সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি সংগৃহীত।

চিত্রকূট থেকে বিদায় নিয়ে অযোধ্যায় ফিরে এলেন ভরত। ভারাক্রান্ত মনে নগরে প্রবেশ করলেন। এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে বেড়াল, পেঁচার দল। জনশূন্য রাজপথ। বন্ধ সব গৃহের দ্বার। যেন এক অভিশপ্ত রাত্রির বিষণ্ণ নীরবতা নগর জুড়ে। নিষ্প্রভ, শোকাহত অযোধ্যার সব গৌরব, সব জৌলুস যেন হারিয়ে গিয়েছে। এমন রাজপুরীতে ভরতের দমবন্ধ হয়ে এল। কি করে থাকবেন তিনি এই রামবিহীন রাজপুরীতে? কী করে রাজ্যের দায়িত্বভার পালন করবেন রামের প্রতিনিধিরূপে? এখানে তাঁর মন বসবে কী করে? মায়েদের রাজপ্রাসাদে রেখে স্থির করলেন ভরত, নন্দিগ্রামে থাকবেন তিনি। সেখানেই অপেক্ষা করবেন রামের জন্য। চোদ্দ বছর পর অগ্রজ ফিরে এলে তাঁকে রাজ্যভার সমর্পণ করে তবে শান্তি পাবেন তিনি।
বশিষ্ঠ ও অন্যান্য গুরুজনদের সম্মতি নিয়ে, শত্রুঘ্নের সঙ্গে ভরত যাত্রা করলেন নন্দিগ্রামে। পরম শ্রদ্ধাভরে মাথায় বয়ে নিয়ে চললেন রামের পাদুকা। সঙ্গ নিলেন বশিষ্ঠ, মন্ত্রিগণ, অসংখ্য সৈন্য, অনাহুত পুরবাসী সব। তাঁরা কেউই বিষণ্ণ, শোকমলিন অযোধ্যায় আর থাকতে চাইলেন না। নন্দিগ্রামে পৌঁছে ভরত প্রজাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “এই রাজ্য রাম আমাকে ন্যাস হিসেবে দিয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে নিয়ে আসা হিরণ্ময় পাদুকা দুখানি তাঁর প্রতিনিধি। তিনি ফিরে না আসা পর্যন্ত তাঁর হয়েই এই রাজ্য পালন করব আমি। ফিরে এলে তাঁর দু’ পায়ে পরিয়ে দেব এই পাদুকা। ফিরিয়ে দেব অযোধ্যা, ফিরিয়ে দেব সমগ্র রাজ্যভার। তবেই আমার পাপমুক্তি।” মুনির বেশ ধারণ করলেন ভরত। পরণে তাঁর বল্কল, মাথায় জটা। সমস্ত রাজসুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে রাজ্যাভিষেক করে সিংহাসনে বসালেন পাদুকা দুটি। মাথার ওপরে ধরলেন রাজছত্র। ভ্রাতৃবৎসল ভাই ভরত। আশ্চর্য ভক্তিভরে, ঐকান্তিক শ্রদ্ধায়, বিনম্র ভালবাসায়, কঠোর কৃচ্ছসাধনে কাটিয়ে দিলেন তিনি দীর্ঘ চোদ্দটি বছর।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৮: ভরত কি ফিরবে শূন্য হাতে?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-২: রামকথার পটভূমি এবং মহাভারতে কথকের কথাসূত্র

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৬: প্রাণী জগতের অন্যতম দায়িত্বশীল বাবা হল ড্রাগন ফিশ

