বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব।

ভক্তিই সার। প্রকৃতির অন্তর্গত সাধন পথে ভক্তি, শরনাগত ও নিজেকে উৎসর্গ করার মাধ্যমে ভক্ত খুঁজে পায় পরমসুখ। জ্ঞান ও যোগ অধিকারী সাপেক্ষ। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “জ্ঞানীরা দেখে সব স্বপ্নবৎ। ভক্তেরা সব অবস্থায় লয়, …উত্তম ভক্ত নিত্য লীলা দুই লয়।” (কথামৃত পৃঃ ৬৯২) ব্রহ্ম নিত্য সত্য। কিন্তু মন শুদ্ধ ব্রহ্মে মন রাখা সম্ভব নয়। মন এই প্রকৃতির মধ্যে ঈশ্বরের লীলা সম্ভোগ করে। সমাধি থেকে মন নেমে এলে তাকে সম্ভোগ করতে পায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ প্রেমাভক্তি, রাগভক্তি জ্ঞান র তাৎপর্য সকল সুনির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করেছেন। উত্তম ভক্ত চিনি খেতে চায়, চিনি হতে চায় না। নিষ্ঠার পর ভক্তি। ভক্তি পাকলে ভাব হয়, ভাব ঘনীভূত হলে মহাভাব হয়। সর্ব শেষে প্রেম। …প্রেম হলে ভক্তের কাছে ঈশ্বর বাধা পড়েন আর পালাতে পারেন না। “জ্ঞানযোগ কী? যে পথ দিয়ে স্বরূপকে জানা যায় ব্রহ্মই আমার স্বরূপ এই বোধ।” (কথামৃত পৃঃ ৭১৫)

ভক্তিতে ভগবানের সামীপ্য চাই ভক্ত। তাঁর সঙ্গে ভক্তিরস আস্বাদন করে কৃত-কৃত্য হয়ে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় , ভক্তির আমিতে অহংকার হয় না, অজ্ঞান করে না। অহংকার বন্ধনের কারণ কিন্তু এ অহং কার? এ তো ঈশ্বরের। তাই মুক্ত করে, ঈশ্বর লাভ করিয়ে দেয়। এ ‘আমি’ আমির মধ্যে নয়।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৭৪: সত্য এক ও অদ্বিতীয়

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৩: টলস্টয় ও সোফিয়া—সে কি কেবলই যাতনাময়…/৩

বিষয়ের বিষয়ের উপর টান, সতীর পতির প্রতি টান, আর মায়ের সন্তানের উপর টান। কেউ যদি এই তিন টান এক করে ভগবানে দিতে পারে তাহলে তৎক্ষণাৎ সাক্ষাৎকার হয়। এখন ঠাকুর এই তিন টান এক করার কথা বলেছেন। যে সকল বন্ধন আমাদের সংসার চক্রে বার বার আবর্তিত করায়, সেই টানকে মোড় ফিরিয়ে ঈশ্বরে সর্মপণ করার কথা বলছেন। যে মোহ-পাশ আমাদের বন্ধনের কারণ হয়, তা ঈশ্বরে অর্পণ করলে ওহিক বন্ধন থেকে ক্ষনিকেই মুক্তি পাইয়ে দেয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “ভক্তির মানে কি না, কায়মনো বাক্য তার ভজনা করা। কায়, অর্থাৎ, হাতের দ্বারা তার পুজো ও সেবা। পায়ে তার স্থানে যাওয়া। কানে তাঁর ভাগবত, নামগুণ-কীর্তন শোনা। চোখে তাহার বিগ্রহ দর্শন। মন অর্থাৎ সর্বদা তার ধ্যান চিন্তা করা। বাক্য অর্থাৎ তার নামগুণ-কীর্তন এইসব করা।”
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৫: সঙ্গীত অনুরাগিণী মা সারদা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— বাবুর ও বন জুঁই

যে বাক্য মনের অতীত অথচ তাঁকে সহজ ভাবে কায় মন বাক্যের দ্বারা সাধন অন্তর্গত করা যায়। লীলায় তিনি রূপ ধারণ করেন। যে শরীর মন বন্ধনের কারণ তাই আবার মুক্তির উপায়। ঠাকুর বলতেন, কলিতে নারদীয় ভক্তি। সর্বদা তাঁর নামগুলো কীর্তন করা ধর্ম। ধর্মাধর্ম ছাড়লে শুদ্ধা ভক্তি, অমলা, নিষ্কাম ও অহেতুক ভক্তি বাকি থাকে। শ্রদ্ধা-ভক্তিতে কামনা বাসনা থাকবে না। কামনাশূন্য ভক্তি অহেতুক ভক্তি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

নিষ্কাম ভক্তি, অহেতুক ভক্তি সর্বপেক্ষা ভালো। ভালো-মন্দ সর্বক্ষণ ভক্ত ভগবান কে ভালোবাসে। দুঃখ, যে তাঁর স্মরণ মনন করবেন বলে তিনিই দিয়েছেন এ ভাবনা। এর নাম অহৈতুকি। তাঁর কৃপা হলে, ভক্ত এ সব জানতে, বুঝতে পারে। একবার লাভ হলে, ঠিক বোঝা যায় আর অবিশ্বাস আসে না। একবার জো-সো করে বড় বাবুর সঙ্গে দেখা করা, আলাপ করার মত। তখন তিনি বলে দেবেন, আর স্বরূপ চিনিয়ে দেবেন।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-২: অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া দুলিছে যেন?

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৩: কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে

ঠাকুর বলতেন, “ঈশ্বরীকর্তা আমি অকর্তা” জেনে কাজ করা। “ভক্তি তার কিরূপ প্রিয়। খোল দিয়ে যাব যেমন গরুর প্রিয়, গপ গপ করে খায়।” ভক্ত রাগভক্তি, শুদ্ধা ভক্তি, অহেতুক ভক্তি চায় কেবল। কিছুই চায় না। কোনও কামনা নাই, তাঁকে ভালোবাসা আর, মত্ত হয়ে যাওয়া। —চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content