রামকৃষ্ণদেব।
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতে অনেক জায়গাতেই “কলিতে নারদীয় ভক্তি-এই বিধান” এই বিষয়ে বলেছেন। কিন্তু নারদীয় ভক্তির স্বরূপ কী প্রকার বা প্রকাশ কেমন? গোপনারীর প্রসঙ্গ টেনে বলছেন, “প্রথমে ভক্তি, ভক্তি পাকলে ভাব এবং ভাবের চেয়ে উচ্চ মহাভাব আর প্রেম।” কিন্তু জীবনের বাস্তবিকতা সে বৈরাগ্য এবং ঈশ্বরের প্রতি ব্যাকুলতা আসে না। শাস্ত্রীয় উক্তির সঙ্গে বাস্তবিক জীবনে সামঞ্জস্য বিধান স্বাভাবিকভাবেই হয় না। এর কারণ অনেকগুলি হতে পারে। যেমন: মানুষের কর্ম সংস্কার ও বিষয়ের প্রতি ভোগ ইচ্ছা। হতে পারে সমস্যার গভীরতা অনুভূত হয় না। জগতের বিষয়ের থেকে যে সুখ অনুভব করি তা যথেষ্ট। যখন সুখ-দুঃখের বেড়াজালে নাজেহাল অবস্থা হয়, তখন জগতের আনন্দ অন্বেষণে রত হয়।
এ জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, পিঠের আকার এক রকম, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন পুর অর্থাৎ বাইরের খোলটি মানুষের একরকম হলেও অন্তরের যে কামনা, বাসনা অথবা তার সংস্কারের বিকাশ ভিন্ন ভিন্ন। সে কারণে তাদের ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। জগতে কামনাহীন কর্ম করা ও নির্বাসনালাভ করা কঠিন। কর্ম এবং শুভাশুভ ফল মানুষকে জন্ম চক্রে বারবার আবর্তিত করে।
এ জন্য শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, পিঠের আকার এক রকম, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন পুর অর্থাৎ বাইরের খোলটি মানুষের একরকম হলেও অন্তরের যে কামনা, বাসনা অথবা তার সংস্কারের বিকাশ ভিন্ন ভিন্ন। সে কারণে তাদের ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। জগতে কামনাহীন কর্ম করা ও নির্বাসনালাভ করা কঠিন। কর্ম এবং শুভাশুভ ফল মানুষকে জন্ম চক্রে বারবার আবর্তিত করে।
যখন মানুষ নিজেদের সম্বন্ধে ধারণার পরিবর্তন করে, যখন সে ধারণা দেবত্বের দিকে এগোতে থাকে তখনই আধ্যাত্মিক জীবন শুরু হয়। যেমন শৈশবে একটি পুতুলের প্রতি যা দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবর্তন হতে থাকে। তেমনি বাইরের জগৎ সম্বন্ধে, নিজের শরীর ও মনের সম্বন্ধেও একই ভাবে বিচার করা যেতে পারে। শরীর ও মনকে বাল্যকালে যেমন ভাবে ও রূপে দেখি কেমন বড় হয়ে সেইরূপ দেখি বা ভাবি না। উন্নত হয়। প্রত্যেকে উন্নতিকে অগ্রাধিকার দেয়। উন্নতি মানে জীবনের; জীবন শৈলির নয়।
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৭৮: ব্রহ্ম ও মায়া মূলত এক ও অভেদ
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০২: দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি
