মিথিলার পথে চলেছেন বিশ্বামিত্র ঋষি, চলেছেন রাম, লক্ষ্মণ আর সিদ্ধাশ্রমের মুনিরা। পার হয়ে এলেন তাঁরা শোণ নদ, এলেন ত্রিপথগামিনী গঙ্গার তীরে। সেখানে রাত্রিবাস। সেই পতিতপাবনী নদীর পাশে বসে তাঁরা শুনলেন জলধারার কলকল্লোল। তার মধ্যেই যেন অস্ফুট বার্তায় ধ্বনিত তার উৎসকথা, মর্ত্যলোকে আগমনের ইতিবৃত্ত। বিশ্বামিত্রের কাছে বসে মুগ্ধ হয়ে শুনলেন সকলে সেই পুণ্যকথা। পরদিন দিনের আলোয় গঙ্গা পার হয়ে পৌঁছলেন তাঁরা নদীর উত্তরতীরে। সেখানে অবস্থিত বিশাল রাজার পুরী, বৈশালী। যেমন তার নাম, তেমনই তার বৈভব। দীর্ঘপথ অতিক্রম করে অবশেষে মিথিলার কাছেই চলে এসেছেন তাঁরা। বৈশালী নগরীতে রাত্রিবাস করে পরদিন মিথিলাপতি জনক রাজার সঙ্গে হবে তাঁদের সাক্ষাৎকার।
কথায় কথায় বিশ্বামিত্র জানালেন, রাজর্ষি ইক্ষ্বাকুর পুত্র ছিলেন রাজা বিশাল। তিনিই এই স্বর্গ তুল্য সুরম্য পুরী স্থাপন করেছিলেন গঙ্গাতটে। সেখানে তখন সিংহাসনে তাঁরই উত্তরপুরুষ প্রমতি। বিশ্বামিত্রের আগমন সংবাদ শুনে ভারি খুশি হলেন রাজা। তাঁর আতিথেয়তায় তৃপ্ত হল সকলের মন। সে নগরীতে রাত্রি হল ভোর। কত জনপদ, নদী, অরণ্য পার হয়ে দীর্ঘ পথযাত্রার সমাপ্তি এবার। গন্তব্য সমাগত। চলতে চলতে দূর থেকেই দেখা যায়, দিব্য সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ পুরী মিথিলা, রাজা জনক যার অধীশ্বর। ঋষিদের মন হয়ে ওঠে পরিতৃপ্ত। অন্তর থেকে উঠে আসে সাধুবাদ। চলতে চলতে হঠাৎ চোখে পড়ে এক মুনিজনপরিত্যক্ত, নির্জন আশ্রম।
দেখে মনে হয়, অতীতে কোন এক সময় সমৃদ্ধ, শ্রীমণ্ডিত আশ্রম ছিল এটি। অযত্নলালিত বড় বড় গাছের ছায়ায় এখন ঢাকা পড়েছে তার শ্রী, বেড়ে উঠেছে আগাছার দল। যেন বেদনায় ভরা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে আছে আশ্রমের আকাশে বাতাসে। আশ্রমটির নির্জনতা উৎসুক করে তোলে রামকে। প্রশ্ন করেন তিনি বিশ্বামিত্রকে, “এ আশ্রম কার? কেন তার এমন শ্রীহীন, পরিতক্ত অবস্থা?” অসামান্য কথক বিশ্বামিত্র। তাঁর জানার পরিধি অগাধ, অতলান্ত। তিনি আরম্ভ করলেন এক নিদারুণ ইতিবৃত্ত, এক নারীজীবনের অভিশপ্ত বেদনাগাথা। বিশ্বামিত্র জানেন এ উপাখ্যান জানতে হবে রামকে। দীর্ঘকাল ধরে এ আশ্রম তাঁরই পদধূলির প্রতীক্ষায়।
এ আশ্রমে একসময়ে ছিল পুষ্পপত্রশোভিত বৃক্ষরাজি। শান্তরসাস্পদ তপোবনের কল্যাণী মূর্তিটি শ্রান্ত পথিকজনের ক্লান্তি দূর করত। এ ছিল মহাতপা মহর্ষি গৌতমের আশ্রম। তাঁর পত্নী অহল্যার সঙ্গে দীর্ঘদিন এই আশ্রমে তপস্যায় মগ্ন ছিলেন তিনি। অহল্যা তরুণী, দিব্যরূপ তাঁর। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর রূপে মুগ্ধ, তাঁর প্রতি কামনাসক্ত। একদিন গৌতম আশ্রমে উপস্থিত ছিলেন না। এমন সময়ে এলেন সেখানে ইন্দ্র, কামার্ত্ত তাঁর মন, তিনি ধারণ করেছেন গৌতমের ছদ্মবেশ। তিনি অহল্যার কাছে এসে কামনা করলেন তাঁকে, চাইলেন তাঁর সঙ্গ। বিশ্বামিত্র বলছেন, অহল্যা বুঝতে পেরেছিলেন, ইনি গৌতম নন, স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র! সুরাধিপতির সঙ্গলিপ্সা? এই কৌতূহল বশে অহল্যা দিলেন সম্মতি। দমন করতে পারলেন না নিজের প্রবৃত্তিকে। কামজর্জর ইন্দ্রের মনোবাসনা চরিতার্থ হল। সঙ্গলাভে তৃপ্ত ইন্দ্রকে অহল্যা এবার শীঘ্রই আশ্রম ছেড়ে চলে যেতে বললেন। তিনি জানতেন, গৌতম চলে এলে অনর্থ ঘটবে। অহল্যা অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলছেন, “সুরশ্রেষ্ঠ, আপনার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছে, আপনি এবার অলক্ষিতে এই স্থান পরিত্যাগ করুন। নিজেকে এবং আমাকে সব দিক থেকে আপনি রক্ষা করুন”। মহর্ষি গৌতমের থেকেই নিজেদের রক্ষার কথা ভেবেছিলেন নিশ্চয়ই অহল্যা। দেবরাজ ইন্দ্রের মনে তখন বিজয়ের তৃপ্তি।
কথায় কথায় বিশ্বামিত্র জানালেন, রাজর্ষি ইক্ষ্বাকুর পুত্র ছিলেন রাজা বিশাল। তিনিই এই স্বর্গ তুল্য সুরম্য পুরী স্থাপন করেছিলেন গঙ্গাতটে। সেখানে তখন সিংহাসনে তাঁরই উত্তরপুরুষ প্রমতি। বিশ্বামিত্রের আগমন সংবাদ শুনে ভারি খুশি হলেন রাজা। তাঁর আতিথেয়তায় তৃপ্ত হল সকলের মন। সে নগরীতে রাত্রি হল ভোর। কত জনপদ, নদী, অরণ্য পার হয়ে দীর্ঘ পথযাত্রার সমাপ্তি এবার। গন্তব্য সমাগত। চলতে চলতে দূর থেকেই দেখা যায়, দিব্য সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ পুরী মিথিলা, রাজা জনক যার অধীশ্বর। ঋষিদের মন হয়ে ওঠে পরিতৃপ্ত। অন্তর থেকে উঠে আসে সাধুবাদ। চলতে চলতে হঠাৎ চোখে পড়ে এক মুনিজনপরিত্যক্ত, নির্জন আশ্রম।
দেখে মনে হয়, অতীতে কোন এক সময় সমৃদ্ধ, শ্রীমণ্ডিত আশ্রম ছিল এটি। অযত্নলালিত বড় বড় গাছের ছায়ায় এখন ঢাকা পড়েছে তার শ্রী, বেড়ে উঠেছে আগাছার দল। যেন বেদনায় ভরা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে আছে আশ্রমের আকাশে বাতাসে। আশ্রমটির নির্জনতা উৎসুক করে তোলে রামকে। প্রশ্ন করেন তিনি বিশ্বামিত্রকে, “এ আশ্রম কার? কেন তার এমন শ্রীহীন, পরিতক্ত অবস্থা?” অসামান্য কথক বিশ্বামিত্র। তাঁর জানার পরিধি অগাধ, অতলান্ত। তিনি আরম্ভ করলেন এক নিদারুণ ইতিবৃত্ত, এক নারীজীবনের অভিশপ্ত বেদনাগাথা। বিশ্বামিত্র জানেন এ উপাখ্যান জানতে হবে রামকে। দীর্ঘকাল ধরে এ আশ্রম তাঁরই পদধূলির প্রতীক্ষায়।
