শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও গিরিশচন্দ্র ঘোষ।

আধ্যাত্মিক জীবন গঠনের মূল বিষয় বা নিয়মগুলির যে কয়েকটি আমাদের সাধারণ জীবনযাপনকে নিয়ন্ত্রিত করে তার মধ্যে একটি হল—সত্যের ধারণা ও পালন। যা কিছুকেই মানুষ সত্য বলে গ্রহণ করে। তাই তার সমগ্র সত্তা, চিন্তারাশি, অনুভূতি এবং তার আকাঙ্ক্ষাকে আকর্ষণ করে।
প্রথমে যদি এই জগতকে সত্য বলে মনে করে, তবে সমগ্র সত্তা জগতের প্রতি আকর্ষিত হয়। আর যদি ঈশ্বরকে সত্য বলে মনে করে, তবে ঈশ্বর ময় হয়ে ওঠে। সত্য কী? বিষয়ের মূল অনুসন্ধান করা। ভৌতিক জগতের সত্য প্রত্যেকের নিজেদের সম্বন্ধে ধারণার উপরই নির্ভর করে। বিচার কী? সৎ বস্তুর ধারণা। শিশুর কাছে যে পুতুল সত্য, ও তার সজীব সত্তা আছে; কিন্তু এ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে যায় জ্ঞান ও বোধের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। জগতের প্রতি মানুষের সত্যতা ততটাই, যতটা সে জ্ঞান বা বোধে সত্য বলে স্বীকার করে।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৩: বীরবিক্রম ত্রিপুরায় শিক্ষা সম্প্রসারণে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৫: রবীন্দ্রনাথ ভয় পেতেন মহর্ষিদেবকে

আমাদের অস্তিত্বের প্রমাণ কী? আমরা চিন্তা করি, আমরা অনুভূতি করি জগতের অস্তিত্ব। যতক্ষণ ‘আমি’ বোধ সঙ্গে আছে ততক্ষণ আমি ও জগতের অস্তিত্ব আছে। এই ‘আমি’র ভৌত জগত ও অন্তর জগতের তার বিস্তার আছে। সদা পরিবর্তনশীল চিন্তারাশিগুলি বিস্তার লাভ করে রেখেছে আমাদের সত্তাকে। কিন্তু অপরিবর্তনীয় আত্মা তত্ত্ব যা সর্বদা অনুভব করে এই পরিবর্তনগুলিকে। সে সাক্ষী ‘আমি’। সে নিশ্চয়ই মন নয়, বুদ্ধি নয়, আত্মা-চেতনা। এই আত্মচেতনা আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের বা ব্যক্তিত্বের মূল ভিত্তি।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৬: যদি হই চোরকাঁটা

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮১: সুন্দরবনের পাখি—বেনে বউ

উদীয়মান ও বিলীয়মান নানা চিন্তা নিয়ে মন গঠিত। কিন্তু যা চরম ও অনন্ত তা হল আত্মা, সর্বদা পরিবর্তনীয় বিষয় সকলের মধ্যে অপরিবর্তনীয়। মানুষ অনন্তকাল থাকতে চায়। তা আত্মার অনন্তের প্রকাশ। যা কিছু জাগতিক শুভ, আনন্দদায়ক, শান্তিময় তা অনন্ত আত্মার বিচ্ছিন্ন প্রকাশ মাত্র। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে অপরিবর্তনীয় মূল সত্তার লাভে আগ্রহী হব। শ্রীমৎ স্বামী রঙ্গনাথানন্দজি মহারাজ বলতেন—”are you growing spiritually? can you love others? can you feel oneness with others ? Have you peace with in yourself and do you radiate it around you? That is called spiritual growth which is stimulated by meditation inwardly and by work done in a spirit of service outwardly.”
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৫: বিরোধিতায় নয়, মৈত্রীবন্ধনেই রয়েছে পারিবারিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানসূত্র

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৯: টাকা-পয়সা থাকলে চোর-ডাকাতকেও লোকে সম্মান দেখায়

বিপথগামী গিরিশচন্দ্র কীভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ পুতসঙ্গে পবিত্র হতে পারে; আধ্যাত্মিকতার স্পর্শে দেবত্বে উন্নত হওয়ার জ্বলন্ত উদাহরণ। ঠাকুরের অত্যাধিক স্নেহ, অশেষ কৃপা, আর সুমধুর প্রশ্রয় তার ক্লেদার্থ জীবনের পরিবর্তন করে। আধ্যাত্মিক জীবন গঠনে শ্রীরামকৃষ্ণ মলয় বাতাস গিরিশ কুবালয় কে চন্দনে পরিণত করে। অতঃপর গিরিশচন্দ্রের সুমধুর বাক্য হপরবর্তীকালে অসংখ্য গৃহীভক্ত, সাধু সবাইকে মোহিত করেছে। গিরিশচন্দ্র বলতেন, যেখানে আগে তিনি বসতেন সেখানে মাটি অশুদ্ধ হয়ে যেত; কিন্তু অবতার শ্রীরামকৃষ্ণকে তিনি স্পর্শ করেছেন, তার বিশ্বাস অত গভীর ও তর্কের পারে যে তিনি বলতেন, এখন পবিত্রতা বিলাতে পারেন তিনি। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে থেকে গিরিশের পরিবর্তন হল যে নিরন্তর উপস্থিতি অনুভব করতেন।
আরও পড়ুন:

শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১১: কাঁটার মুকুট

গিরিশচন্দ্রের শ্রীরামকৃষ্ণের স্তব করে বলছেন, ভগবন,পবিত্রতা আমায় দাও , যাতে কখনো একটু পাপ চিন্তা না হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ, “তুমি পবিত্র তো আছো। তোমার যে বিশ্বাস ভক্তি।” (কথামৃত পৃঃ ১০৮৭) স্বামীজি ভক্তিযোগে বলছেন, অবতারগণ স্পর্শ করে লোকের চৈতন্য সম্পাদন করেন। তাঁদের স্পর্শে যারা দুরাচার তারা পরম সাধু হয়ে যান। “অপি চেৎ সুদুরাচরো ভজতে মামনন্যভাক্। সাধুরেব স মন্তব্যঃ সম্যক্ ব্যবসিতো হি সঃ।।” ঈশ্বরই অবতার রূপে আমাদের কাছে আসেন যদি আমরা ঈশ্বর দর্শন করতে চাই তাহলে অবতার পুরুষের মধ্যেই তাঁকে দর্শন করব, তাঁদেরকে আমরা পুজো না করে থাকতে পারি না।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content