এদিকে চিত্রকূটে রাম লক্ষ্মণ সীতার কীভাবে কাটছে দিন? ভরত ফিরে যাওয়ার পর রাম একদিন লক্ষ্য করলেন, চিত্রকূটের তপোবনবাসী তপস্বীদের মধ্যে একটা ভীত, সন্ত্রস্ত ভাব। রামের মুখের দিকে তাকিয়ে কেউ কেউ শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। নিজেদের মধ্যে ভয়ে ভয়ে নিচু গলায় কথা বলেন। কী কারণে তপস্বীদের ভয় আর ঔৎসুক্যের কারণ হয়ে উঠেছেন তিনি? তাঁদের উপস্থিতি কী তপস্যায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে? — প্রশ্ন জাগল রামের মনে। তপোবনবাসীদের কুলপতির কাছে গিয়ে করজোড়ে এমন শঙ্কার কারণ জানতে চাইলেন রাম। বৃদ্ধ কুলপতি আশ্বস্ত করলেন রামকে। তাঁরা বিরক্ত করেননি তপস্বীদের। বিশেষত সীতার সেবাপরায়ণতার তুলনা নেই। কিন্তু ভয় ও উদ্বেগের কারণ অবশ্যই আছে। জরাগ্রস্ত তপস্বী কাঁপতে কাঁপতে বলতে লাগলেন, “রাক্ষসরাজ রাবণের এক ভাই খর এখানে বাস করে। সে জনস্থানে বসবাসকারী তপস্বীদের বড় অত্যাচার করছে। তোমার উপরেও তার নজর। তুমি যেদিন থেকে এখানে বাস করতে এসেছো, সেদিন থেকে সে মুনিদের অত্যাচার শুরু করেছে। সে ও তার সঙ্গীরা নানারকম অশুচি জিনিসপত্র ছুঁড়ে দেয় আমাদের গায়ে, দুর্বল তপস্বীদের ভয় দেখায়। আশ্রমগুলিতে ঢুকে যজ্ঞের সামগ্রী নষ্ট করে আনন্দ পায়, যজ্ঞের আগুনে কোথা থেকে এসে জল ঢেলে দিয়ে চলে যায়। এসমস্ত কারণে আমরা স্থির করেছি, এখান থেকে অন্যত্র চলে যাব। অল্প দূরেই ফলমূলে ভরা একটি প্রাচীন আশ্রম রয়েছে। সেখানেই সকলে যাব। রাম, তুমি তো সস্ত্রীক এখানে থাকো। যদিও তুমি অত্যন্ত পরাক্রমী বীর, তবুও আমার মনে হয়, তোমাদেরও সেখানে যাওয়া উচিত।”
আরও পড়ুন:

হেলদি ডায়েট: বেশি কলা খাওয়ার অভ্যাস কি স্বাস্থ্যকর? মারাত্মক কোনও রোগের কারণ হয়ে উঠবে না তো?

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: আমবাতের সমস্যায় ভুগছেন? ভালো থাকবেন এই ঘরোয়া উপায়গুলি মেনে চললে

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২: ‘আও টুইস্ট করে’ গানের জন্য পঞ্চমের সঙ্গে শচীনকর্তার বাক্যালাপও বন্ধ ছিল বেশ কিছুদিন

কুলপতির সঙ্গে তপস্বীরা চলে গেলেন। তাঁদের বিদায় দিয়ে রাম কুটীরে ফিরে এলেন। মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল কুলপতির কথাগুলি। চিত্রকূটে তাঁরও আর মন বসছে না। ভরত মায়েদের নিয়ে দেখা করে ফিরে যাওয়ার পরে এ জায়গাতে থাকা যেন দুঃসহ বেদনা বোধ জাগিয়ে তুলছে অহরহ। তাঁদের স্মৃতি ভারাক্রান্ত করছে মনকে। আর ভরতের বিপুল সৈন্যবাহিনীর আগমনে, সৈন্যদলের হাতি ঘোড়ার মলমূত্রে দূষিতও হয়েছে জায়গাটি। ফলে এখান থেকে চলে যেতেই মন চাইল রামের। বৈদেহী আর লক্ষ্মণকে ডেকে তিনি জানালেন নিজের ভাবনা। তাঁরা স্থির করলেন, অত্রিমুনির আশ্রমে যাবেন।