অনেকে অর্থ সম্পদের প্রাচুর্যকে, ভোগ বিলাসকে উন্নত মনে করে। মনের বিকাশ মানে, মনকে যা খুশি ভাবতে দেওয়া নয়। পরন্তু, তাকে নিয়ন্ত্রণ করে দূষণমুক্ত করা। বাসনা, চাহিদা ও প্রয়োজনের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা। অনন্ত আকাশ পড়ে রয়েছে পাখি চাইলেই যতদূর ইচ্ছা যেতে পারে বা অনন্তের দিকে এগোতে পারে। কিন্তু সে পারে না, যায় না। তারও সীমা আছে। কোথাও তাকে থামতে হয়, ফিরে আসতে হয়। তেমন জীবন ও মনের ক্ষেত্রেও এক। জীবনের বিকাশ পানে শারীরিক, মানসিক, বৌদ্ধিক ও আত্মিক উন্নতি। শুধু লাগাম ছাড়া মনের বাসনাগুলি পূরণ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া নয়।
আরও পড়ুন:
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৮: সুন্দরবনের পাখি—শামুকখোল
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৫: ‘ছেলেদের জন্য আমার কোনও নিয়মকানুন থাকে না’
মনের গতির পরিবর্তন করে বৌদ্ধিক ও আর্থিক উন্নতি সাধন করা। সর্বোপরি বাইরের জগতের অনুভূতি যখন ঈশ্বরীয় অনুভূতির সঙ্গে এক হয়ে যাবে তখন প্রকৃত আধ্যাত্মিক হয়ে উঠব। মন ও বুদ্ধির অসচ্ছতা আমাদের সরে যাবে। শৈশবের পুতুলের ধারণার পরিবর্তন হবে। তখন আধ্যাত্মিক শরীর, মন ও বোধ তৈরি হয়। সমগ্র চেতনার উদ্বোধন হয়।
নরেন্দ্র মাস্টারকে একদিন বলছেন, ‘আমি তো কিছুই মানতাম না, জানেন।’
মাস্টার: কী রূপ-টুপ?
নরেন্দ্র: তিনি যা যা বলতেন প্রথম প্রথম অনেক কথাই মানতাম না। একদিন তিনি (ঠাকুর) বললেন, “তবে আসিস কেন?” আমি (নরেন্দ্র) বললাম—
“আপনাকে দেখতে আসি, কথা শুনতে নয়।”
মাস্টার: তিনি কী বললেন?
নরেন্দ্র: ‘তিনি খুব খুশি হলেন।’ (কথামৃত পৃঃ ১১৩৭)
নরেন্দ্র মাস্টারকে একদিন বলছেন, ‘আমি তো কিছুই মানতাম না, জানেন।’
মাস্টার: কী রূপ-টুপ?
নরেন্দ্র: তিনি যা যা বলতেন প্রথম প্রথম অনেক কথাই মানতাম না। একদিন তিনি (ঠাকুর) বললেন, “তবে আসিস কেন?” আমি (নরেন্দ্র) বললাম—
“আপনাকে দেখতে আসি, কথা শুনতে নয়।”
মাস্টার: তিনি কী বললেন?
নরেন্দ্র: ‘তিনি খুব খুশি হলেন।’ (কথামৃত পৃঃ ১১৩৭)
আরও পড়ুন:
গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৯: আসছে আমার পাগলা ঘোড়া
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৩: কালাদেওর কবলে
নারদীয় ভক্তির স্বরূপ এই রকম। কামনাহীন প্রেম। শুধু নিজেকে উৎসর্গ করা। অপরের প্রীতির জন্যই কর্ম করা। “শ্রদ্ধা ভক্তিই সার আর সব মিথ্যা। নারদ স্তব করাতে রাম বললেন, তুমি বর লও। নারদ চাইলেন শুদ্ধাভক্তি। আর বললেন, রাম যেন তোমার জগৎ মোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই। রাম বললেন, ও তো হল, আর কিছু বল লও। নারদ বললেন, আর কিছু চাই না, কেবল ভক্তি।” (কথামৃত পৃঃ ৫০৬-৫০৭)
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪১: রবীন্দ্রনাথ ও ব্রজেন্দ্র কিশোর
নারদীয় ভক্তির প্রকাশ হল ভক্তি প্রার্থনার মধ্যেই নিজেকে কৃত-কৃতার্থ অনুভব করা। ঈশ্বরীয় সুখে লীন হয়ে যাওয়া। এগোপিনীদের দুঃখ প্রকাশ না চির সুখের অনুভব!
“সখি সে বন কত দূর?
যেখানে আমার শ্যামসুন্দর!
আর চলিতে যে নারি!”
—চলবে।
যেখানে আমার শ্যামসুন্দর!
আর চলিতে যে নারি!”
—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।