শ্রীরামকৃষ্ণদেব।
উপনিষদের ব্রহ্মজ্ঞানের পার্বত্য পাদদেশে, যেখানে ভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রেম নদী বিধৌত করে একে অপরকে। এই দুইয়ের অভেদ দর্শনে সর্বভূতে যে চৈতন্য দর্শন করা যায়, সে প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “এক চৈতন্য অভেদ, বিষ্ঠা, মুত্র, অন্ন, ব্যঞ্জন সবপ্রকার খাবার জিনিস পড়ে রয়েছে, তাঁর (শ্রীরামকৃষ্ণ) ভিতর থেকে জীবাত্মা বেরিয়ে সবকিছুকে স্পর্শ করে গেল।” এর অর্থ, সর্বব্যাপী এক চৈতন্য সকলের মধ্যে সমান ভাবে বিদ্যমান রয়েছে। গুণগত পার্থক্য।
অনেক জন শুদ্ধসত্ত রয়েছে যারা তাঁর আপনজন। তাদের সঙ্গ পাওয়ার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষায় আছেন।
মণিকে এর অর্থ জানাতে চাইছেন, এর মানে কি তার কিরূপ বোধ হয়? মণি উপলব্ধিতে ভগবানের লীলার কথায় উদিত হয়, অপার করুণায় অন্যের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেন। বলছেন, “আপনি তার বিলাসের স্থান। এই বুঝেছি আপনি যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী। জীবেদের যেন কলে ফেলে তৈরি করেছেন। কিন্তু আপনাকে তিনি নিজের হাতে গড়েছেন।” শ্রীঠাকুর, মাস্টার মহাশয়ের ধারণার স্পষ্ট রূপ দেখতে চান।
স্বচ্ছতার জন্য বলছেন, যারা শুদ্ধা ভক্তি চায় তারা প্রায়ই ঐশ্বর্য চায় না। ভক্তি নিয়ে থাকে। ঈশ্বরও ভক্তির টানে ঐশ্বর্য ছেড়ে ভক্তের কাছে আসেন। তখন তাঁকে দেখা যায়। ভক্তের জন্য ভগবান নানা ভাব আশ্রয় করে আসেন।
অনেক জন শুদ্ধসত্ত রয়েছে যারা তাঁর আপনজন। তাদের সঙ্গ পাওয়ার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষায় আছেন।
মণিকে এর অর্থ জানাতে চাইছেন, এর মানে কি তার কিরূপ বোধ হয়? মণি উপলব্ধিতে ভগবানের লীলার কথায় উদিত হয়, অপার করুণায় অন্যের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেন। বলছেন, “আপনি তার বিলাসের স্থান। এই বুঝেছি আপনি যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী। জীবেদের যেন কলে ফেলে তৈরি করেছেন। কিন্তু আপনাকে তিনি নিজের হাতে গড়েছেন।” শ্রীঠাকুর, মাস্টার মহাশয়ের ধারণার স্পষ্ট রূপ দেখতে চান।
স্বচ্ছতার জন্য বলছেন, যারা শুদ্ধা ভক্তি চায় তারা প্রায়ই ঐশ্বর্য চায় না। ভক্তি নিয়ে থাকে। ঈশ্বরও ভক্তির টানে ঐশ্বর্য ছেড়ে ভক্তের কাছে আসেন। তখন তাঁকে দেখা যায়। ভক্তের জন্য ভগবান নানা ভাব আশ্রয় করে আসেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ উদাহরণ দিচ্ছেন, “ঠিক সূর্যোদয়ের সূর্য যেমন চক্ষু ঝলসে যায় না, বরং চক্ষের তৃপ্তি হয়।” শ্রীম দেখছেন ঠাকুর সেই নবোদয়ের সূর্য, যাকে দেখতে কষ্ট হয়না বরং আহ্লাদ হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রশ্ন করছেন, কারও সঙ্গে বা কোনও পরমহংসের সঙ্গে মিল আছে কি না। মাস্টার উত্তর দিচ্ছেন, “আজ্ঞে না। আপনার তুলনা নাই।“ শ্রীরামকৃষ্ণের স্বগত উদাহরণ, “অচিন গাছ, তাকে কেউ দেখে চিনতে পারেনা।”