অত্রিমুনির আশ্রমে পৌঁছতেই আন্তরিক আতিথেয়তা আর স্নেহে মন ভরে গেল তাঁদের। বৃদ্ধ মুনি নিজে এগিয়ে এসে তাঁদের সমাদর করে নিয়ে গেলেন আশ্রমে। মুনিপত্নী অনসূয়া বয়সের ভারে ন্যুব্জা, শ্বেতশুভ্র কেশরাশি, বলিরেখা তাঁর দেহ জুড়ে। তিনি ধর্মচারিণী তপস্বিনী। অত্রিমুনি নিজ পত্নীর সম্পর্কে রামকে বললেন, “দশ বছর ধরে অনাবৃষ্টি হয়েছিল এখানে। সেসময় নিজের তপস্যার বলে ফলমূল সৃষ্টি করে অনাহারে মৃতপ্রায় জীবজগতের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন ইনি। জাহ্নবীকে প্রবাহিত করে দগ্ধ, তৃষিত ধরণীকে তৃপ্ত করেছিলেন। ফলে সম্ভব হয়েছিল ঋষিদের তপঃসাধনা। ইনি জীবপালনী, দয়াময়ী, অনসূয়া, তোমাদের মায়ের মতো।” সীতাকে কাছে টেনে নিলেন অনসূয়া। সীতার কথায়, ব্যবহারে বড় তুষ্ট হলেন তিনি। স্নেহভরে সীতাকে দিলেন দিব্য বরমালা, দিলেন বস্ত্র, অলঙ্কার, অঙ্গরাগ, মহার্ঘ গন্ধানুলেপন। দিব্য আভরণে সুসজ্জিতা সীতা যেন হয়ে উঠলেন রূপবতী দেবকন্যা। আদরে, উপদেশে সেখানে কেটে গেল একটি রাত।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১০: স্থাপত্য ছাড়িয়ে অভয়ারণ্য

দশভুজা: সেই ষোলো মিনিটের দূরত্ব কোনওদিন পূরণ হয়নি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৫: কালাদেওর কিস্‌সা

পরদিন বিদায়কাল উপস্থিত। দণ্ডকারণ্যে যাবেন এবার তাঁরা। যাত্রাকালে ঋষিরা বললেন, “রাঘব, এই অরণ্যে নানা হিংস্র জীবজন্তু রয়েছে, রক্তপিপাসু মাংসাশী, নরখাদক রাক্ষসও রয়েছে নানা শ্রেণির। তপস্বীরা নির্বিঘ্নে তপস্যা করতে পারেন না এখানে। বারবার বিঘ্ন ঘটে তাঁদের সাধনায়। তুমি এই মহারণ্যবাসী তপস্বীদের রক্ষা করো।” দুর্গম গভীর অরণ্যদেশে পায়ে চলার পথ দেখিয়ে দিলেন তাঁরা।

ঋষিদের ফলমূল সংগ্রহ করতে যাওয়ার পথ ধরে রাম, লক্ষ্মণ, সীতা এবার প্রবেশ করলেন দণ্ডকারণ্যের ভয়াল, গভীর প্রদেশে। সূর্য যেমন করে মেঘমণ্ডলে প্রবেশ করে, আঁধার ঘনিয়ে আসে, তেমনি করেই তাঁরা চললেন সেই গভীর, নিবিড় অরণ্যানীর অজানা পথরেখা ধরে। এমন নীরন্ধ্র, ছায়াঘন বনভূমি, যে দিনের আলো সে পথে প্রবেশ করতে ভয় পায়। পদে পদে সেখানে জড়িয়ে আছে বাধা, মৃত্যুভয়, অজানা আতঙ্ক। আবার রয়েছে তপস্বীদের শান্ত, রম্য, ফুলে ফলে পশু পাখিতে পূর্ণ তপোবনও। নরখাদক রাক্ষসের হুংকার আর ঋষিকণ্ঠের ওঙ্কার – দুইই সেখানে সুলভ। প্রশ্ন জাগে, এ কি গহন বন, নাকি গহন মন? আদিকবিই জানেন তার পরিচয়।—চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content