সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


স্বামীজি ও শ্রীরামকৃষ্ণদেব।

একদিন শ্রীশ্রীঠাকুর, গৌরীমা তথা গৌরীদাসীকে বলেছিলেন, “আমি জল ঢালছি তুই কাদা কর”। এর অর্থ নিগূঢ়। তথাকথিত বাংলার সমাজে তখনও নারীর স্থান ছিল শুধু সংসারে আবদ্ধ এবং পুরুষের দ্বারা অত্যাচারিত ও অবহেলিত। শিক্ষার আলো তাদের জন্য ছিল না। গৌরী মায়ের সাহস, ত্যাগ, তপস্যা শ্রীরামকৃষ্ণের দৃষ্টির অগোচর ছিল না। শ্রীরামকৃষ্ণ বা মা সারদার দক্ষিণহস্ত স্বরূপ ছিলেন গৌরী দাসী। মহাতপস্বিনী ভাগ্যবতী ও পুণ্যবতী গৌরীমাকে একদিন শ্রীরামকৃষ্ণ এ দেশের মেয়েদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে সেবাকার্যে আত্মনিয়োগের কথা বলেন। শ্রীমায়ের আদরের সঙ্গী, গৌরী দাসী, অষ্ট সখীর এক সখী। গৌরীমা পরবর্তীকালে শ্রীমায়ের পুণ্যহস্তে শ্রীশ্রী সারদেশ্বরী আশ্রমের শুভ সূচনা করান নারী জাগরণের উদ্দেশ্যে। তাঁহার একনিষ্ঠা, সাহস, শক্তি, উদ্দাম, পৌরুষত্ব শ্রীরামকৃষ্ণের অবতার লীলার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য।
শ্রীশ্রীঠাকুর কুঠিবাড়ির ছাদে উঠে ডাকতেন আর কাঁদতেন, তোরা কে কোথায় আছিস আয়! স্বার্থশূন্য জীবন, তপস্যালব্ধ ফল বিতরণের জন্য শুদ্ধসত্ত্ব, অপাপবিদ্ধ অন্তরঙ্গদের আহ্বান জানতেন। তাঁহার উদ্দেশ্য পূরণের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য শ্রীশ্রীমাকে অনুযোগের সুরে ঠাকুর বললেন,”হ্যাঁ গা! তুমি কি কিছু করবে না, (নিজে দেহ দেখিয়ে) এ-ই সব করবে?” শ্রীশ্রীমা নিজের অসহায় অবস্থার কথা ভেবে বললেন, “আমি মেয়ে মানুষ। আমি কী করতে পারি? শ্রীঠাকুর উত্তর দিলেন, “না না, তোমাকে অনেক কিছু করতে হবে।”

শ্রীঠাকুর, শ্রীমায়ের উপর ভাবি ইতিহাসের ভার সমর্পণ করেছেন। যে জগৎ অনিত্য আবার প্রচ্ছন্নভাবে ব্যবহারিক সত্য তার সংশোধনে ও সমাজের সুস্থতা ফিরিয়ে আনার যে আবশ্যকতা ঠাকুর জানতেন; জানতেন জাতীয় জীবনের মেরুদণ্ডে শক্তির সঞ্চার দরকার। তাই তো তিনি শক্তিরুপা চৈতন্যময়ী মা সারদাকে ভার দিলেন। অন্তরের ক্লিবতাকে সরিয়ে মাতৃস্নেহ ছায়ায় মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটাবেন বলে। জাগরণ বা পরিবর্তন দুই প্রকারে সম্ভব। অবতার অবতারিত হন শক্তির সঞ্চার করেন। এ যুগে শত্রু বাহিরের থেকে অন্তরে বেশি। অন্তশত্রুর বিজয় সর্বাগ্রে প্রয়োজন। অন্তর বিজিত হলে বাহির অবশ্যই পরাভূত হবে।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৬৯: অমৃতের সন্ধানে মাস্টারমশাই /৫

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৯: ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ওড়া, কেওড়া, চাক কেওড়া ও কৃপাল

বিজয় দুই প্রকারে করা যেতে পারে। প্রথমত, স্বীয় অলৌকিক ক্ষমতার প্রয়োগে পাপ-সহ পাপীর বিনাশ করণে। আর এক প্রকারে সৎগুণ রাশির ক্ষমতার দ্বারা অন্যের অন্তরের বিজয়ের দ্বারা। শত্রুর মানসিক স্বচ্ছতা সাধনে ও চৈতন্য শক্তির জাগরনের দ্বারা। যদিও দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বিজেতার অধিক শক্তির প্রয়োজন। এ যুগে অবতার দ্বিতীয় পথই গ্রহণ করেছেন। তাঁর শক্তি স্বরূপা লীলা সঙ্গিনীকেও তাঁর কাজে সাহায্য করতে হয়েছিল। অধিকন্তু, তিনি নিজেই সে কাজ করতে পারতেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৩: মহাভারতে উল্লিখিত মিথ্যাশ্রয়ের প্রাসঙ্গিকতা কী আজও আছে?