এ আশ্রমে একসময়ে ছিল পুষ্পপত্রশোভিত বৃক্ষরাজি। শান্তরসাস্পদ তপোবনের কল্যাণী মূর্তিটি শ্রান্ত পথিকজনের ক্লান্তি দূর করত। এ ছিল মহাতপা মহর্ষি গৌতমের আশ্রম। তাঁর পত্নী অহল্যার সঙ্গে দীর্ঘদিন এই আশ্রমে তপস্যায় মগ্ন ছিলেন তিনি। অহল্যা তরুণী, দিব্যরূপ তাঁর। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর রূপে মুগ্ধ, তাঁর প্রতি কামনাসক্ত। একদিন গৌতম আশ্রমে উপস্থিত ছিলেন না। এমন সময়ে এলেন সেখানে ইন্দ্র, কামার্ত্ত তাঁর মন, তিনি ধারণ করেছেন গৌতমের ছদ্মবেশ। তিনি অহল্যার কাছে এসে কামনা করলেন তাঁকে, চাইলেন তাঁর সঙ্গ। বিশ্বামিত্র বলছেন, অহল্যা বুঝতে পেরেছিলেন, ইনি গৌতম নন, স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র! সুরাধিপতির সঙ্গলিপ্সা? এই কৌতূহল বশে অহল্যা দিলেন সম্মতি। দমন করতে পারলেন না নিজের প্রবৃত্তিকে। কামজর্জর ইন্দ্রের মনোবাসনা চরিতার্থ হল। সঙ্গলাভে তৃপ্ত ইন্দ্রকে অহল্যা এবার শীঘ্রই আশ্রম ছেড়ে চলে যেতে বললেন। তিনি জানতেন, গৌতম চলে এলে অনর্থ ঘটবে। অহল্যা অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলছেন, “সুরশ্রেষ্ঠ, আপনার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছে, আপনি এবার অলক্ষিতে এই স্থান পরিত্যাগ করুন। নিজেকে এবং আমাকে সব দিক থেকে আপনি রক্ষা করুন”। মহর্ষি গৌতমের থেকেই নিজেদের রক্ষার কথা ভেবেছিলেন নিশ্চয়ই অহল্যা। দেবরাজ ইন্দ্রের মনে তখন বিজয়ের তৃপ্তি।
কিন্তু অহল্যাকে রক্ষার ভার তিনি নিতে পারবেন কি? হাসতে হাসতে তিনি অহল্যাকে বললেন, “আমি পরিতুষ্ট, তৃপ্ত। আমি এখনই আশ্রম ছেড়ে চলে যাচ্ছি, আমাকে ক্ষমা করো।” আশ্রমের কুটির থেকে এই বলে বেরিয়ে ইন্দ্র দেখলেন আশ্রমের দিকে আসছেন মহর্ষি গৌতম। তপস্যার তেজ যেন অগ্নিশিখার মতো দীপ্ত তাঁর সদ্য স্নাত শরীর জুড়ে। হাতে তাঁর যজ্ঞের কুশ, সমিধ। মহর্ষিকে দেখে ইন্দ্রের মনে শঙ্কা জাগল, ভয়ে শুকিয়ে গেল মুখ। পলায়নপর মুনিবেশধারী ইন্দ্রকে দেখে তপোধন ঋষি বুঝতে পারলেন সব। ক্রোধে অভিশাপ দিলেন তাঁকে। সে অভিশাপে সেই মুহূর্তেই পুরুষত্ব হারালেন ইন্দ্র, হলেন নপুংসক।
অহল্যাও দগ্ধ হল নিদারুণ অভিশাপের আগুনে। ঋষি অভিশাপ দিলেন তাঁকে, “এই আশ্রমে সুদীর্ঘ কাল ধরে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপে দগ্ধ হবে তুমি। সমস্ত লোকচক্ষুর অগোচরে, অদৃশ্য হয়ে, অনাহারে, ভস্মশয্যায় বায়ুভুক হয়ে বেঁচে থাকবে তুমি। যেদিন দশরথপুত্র রাম এসে দেখা দেবেন তোমাকে, এ আশ্রমে পড়বে তাঁর পায়ের ধূলো, সেদিন শাপমুক্ত হবে। মনের সব কলুষতা মুছে তপঃশুদ্ধা, পাপমুক্তা হবে সেদিন তুমি। আতিথ্য সমাদরে আপ্যায়ন কোরও সেদিন রামকে। আর তারপর আমার কাছে আবার ফিরে এসো হৃষ্টমনে।” এই বলে আশ্রম ছেড়ে চলে গেলেন ঋষি হিমালয়ের দুর্গম শিখরে, আবার মগ্ন হলেন কঠোর তপস্যায়।