মাস্টার পূর্বাতনভাবের প্রভাব সংযত করে বলেন, যে উক্তিটি ভগবানকেও ভাবিয়ে দেয়, নিছক মন্তব্য নয়। বরং আসক্তি যেমন মনো কামনা বাড়ায়, স্পর্শ যেমন সুখ প্রদান করে, শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গ তেমন ভগবত ভক্তি বাড়ায়, যাকে পেতে ইচ্ছে হয়। মণি ভাবছেন সে কথায়, ভগবান না জানিয়ে দিলে তাঁকে চিনবার জো নাই। তবে এটুকু বুঝেছেন এবং বলছেন, “যে আপনাকে যে যত বুঝবে সে ততই উন্নত হবে।” মণি চুপ করে ভাবছেন, “শ্রীরামকৃষ্ণ কি সূর্যদয়ের সূর্য? আর অচিন গাছ? এরই নাম কি নরলীলা? অন্তরঙ্গ পার্শ্বরদের জন্য কি ব্যাকুল তিনি” (কথামৃত পৃঃ ২৬১)
মাস্টার পূর্বাতনভাবের প্রভাব সংযত করে বলেন, যে উক্তিটি ভগবানকেও ভাবিয়ে দেয়, নিছক মন্তব্য নয়। বরং আসক্তি যেমন মনো কামনা বাড়ায়, স্পর্শ যেমন সুখ প্রদান করে, শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গ তেমন ভগবত ভক্তি বাড়ায়, যাকে পেতে ইচ্ছে হয়। মণি ভাবছেন সে কথায়, ভগবান না জানিয়ে দিলে তাঁকে চিনবার জো নাই। তবে এটুকু বুঝেছেন এবং বলছেন, “যে আপনাকে যে যত বুঝবে সে ততই উন্নত হবে।” মণি চুপ করে ভাবছেন, “শ্রীরামকৃষ্ণ কি সূর্যদয়ের সূর্য? আর অচিন গাছ? এরই নাম কি নরলীলা? অন্তরঙ্গ পার্শ্বরদের জন্য কি ব্যাকুল তিনি” (কথামৃত পৃঃ ২৬১)
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৬৭: অমৃতের সন্ধানে মাস্টারমশাই /৩
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বাইন ও গর্জন
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “বিচার করো না, তাঁকে জানতে কে পারবে? ন্যাংটা বলত, শুনে রেখেছি তারই এক অংশ ব্রহ্মাণ্ড।” (কথামৃত পৃঃ২৮১) বৃথা বিচার তর্ক করা থেকে ঠাকুর বিরত হতে বলছেন। অন্য জায়গাতে, নিত্যানিত্যবস্তু বিচার করার কথা বলছেন। তবে বিচার না বন্ধ করল বিশ্বাস আসে না। ‘ঈশ্বর’ আছে সত্য, কিন্তু তাঁকে কি জানা যায়? যে জানতে চায় সে ঈশ্বরের সঙ্গে এক হয়ে যায়। ঠাকুর যেমন বলতেন, “নুনের পুতুল জল মাপতে গিয়ে মিলিয়ে গেল। জল আর মাপা হল না।” প্রতাপচন্দ্র হাজরার প্রসঙ্গে বলছেন, বড় বিচার বুদ্ধি।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “আমি জানি, আমি কিছুই জানি না” (কথামৃত পৃঃ ২৮১)। উপনিষদে রয়েছে— “যস্যামতং তস্য মতং মতং যস্য ন বেদ সঃ।” (কেনোপনিষদ ২।৩)৷ ব্রহ্মকে যিনি যনেন তার প্রকাশ কেমন হবে! আর তার অহং শূন্য প্রকাশ।” যিনি বলেন, আমি তাকে জেনেছি, তিনি জানেন না।” তাকে জানা যেতে পারে না কারণ তিনি ব্রহ্ম জানেন তিনি ব্রহ্ম হয়ে যান, তিনি আমাদের প্রকৃত সত্তা। আমরা, আমাদের থেকে পৃথক সত্তাকে জানতে পারি, আর ব্রহ্মের থেকে কোনও পৃথক অস্তিত্ব নাই। তাই ব্রহ্মকে জানতে পারে যায় না। অনন্তকে জানা যায় না। যিনি বলেন তিনি অহংকারের বশবর্তী হয়ে বলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “আমি জানি, আমি কিছুই জানি না” (কথামৃত পৃঃ ২৮১)। উপনিষদে রয়েছে— “যস্যামতং তস্য মতং মতং যস্য ন বেদ সঃ।” (কেনোপনিষদ ২।৩)৷ ব্রহ্মকে যিনি যনেন তার প্রকাশ কেমন হবে! আর তার অহং শূন্য প্রকাশ।” যিনি বলেন, আমি তাকে জেনেছি, তিনি জানেন না।” তাকে জানা যেতে পারে না কারণ তিনি ব্রহ্ম জানেন তিনি ব্রহ্ম হয়ে যান, তিনি আমাদের প্রকৃত সত্তা। আমরা, আমাদের থেকে পৃথক সত্তাকে জানতে পারি, আর ব্রহ্মের থেকে কোনও পৃথক অস্তিত্ব নাই। তাই ব্রহ্মকে জানতে পারে যায় না। অনন্তকে জানা যায় না। যিনি বলেন তিনি অহংকারের বশবর্তী হয়ে বলেন।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬১: মহাভারতের রাক্ষসরা কী আজও বর্তমান? প্রসঙ্গ— বকরাক্ষসবধ
