বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব।

আত্মা ত্বং গিরিজামতিঃ সহচরাঃ প্রাণাঃ শরীরং গৃহং পূজাতে বিষয়োপভোগরচনা নিদ্রা সমাধিস্থিতিঃ। সংচারঃ পদয়োঃ প্রদক্ষিণবিধিঃ স্তোত্রাণি সর্বা গিরো যদ্ যৎ কর্ম করোমি তত্তদখিলং শম্ভো তবারাধনম্।। (শিবমানস পূজা: ৪)

হে শিব! তুমি আমার আত্মা জগৎমাতা আমার মন আমার প্রাণগুলি তোমার প্রহরী ও শরীর তোমার আওয়াজ, সব ইন্দ্রিয় সংযোগ তোমার পুজো রঙ্গ আমার নিদ্রা তোমাকে সমাধি মগ্ন হয়ে থাকা আমি যেখানেই যাই তোমাকেই প্রদক্ষিণ করা হয়। যেসব কথা বলি সবই তোমার স্তুতি যে সব কাজে আমি নিযুক্ত থাকি হে প্রভু সে সবই তোমার পুজো।

এমন সুন্দর ভাব, ভক্তের উৎসর্গে পরিস্ফুট হয়েছে যে, কর্ম, জ্ঞান, যোগ, একসঙ্গে মিলিত হয়ে ভক্তির সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা; আত্মসমর্পণ ও শরণাগতিতে পর্যবেশিত। সর্বভাবয়ং বিষ্ণু। বিষ্ণুময়ং জগৎ। বিরল ভক্তের ভাব বিহ্বলতা তাকে যে পর্যায়ে নিয়ে যায়, যে ব্যবহারিক বৈষম্যতা নষ্ট হয়ে তার ভগবানকে সর্বত্র দর্শনে আর সর্বাধিক আনন্দ প্রার্থীতে তার প্রকৃত সার্থকতা যিনি প্রকৃত ভক্তি লাভ করেন তিনি দ্বেষ করতে পারেন না। তিনি তাঁর রাম বা কৃষ্ণকে একমাত্র মহান বলেন না, পরন্তু প্রত্যেকেই যে তাঁর গোবিন্দের রূপ, তাঁর সন্দর্শনে তিনি মোহিত হয়ে যান।
শরণাগতির ভাব তাঁকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে, ভগবান বিনা ভক্ত, ভক্ত বিনা ভগবান থাকতে পারেন না। ভক্তি শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ, ‘নারদীয় ভক্তি সূত্র’, যেখানে ভক্তির উচ্চতমস্থানের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “প্রেমে কোমল নরম হয়ে যায়। প্রেমে কৃষ্ণ ত্রিভঙ্গ হয়েছেন। প্রেম হলে সচিদানন্দকে বাঁধবার দড়ি পাওয়া যায়। যাই দেখতে চাইবে দড়ি ধরে টানলেই হয়। যখন ডাকবে তখন পাবে।” এ দড়ি এত কোমল যে লাগে না, আবার এত শক্ত যে ছিঁড়ে না।

শ্রীরামকৃষ্ণ আর-ও বলছেন, “ভক্তি পাকলে ভাব। ভাব হলে সচ্চিদানন্দকে ভেবে অবাক হয়ে যায়। জীবের এই পর্যন্ত। আবার ভাব পাকলে মহাভাব প্রেম। যেমন কাঁচা আম আর পাকা আম।”

কলিতে নারদীয় ভক্তি। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “শুদ্ধা ভক্তি সার আর সব মিথ্যা। …নারদ স্তব করাতে রাম বললেন, তুমি বর লও। নারদ বললেন, শুদ্ধা ভক্তি। আর বললেন রাম যেন তোমার জগৎ মোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই। রাম বললেন, ও তো হল। আর কিছু বর লও। নারদ বললেন, আর কিছু চাই না। কেবল ভক্তি।”
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৬৩: কল্যাণসাধনই গুরুর একমাত্র লক্ষ্য