ইন্দ্র চলে গেলেন দেবলোকে। দেবতাদের বোঝালেন তিনি, উগ্রতপা মহর্ষি গৌতমের ক্রোধ উৎপাদন করিয়ে তাঁর তপস্যার বিঘ্ন ঘটাতে চেয়েছিলেন তিনি। তিনি তা করেছিলেন দেবতাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য। কারণ, ক্রোধের ফলে তপস্যার তেজ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে তাঁর দেহবিকৃতি ঘটেছে। এবার ঋষি, চারণ, দেবতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে পুনরায় পুরুষত্ব লাভের চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। অহল্যার কথা কি তাঁর মনে রইল? কি হল গৌতমপত্নী, সুন্দরীশ্রেষ্ঠা, অভিশপ্তা অহল্যার?
আদিকবি বাল্মীকি পরম মমতায়, অতল করুণায় ছবি এঁকেছেন এই অভিশপ্তা নারীর। সেই জনহীন আশ্রমে তিনি রামের প্রতীক্ষায় তপোমগ্না। মানুষী রূপ নয় তাঁর, ছিল তাঁর দিব্যকান্তি, স্বর্গীয় লাবণ্য। বিধাতা অশেষ যত্নে গড়েছিলেন তাঁকে। তিনি আজ অনাহারক্লিষ্ট শীর্ণতনু। মানুষ শুধু নয়, দেবতারাও দেখতে পাননা তাঁকে। তিনি যেন তপস্যার উজ্জ্বল কান্তিময়ী মূর্তি, যেন হিমকুয়াশায় ঢাকা, মেঘের আড়ালে থাকা পূর্ণ চন্দ্রপ্রভা কিংবা জলের মধ্যে প্রতিবিম্বিত সূর্যকিরণ, অধরা তাঁর কান্তি। এ যেন জ্যোর্তিময় অগ্নিপ্রভা ঢাকা পড়েছে ধূমের জালে। কত কত কাল এভাবেই কেটে গিয়েছে জগৎসংসারের সমস্ত দৃষ্টির অগোচরে। এতকাল পরে সেখানে আজ এসেছেন দাশরথি রাম, তাঁর মুক্তির দিশারী হয়ে। অহল্যার প্রতীক্ষার অবসান হল তবে।
অহল্যাও দগ্ধ হল নিদারুণ অভিশাপের আগুনে। ঋষি অভিশাপ দিলেন তাঁকে, “এই আশ্রমে সুদীর্ঘ কাল ধরে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপে দগ্ধ হবে তুমি। সমস্ত লোকচক্ষুর অগোচরে, অদৃশ্য হয়ে, অনাহারে, ভস্মশয্যায় বায়ুভুক হয়ে বেঁচে থাকবে তুমি। যেদিন দশরথপুত্র রাম এসে দেখা দেবেন তোমাকে, এ আশ্রমে পড়বে তাঁর পায়ের ধূলো, সেদিন শাপমুক্ত হবে। মনের সব কলুষতা মুছে তপঃশুদ্ধা, পাপমুক্তা হবে সেদিন তুমি। আতিথ্য সমাদরে আপ্যায়ন কোরও সেদিন রামকে। আর তারপর আমার কাছে আবার ফিরে এসো হৃষ্টমনে।” এই বলে আশ্রম ছেড়ে চলে গেলেন ঋষি হিমালয়ের দুর্গম শিখরে, আবার মগ্ন হলেন কঠোর তপস্যায়।
ইন্দ্র চলে গেলেন দেবলোকে। দেবতাদের বোঝালেন তিনি, উগ্রতপা মহর্ষি গৌতমের ক্রোধ উৎপাদন করিয়ে তাঁর তপস্যার বিঘ্ন ঘটাতে চেয়েছিলেন তিনি। তিনি তা করেছিলেন দেবতাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য। কারণ, ক্রোধের ফলে তপস্যার তেজ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে তাঁর দেহবিকৃতি ঘটেছে। এবার ঋষি, চারণ, দেবতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে পুনরায় পুরুষত্ব লাভের চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। অহল্যার কথা কি তাঁর মনে রইল? কি হল গৌতমপত্নী, সুন্দরীশ্রেষ্ঠা, অভিশপ্তা অহল্যার?
