রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও সারাদা মা।

ভগবানের কাছে ভক্তের আর্তির শেষ থাকে না। ভক্তের প্রকারভেদ থাকতে পারে। শ্রীমদ্ভগবত গীতায় উল্লেখ আছে, ভক্ত চার প্রকারের—ঈশ্বরের সেবা পূজা করেন, আর্ত, অর্থার্থী, জিজ্ঞাসু এবং জ্ঞানী। এরা সকলে প্রভুর সন্তান কিন্তু জ্ঞানীই তাঁর সব থেকে প্রিয়। অথবা উত্তম, মধ্যম, অধম বা ভক্তির সত্ত্ব, রজ, তম আরও বিভিন্ন ভাবে দেখা যায়। প্রকৃত ভক্ত সর্ব ভূতে নারায়ণ দেখে, সকলের সঙ্গে সেই রূপ ব্যবহার করে। ভক্তের হৃদয়ের সেই ভগবানের বৈঠকখানা। ভগবান নিত্য বিরাজ করেন। ভক্তেরা বলে, এ জগৎ, তাঁর ঐশ্বর্য। তিনি সর্বত্র সকলের মধ্যেই আবার প্রকাশ পাচ্ছেন। ভগবানকে হৃদয়ে ধারণ করে সেই রূপ ভক্ত ধন্য হয়ে যায়। আর কোনও কিছু প্রাপ্তির ইচ্ছে থাকে না।
তেমনই ভগবান এবং সেই রূপ ভক্তের জন্য নিরন্তর চিন্তা করেন। তেমনই কী হতে পারে ভগবান যিনি শরীর ধারণ করেন, ভক্তের প্রতি করুণায় তিনি কি ভক্ত ছাড়া থাকতে পারেন! এ তো অনন্য, যে ভগবান করুণায় ভক্ত প্রবর হয়ে ওঠেন। ভক্তের সঙ্গে কর্ম করেন, আবার দুঃখে বা আনন্দের সাথী হন। শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্য, শ্রী রামকৃষ্ণ…।

প্রতি অবতারে এইরূপ নিদর্শন দেখি। মানুষ রূপ ধারণ করে ঠিক ঠিক মানুষ হয়ে ওঠেন। মানুষ রূপে নাঙ্গল চালান, গরু পালন করেন, বেড়া বাঁধেন, ঝুড়ি মাথায় নিয়ে যান…আরও কত কী!
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৭৫: শুদ্ধা-ভক্তিতে কামনা-বাসনা থাকবে না: শ্রীরামকৃষ্ণদেব

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— দুধি লতা ও পঞ্চরতি লতা

“তুমি স্ত্রী, তুমি পুরুষ, তুমি কুমার, তুমি কুমারী, তুমি যষ্টি হাতে কম্পমান বৃদ্ধ মানব, সত্যই তুমি নানা রূপে প্রকাশিত হও” (শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ৪/৩)।

ঈশ্বর এবং এই সৃষ্ট জীবের সম্পর্ক কী? যদি তিনি নিরপেক্ষ না হন তা হলে, অবিদ্যা, অজ্ঞান অন্ধকারে নিমজ্জিত জীবের সঙ্গে পার্থক্য নেই। যদি তিনি জগতে পরিব্যপ্ত হয়ে থাকেন, তা হলে সৃষ্টি সকলের মধ্যেও আছেন। জীবের কষ্ট তাঁরই কষ্ট। প্রকৃত ভক্ত সে কারণেই অন্যকে পীড়িত করে না। অহংকার অজ্ঞানতা-ই জীবের জীবত্ব।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৭: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে/২

হিরণ্যকষিপু যতই হরি নিন্দা এবং পুত্র প্রহ্লাদকে নির্যাতন করেন না কেন, কিন্তু ভক্ত প্রহ্লাদ কর জোড়ে প্রার্থনা করছেন, পিতাকে সুমতি দেওয়ার জন্য, আর অন্যদিকে ক্ষণকালের জন্যও তিনি প্রভুর নাম ত্যাগ করেননি, তাঁর হৃদয়ের আত্মা সর্বদা প্রভুতে অন্তলীন।

স্বামী যতীশ্বরানন্দ মহারাজ লিখেছেন, অনেক মানুষ আছেন, যারা ঈশ্বরকে মোটেই গ্রাহ্য করেন না। জীবনভোগ এবং ইন্দ্রিয়ের ভোগের প্রতীক্ষায় ব্যাকুল। আবার কেউ আছে, সংসারী যাঁরা ঈশ্বর সম্বন্ধে ভাবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঈশ্বরকে অভীষ্ট সিদ্ধির কর্তা রূপে দেখে। পার্থিব ভোগ সমগ্রী যিনি দানও করেন। প্রচণ্ড ভোগলালসাও জীবনে থাকে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: প্রতিমাদেবী— এক দুঃখবতীর কথা

আবার কেউ কতটা সংসারী, কতটা আধ্যাত্মিক। ঈশ্বর উপাসনা করলেও সংসারে সংসার ভোগে আসক্ত। দুর্ভোগকেও ভোগ মনে করতে চেষ্টা করে। যদিও সেই সঙ্গে দুঃখ অনুভব করে। আবার কিছু জন আছেন যাঁরা, বাস্তব সচেতন মানুষ। ঈশ্বরের কথা না ভেবে অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা করেন এবং জীবনে সুখ দুঃখকে অবসম্ভাবী বলে ধরে নেয়। আর কিছু মানুষ আছেন, আধ্যাত্মিক মনোভাবাপণ্য।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৩: রাজনীতিতে উন্নতির জন্য নিন্দা বা প্রশংসা ব্যক্তিগত পরিসরে করাই শ্রেয়, সভায় নয়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

জীবনের সুখ-দুঃখ উভয়কে শান্তভাবে নিজের ভালো-মন্দ কাজের ফল বলে মনে করে। ও নিজে যতটা সম্ভব ভালোভাবে জীবনযাপন করার চেষ্টা করে। অপর কেউ কেউ, সব ঈশ্বরের দান মনে করে যথাসম্ভব অনাসক্ত এবং সন্তুষ্ট থাকতে চেষ্টা করে। অন্য কেউ কেউ সুখ-দুঃখকে সংসারের অবিচ্ছেদ কর্মফল অনুযায়ী পুরস্কার হিসেবে গ্রহণ করে। হতে পারে আরও চেষ্টা করে অনাসক্ত, পবিত্র, আধ্যাত্মিক সাধন পুষ্ট, কর্তব্য পরায় নিষ্কাম সেবাময় জীবনযাপন করে আর সাংসারিক ভালো-মন্দের পারে ঈশ্বরীয় ভাব উপলব্ধি করার জন্য চেষ্টা করে। সাংসারিক সুখে যেমন সাংসারিক দুঃখে তেমন সমভাবে থেকে উচ্চ জীবনযাপন জন্য চেষ্টা করে।

ভগবানের প্রীতিকর কার্য যাঁরা করে, তাঁরা অধিক বুদ্ধিমান এবং আনন্দময় জীবনের অধিকারী হন। ঈশ্বর যেমন জীব ছাড়া থাকেন না তেমন ভক্তও ভগবান ছাড়া থাকে না। সে অনুভব করে পৃথিবীময় সুখ, অল্পে সুখ নাই।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content