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে ম্যানগ্রোভ

যখন ভক্তিই পথ আর ভক্তিই যখন প্রাপ্তব্য হয়ে যায়। ভক্তির অমৃতত্ত্ব এখানে যে পৃথকত্ব লোপ হয়। “ভক্তের জ্ঞান যেন চাঁদের আলো। ভিতর বার দেখা যায়। কিন্তু অনেক দূরের জিনিস, কি খুব ছোট জিনিস দেখা যায় না। অবতারাদির জ্ঞান যেন সূর্যের আলো। ভিতরবার ছোট-বড় তাঁরা সব দেখতে পান।”

সংসারে জীবন নানা জিনিস নিয়ে থাকে। ঈশ্বরের সঙ্গে জগতের অন্য সকল বিষয়ের উপর টান থাকে। নির্ভরশীলতা ভগবানের উপর থাকলেও দ্বন্দ্বও থেকে ভগবান তাকে রক্ষা করেন কিনা। বিশ্বাস বৈরাগ্য পুরোপুরি থাকে না।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “সংসারী জীবের মন, ঘোলা জল হয়ে আছে বটে, কিন্তু নির্মলি ফেললে আবার পরিষ্কার হতে পারে। বিবেক বৈরাগ্য নির্মলি।” কিন্তু এই জীবজগৎ যে সে বিরাট ঈশ্বরের ছায়া। তিনি এ জগত করে তার মধ্যেই প্রবেশ করলেন। তিনিই প্রকাশিত হলেন ভিন্ন ভিন্ন রূপে নামে।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “ব্রহ্ম-জীবজগৎ বিশিষ্ট। প্রথম নেতি নেতি করবার সময় জীবজগৎকে ছেড়ে দিতে হয়। অহং বুদ্ধি যতক্ষণ, ততক্ষণ তিনি সব হয়েছেন, এই বোধ হয়—তিনিই চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন।” “বেলের সার বলতে গেলে শাঁসই বুঝায়। তখন বিচি আর খোলা ফেলে দিতে হয়। কিন্তু বেলটা কত ওজন ছিল বলতে গেলে শুধু শাঁস ওজন করলে হবে না। ওজনের সময় শাঁস, বিচি, খোলা সব নিতে হবে। যারই শাঁস, তারই বিচি, তারই খোলা। যাঁরাই নিত্য, তাঁরই লীলা। তাই আমি নিত্য, লীলা সবই লই। মায়া বলে জগৎ সংসার উড়িয়ে দেই না। তাহলে যে ওজন কম পড়বে।”
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৬: সুখের লাগিয়া

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৭: সাধারণের প্রতি পাণ্ডবদের কৃতজ্ঞতার প্রকাশ কোন মহাভারতীয় শিক্ষা?

নিত্য ধরে ধরে লীলা আবার লীলা ধরে নিত্য। স্বামীজির ভাষাই সে রূপ পরিগ্রহ করেছে বাস্তবিক অর্থে। তিনিই নিখিলবিশ্বে বিরাট ঈশ্বরের সর্বোচ্চ প্রকাশ প্রত্যক্ষ করছেন। তাঁর ঈশ্বর সর্বত্র, প্রতি কোণে কোণে বিরাজমান। তিনি বলছেন, “একমাত্র নিখিল জীবাত্মার সমষ্টি রূপে যে ভগবান বিদ্যবান এবং একমাত্র যে ভগবানে আমি বিশ্বাসী, সেই ভগবানের পুজোর জন্য যেন আমি বারবার জন্মগ্রহণ করি। সহস্র যন্ত্রণা ভোগ করি। আর সর্বোপরি আমার উপাস্য পাপী নারায়ণ, তাপী নারায়ণ, সর্ব জাতির সর্বশ্রেণির দরিদ্র নারায়ণ। এরাই বিশেষভাবে আরাধ্য।।” ভাবে ভক্তিতে ভক্তের মধ্যে পার্থক্য শূন্যতা। সর্বত্র প্রকাশিত তিনি ভিন্ন আর কিছু নেই। —চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content