একবার ঠাকুর যেন কোন দূর দেশ হতে এসে ভাবের ঘোরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেখো! কলকাতার লোকগুলো যেন অন্ধকারে পোকার মতো কিলবিল করছে। তুমি তাদের দেখো।” শ্রীমা অনুযোগের সঙ্গে বললেন, “আমি মেয়ে মানুষ। তা কি করে হবে।” শ্রীঠাকুর নিজে অঙ্গ দেখিয়ে আপন ভাবে বলে যেতে লাগলেন, “এ আর কি করেছে, তোমাকে এর থেকে অনেক বেশি করতে হবে।” (শ্রীমা সারদাদেবী পৃঃ ৯৬) জগতের সন্তুলন ফিরিয়ে নিয়ে আনার দায় দিয়ে নিজস্বন্ধে নিয়েছেন সৃষ্টির আদি থেকে; যখন-ই প্রয়োজন পড়েছে, হয় রাজার বেশে বা সন্ন্যাসীর বেশে। সং সেজে সংস্কার করেছেন। এ বারও সে দায় এড়াতে পারেন না। শ্রীমাকে তাই সজাগ করে বলছেন, “শুধু কি আমারই দায়, তোমারও দায়।” কতটা যন্ত্রণা হলে অবতার পুরুষ এহেন পরিকল্পনা তৈরি করেন! একা নয়, সশক্তি ও অন্তরঙ্গগণ সহ, মানব জীবন সুস্থ হতে শরীর ধারণ করেন! শক্তির মাহাত্ম্য নিজের মুখে ব্যাখ্যান করেছেন, “অনন্ত রাধার মায়া কহনে না যায়, কোটি কৃষ্ণ কোটি রাম হয় যায় রয়।” (শ্রী মা সারদাদেবী পৃঃ ৯৭)
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৯: বাইনাচ-গানেরও কদর ছিল ঠাকুরবাড়িতে

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা

পঙ্কিলতার মূল এত গভীরে প্রবেশ করে গিয়েছে যে, সমূলে বিনাশ করতে শিব অবতার স্বামীজিকে রণক্ষেত্রে আস্ফালনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। স্বামীজি অদ্বৈত ভূমি যার স্বাভাবিক স্থিতি। তিনি শরীর ধারণ করলেও নিজেও স্বরূপ তো ত্যাগ করতে পারেন না। শ্রীঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন স্বামীজি কে, “তুই কি চাস?” উত্তর দিলেন, “আমি সমাধিস্থ হয়ে থাকব।” ঠাকুর বললেন, “তুই তো বড় হীন বুদ্ধির। সমাধির পারে যা। সমাধিত তুচ্ছ কথা।” (কথামৃত পৃঃ ১১৩৯)
আরও পড়ুন:

বদলে দিয়েছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর নাটক এবং চলচ্চিত্রের ভাষা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

যে সমাধি লক্ষ কোটিতে একজনও লাভ করতে পারে না, তা ঠাকুরের কাছে হীন, তুচ্ছ। তার থেকেও বড় অবস্থা অর্থাৎ জ্ঞানের পর বিজ্ঞান। তা নরেনকে সেই অবস্থায় দেখতে চান। নরেনকে সেই অবস্থার পারে নিয়ে যেতে চান। বটবৃক্ষের ন্যায় দেখতে চান, যার তলায় অসংখ্য মানুষ তাদের প্রাণ জুড়াবে। জগতের পীড়িত মানুষের আশ্রয়স্থল হবে তাঁর নরেন। শ্রীশ্রীঠাকুর মাকে দিলেন অন্তর জগতের ভার। যদিও শ্রীশ্রীমায়ের অমোঘ শক্তি দেশের সীমা লঙ্ঘন করে ছুটে চলেন বহির্বিশ্বে। আর স্বামীজি বহির্বিশ্বে জাগরণ ঘটিয়ে টেনে নিয়ে এলেন অন্তঃজগতে। অনন্ত প্রভুর অনন্তলীলা। অদ্বৈত জ্ঞানের ভক্তি চেতনা, ‘সর্বম্ খল্বদম্ ব্রহ্ম’। শুধু তথ্য নয়, প্রতিটি ঘরের উঠানে উঠানে ছড়িয়ে পড়েছে শস্য দানার মতো। যে বীজ একদিন না একদিন অঙ্কুরিত হবে। রাত্রি অবসান সমাগত প্রায়। চৈতন্যের অমৃতধারা বইবে এ বার। কেউ আটকাতে পারবে না। জেগে উঠবে জগৎ জীবন।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content