আদিকবি বাল্মীকি পরম মমতায়, অতল করুণায় ছবি এঁকেছেন এই অভিশপ্তা নারীর। সেই জনহীন আশ্রমে তিনি রামের প্রতীক্ষায় তপোমগ্না। মানুষী রূপ নয় তাঁর, ছিল তাঁর দিব্যকান্তি, স্বর্গীয় লাবণ্য। বিধাতা অশেষ যত্নে গড়েছিলেন তাঁকে। তিনি আজ অনাহারক্লিষ্ট শীর্ণতনু। মানুষ শুধু নয়, দেবতারাও দেখতে পাননা তাঁকে। তিনি যেন তপস্যার উজ্জ্বল কান্তিময়ী মূর্তি, যেন হিমকুয়াশায় ঢাকা, মেঘের আড়ালে থাকা পূর্ণ চন্দ্রপ্রভা কিংবা জলের মধ্যে প্রতিবিম্বিত সূর্যকিরণ, অধরা তাঁর কান্তি। এ যেন জ্যোর্তিময় অগ্নিপ্রভা ঢাকা পড়েছে ধূমের জালে। কত কত কাল এভাবেই কেটে গিয়েছে জগৎসংসারের সমস্ত দৃষ্টির অগোচরে। এতকাল পরে সেখানে আজ এসেছেন দাশরথি রাম, তাঁর মুক্তির দিশারী হয়ে। অহল্যার প্রতীক্ষার অবসান হল তবে।
বিশ্বামিত্রের কথায় সে আশ্রমে প্রবেশ করলেন রাম। দেখতে পেলেন বিশুদ্ধ অগ্নিশিখার মতো তপশ্চারিণী অহল্যাকে। তাঁকে দেখে রাম, লক্ষ্মণ প্রণত হলেন। দীর্ঘ অভিশাপের ভার থেকে মুক্ত হলেন অহল্যা। অহল্যা স্মরণ করলেন গৌতমের বাক্য। আশ্রমিক আতিথেয়তায় আপ্যায়ণ করলেন তাঁদের। বেজে উঠল দুন্দুভি, দেববাদ্য যত। স্বর্গলোক হতে ঝরে পড়ল পুষ্পরাশি। দেবতারা উচ্ছ্বসিত ‘সাধু’শব্দে শ্রদ্ধা জানালেন অহল্যাকে। মহর্ষি গৌতম তপোবলে জানতে পারলেন আশ্রমে রামের আগমন সংবাদ। এলেন তিনি। পুনর্মিলন হল গৌতম-অহল্যার। যথাবিধি আতিথেয়তার পর রাম-লক্ষ্মণ বিশ্বামিত্রের সঙ্গে আবার যাত্রা করলেন মিথিলার অভিমুখে। মিথিলায় রাজপুরোহিত শতানন্দ গৌতম-অহল্যার পুত্র। তিনি শুনবেন মায়ের মুক্তির সংবাদ বিশ্বামিত্রের কাছে। আনন্দে ভরে উঠবে মায়ের কষ্টে ভারাক্রান্ত পুত্রের মন। সে কাহিনীর অপেক্ষায় রইলাম আমরা।
ইন্দ্র-অহল্যা-গৌতমের প্রাচীন উপাখ্যানের বীজ নিহিত বৈদিক সাহিত্যে। শতপথ ব্রাহ্মণ কিংবা তৈত্তিরীয় আরণ্যকে ইন্দ্রের পরিচয় পাওয়া যায়, অহল্যার উপপতিরূপে। আর এ গল্পের পরিপুষ্টি রামায়ণে, মহাভারতে, ব্রহ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ, স্কন্দপুরাণ প্রভৃতিতে। দীর্ঘ পথ যাত্রায় এ কাহিনীর বিবর্তনও ঘটেছে বেশ কিছু। রামায়ণের আদিকাণ্ডের এ কাহিনীতে অহল্যাকে ‘দুর্মেধা’ বলেছেন বিশ্বামিত্র। ইন্দ্রের সান্নিধ্যে সাময়িক স্খলন যদি তাঁর ঘটেও থাকে, পরবর্তী জীবনে তপস্যার আগুনে দগ্ধ করে নিজেকে গড়ে তুলেছেন তিনি হিরণ্ময়ী রূপে। তাই আজও হয়ে রয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়া পঞ্চকন্যার অন্যতমা।
রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে অহল্যাবৃত্তান্ত আবার উঠে এসেছে। সেখানে কিছুটা ভিন্নরূপে রয়েছে এ কাহিনী। সে কাহিনীতে, ব্রহ্মার কন্যা ছিলেন অহল্যা। ইন্দ্র সেখানে অহল্যাকে নিজের পরিচয় দেননি। গৌতমের অনুপস্থিতিতে তাঁর রূপ ধরে এসে তিনি প্রতারিত করেছিলেন অহল্যাকে। তার শাস্তিও পেয়েছিলেন তিনি। গৌতম অভিশাপ দিয়েছিলেন, এই পাপকর্মের ফলে শত্রুর হাতে বন্দী হতে হবে দেবরাজকে। ইন্দ্রপদ কখনো স্থায়ী হবে না। আর মনুষ্যলোকেও এই পাপকর্ম প্রবর্তিত হবে। সে পাপের অর্ধেক দায়ভার ইন্দ্রের। মহাভারতেও অহল্যা ইন্দ্রধর্ষিতা, নির্দোষ। বহু পুরাণে, অধ্যাত্মরামায়ণেও এ বার্তাই প্রকাশিত।—চলবে
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
ইন্দ্র-অহল্যা-গৌতমের প্রাচীন উপাখ্যানের বীজ নিহিত বৈদিক সাহিত্যে। শতপথ ব্রাহ্মণ কিংবা তৈত্তিরীয় আরণ্যকে ইন্দ্রের পরিচয় পাওয়া যায়, অহল্যার উপপতিরূপে। আর এ গল্পের পরিপুষ্টি রামায়ণে, মহাভারতে, ব্রহ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ, স্কন্দপুরাণ প্রভৃতিতে। দীর্ঘ পথ যাত্রায় এ কাহিনীর বিবর্তনও ঘটেছে বেশ কিছু। রামায়ণের আদিকাণ্ডের এ কাহিনীতে অহল্যাকে ‘দুর্মেধা’ বলেছেন বিশ্বামিত্র। ইন্দ্রের সান্নিধ্যে সাময়িক স্খলন যদি তাঁর ঘটেও থাকে, পরবর্তী জীবনে তপস্যার আগুনে দগ্ধ করে নিজেকে গড়ে তুলেছেন তিনি হিরণ্ময়ী রূপে। তাই আজও হয়ে রয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়া পঞ্চকন্যার অন্যতমা।
রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে অহল্যাবৃত্তান্ত আবার উঠে এসেছে। সেখানে কিছুটা ভিন্নরূপে রয়েছে এ কাহিনী। সে কাহিনীতে, ব্রহ্মার কন্যা ছিলেন অহল্যা। ইন্দ্র সেখানে অহল্যাকে নিজের পরিচয় দেননি। গৌতমের অনুপস্থিতিতে তাঁর রূপ ধরে এসে তিনি প্রতারিত করেছিলেন অহল্যাকে। তার শাস্তিও পেয়েছিলেন তিনি। গৌতম অভিশাপ দিয়েছিলেন, এই পাপকর্মের ফলে শত্রুর হাতে বন্দী হতে হবে দেবরাজকে। ইন্দ্রপদ কখনো স্থায়ী হবে না। আর মনুষ্যলোকেও এই পাপকর্ম প্রবর্তিত হবে। সে পাপের অর্ধেক দায়ভার ইন্দ্রের। মহাভারতেও অহল্যা ইন্দ্রধর্ষিতা, নির্দোষ। বহু পুরাণে, অধ্যাত্মরামায়ণেও এ বার্তাই প্রকাশিত।—চলবে
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
*শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।