম্য বনভূমিতে বসবাস করার জন্য। সেই পরামর্শ শিরোধার্য করে তাঁরা যমুনা নদী অতিক্রম করে পৌঁছলেন চিত্রকূট সংলগ্ন সমতলভূমিতে।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের সুন্দর মাছ
মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৫: বালক অষ্টাবক্রের বুদ্ধিবলে পিতা কহোড় পেলেন নবজীবন
বড় সুন্দর সেই বনভূমি। গাছে গাছে ঝুলছে মৌমাছির মধুভরা চাক। শীতের শেষে তখন সেখানে কর্ণিকার, পলাশের দীপ্ত শিখায়, মহুয়ার মত্ত সুবাসে, মঞ্জরিত আমের বনে বসন্তের আগমনী বার্তা। কোকিলের কুহুতানে মুখর সে বনভূমি। সেখানে বয়ে চলেছে মন্দাকিনীর স্নিগ্ধ, শীতল জলধারা। পর্বতের গা বেয়ে নেমে আসছে আরও কত ঝর্ণা-প্রস্রবণ। লতাগুল্মের চাঁদোয়ার নীচে আয়েশ করে বিশ্রাম নিচ্ছে হরিণের দল। সেই ফুলে ফলে ভরা বনভূমি পশু পাখিদের নিশ্চিন্ত আশ্রয়, তপোব্রতী মুনিদেরও আবাস স্থল। হিংস্র শ্বাপদ সেখানে নেই বললেই চলে। রামের নির্দেশে লক্ষ্মণ তৈরি করে ফেললেন, পাতায় ছাওয়া সুন্দর এক কুটির। কৃষ্ণমৃগ বধ করে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে হল শাস্ত্রসম্মত হোম, যজ্ঞকর্ম। এই নির্জন নিরুপদ্রব অরণ্যভূমিতে লোকচক্ষুর আড়ালে নিভৃত এক সুখী জীবন কাটাতে শুরু করলেন তাঁরা তিনজন। ভুলে রইলেন নির্বাসনের দুঃখ, রাজ্যসুখ থেকে বঞ্চিত হওয়ার বেদনা। দিনের পরে কেটে গেল দিন স্বচ্ছতোয়া মন্দাকিনীর মতো শান্তপ্রবাহে।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৪: মন তোর শক্তিই ‘মন্ত্রশক্তি’
ডায়েট ফটাফট: ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়েছে? কোন কোন খাবারে বশে থাকে এই সমস্যা? জেনে নিন কী খাবেন, কী নয়
তারপর গঙ্গার ওপার থেকে ভরতকে পথ দেখিয়ে নিষাদপতি গূহ এলেন ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে। সেনাবাহিনীকে কিছু দূরে বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিয়ে কুলগুরু বশিষ্ঠকে পুরোভাগে রেখে নিরস্ত্র, বিনীতবেশে ভরত প্রবেশ করলেন মুনির আশ্রমে। যথোচিত আতিথেয়তায় সমাদর করলেন মুনি তাঁদের। কিন্তু তাঁর মনেও জেগে উঠল ভরতের প্রতি বিরূপ ভাবনা, রামের অনিষ্ট আশঙ্কা। ভূয়োদর্শী মুনিবর, তাঁর মনেও ভরত সম্পর্কে এ সন্দেহ! ভরতের বড় কষ্ট হল নিজের জন্য। মনে হল, এমন অপবাদের কালিমা মাথায় নিয়ে বাঁচার চেয়ে বোধ হয় মরণও ভালো। “আমার মা যা করেছেন, যা ভেবেছেন, তা তো আমার আকাঙ্ক্ষিত ছিল না কোনওদিন। আমি রামকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই। দয়া করে তিনি কোথায় আছেন, সে কথা খুলে বলুন।” —ভরতের কাতর স্বীকারোক্তিতে প্রসন্ন হলেন মুনি। সসৈন্য ভরতদের জন্য তিনি আতিথেয়তার বিপুল আয়োজন করলেন। সে আতিথেয়তা পেয়ে শেষে এমন পরিস্থিতি হল যে, পানভোজনে মত্ত সৈন্যরা আর অযোধ্যায়ও ফিরতে চাইল না, দণ্ডকারণ্যের গভীরেও যেতে চাইল না।
আরও পড়ুন:
ছোটদের যত্নে: সদ্যোজাতকে স্তন্যপান করানোর সময় কোন কোন বিষয় মাথায় রাখবেন? রইল শিশু বিশেষজ্ঞের মতামত
স্বাদে-গন্ধে: একঘেয়ে চিকেন কারি আর ভালো লাগছে না? বাড়িতেই রেস্তোরাঁর মতো বানিয়ে ফেলুন মুর্গ মালাই হান্ডি
পরদিন সকালে ভরদ্বাজের কাছে বিদায় নিতে এলেন ভরত। তিনি সন্ধান দিলেন রামের বর্তমান বাসভূমি চিত্রকূটের। মায়ের প্রতি ভরতের ক্ষোভ প্রশমিত করে ভূয়োদর্শী মুনি বললেন, “মায়ের দোষ দিও না ভরত। রামের নির্বাসনের ফলে দেবতা, ঋষি ও দানবদের মঙ্গল হবে।”
সৈন্যসামন্ত নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন ভরত। আড়াই যোজন পথ। বেশ কিছুটা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে চিত্রকূট পর্বতের অস্পষ্ট রেখা। তার নীচে নীল মেঘের মত বন। চলতে চলতে তাঁদের চোখে পড়ল বনের মধ্যে এক জায়গায় ধোঁয়া উঠছে। ওইখানেই নিশ্চয়ই রামের পর্ণকুটির! আবিষ্কারের আনন্দে খুশি হয়ে উঠলেন তাঁরা। সুমন্ত্র ও ধৃতি, এই দুই অমাত্যকে সঙ্গে নিয়ে ভরত এগিয়ে চললেন ধোঁয়ার উৎসের দিকে। তাঁর মনে গভীর প্রত্যয়, তিনি এখানেই রামের সন্ধান পাবেন।—চলবে
সৈন্যসামন্ত নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন ভরত। আড়াই যোজন পথ। বেশ কিছুটা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে চিত্রকূট পর্বতের অস্পষ্ট রেখা। তার নীচে নীল মেঘের মত বন। চলতে চলতে তাঁদের চোখে পড়ল বনের মধ্যে এক জায়গায় ধোঁয়া উঠছে। ওইখানেই নিশ্চয়ই রামের পর্ণকুটির! আবিষ্কারের আনন্দে খুশি হয়ে উঠলেন তাঁরা। সুমন্ত্র ও ধৃতি, এই দুই অমাত্যকে সঙ্গে নিয়ে ভরত এগিয়ে চললেন ধোঁয়ার উৎসের দিকে। তাঁর মনে গভীর প্রত্যয়, তিনি এখানেই রামের সন্ধান পাবেন।—চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।