শ্রীরামকৃষ্ণ মায়ের শরনাগত, তাঁর সন্তান ভাব। তিনি জানেন তার মা আছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তদ্গত হয়েছেন, নিজের বুকে হাত দিয়ে মাস্টারকে, “আচ্ছা এতে কিছু আছে, তুমি কি বলো?” (কথামৃত পৃঃ ২৮২) মাস্টার ভাবছেন আর দেখছেন, “সাক্ষাৎ মা কী ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’ শরীর ধারণ করে এসেছেন; জীবের মঙ্গলের জন্য। যাঁর অন্তর বাহির ঈশ্বরময় হয়ে রয়েছেন।”
শ্রীরামকৃষ্ণ সংসারের দুঃখের কারণ প্রসঙ্গে বলছেন, অর্থ, মান, সম্ভ্রম রিপু, রোগ, শোক, কর্তব্যবোধ মানুষকে যন্ত্রণা দিয়ে থাকে। কর্তব্য যতক্ষণ না যায়, ততক্ষণ সংসার পালন, যতক্ষণ আপন বোধ, ততক্ষণ এই সংসার। রামকৃষ্ণ তার কি ভাব জিজ্ঞাসা করছেন। দেখেন মাস্টার কি বলেন! বলছেন ‘ঘুম ভাঁঙলে মানুষের যা, যা হবার তাই। ঈশ্বরের সঙ্গে সদা যোগ।’ (কথামৃত পৃঃ ২৮৩) ঈশ্বরময় কালিময় শ্রীরামকৃষ্ণ। তিনি দেখেছেন লোকবন্ধন তার নেই, নেই কোন কর্তব্য।
শ্রীরামকৃষ্ণ সংসারের দুঃখের কারণ প্রসঙ্গে বলছেন, অর্থ, মান, সম্ভ্রম রিপু, রোগ, শোক, কর্তব্যবোধ মানুষকে যন্ত্রণা দিয়ে থাকে। কর্তব্য যতক্ষণ না যায়, ততক্ষণ সংসার পালন, যতক্ষণ আপন বোধ, ততক্ষণ এই সংসার। রামকৃষ্ণ তার কি ভাব জিজ্ঞাসা করছেন। দেখেন মাস্টার কি বলেন! বলছেন ‘ঘুম ভাঁঙলে মানুষের যা, যা হবার তাই। ঈশ্বরের সঙ্গে সদা যোগ।’ (কথামৃত পৃঃ ২৮৩) ঈশ্বরময় কালিময় শ্রীরামকৃষ্ণ। তিনি দেখেছেন লোকবন্ধন তার নেই, নেই কোন কর্তব্য।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৭: কবির জন্মদিনে প্রিয়জনের উপহার
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২১: গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী—এক শক্তির গল্প
১৮৮৪ সালের ৫ জানুয়ারি সেদিন শ্রীরামকৃষ্ণ বিশ্বাস সম্বন্ধে কথা বলছেন। বিশ্বাস চাই। বিশ্বাস হলে বিচার চলে যায়। বালকের বিশ্বাস। মা জগৎ রূপে আছেন সর্বব্যাপী হয়ে। গৌরী পণ্ডিত যেমন বলতেন, “ঠিক ঠিক জ্ঞান হলে কালী, গৌরাঙ্গ এক বোধ হবে।” যিনি ব্রহ্ম তিনিই শক্তি। তিনি নর রূপে শ্রীগৌরাঙ্গ।
১৮৮৫ সালের ২৮ আগস্ট কথা হচ্ছিল। সেদিন ঠাকুর মহাবাক্য বলে দিয়েছেন। “যারা আন্তরিক ধ্যান জপ করছে তাদের এখানে আসতেই হবে।” আবার ঠাকুর মনিকে দিয়ে মিলিয়ে নিচ্ছেন। ঠাকুর অসুস্থ হওয়ায় সেদিন সকলে চলে গিয়েছেন। আছেন মনি একা। পদসেবা করছেন আর ভাবছেন, এই অসুস্থ শরীর হলেও ঈশ্বর বই কোনও কথা বলেন না। আর কিছুই জানেন না। তখন বলছেন, “বলরাম বলে, আপনারই এই, তাহলে আমাদের আর হবে না কেন?” অর্থাৎ যদি উনি অবতার হয়ে রোগ, তাহলে তাদের হবে না কেন! ঠাকুর বলছেন, “রাম, সীতার দুঃখ এতই কাতর যে ধনুক তুলতে পারছেন না। পঞ্চ ভূতের ফাঁদে, ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে।” মণি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, যিশুখ্রিষ্ট ভক্তের দুঃখ দেখে অন্য লোকের মতো কেঁদেছিলেন।—চলবে।
১৮৮৫ সালের ২৮ আগস্ট কথা হচ্ছিল। সেদিন ঠাকুর মহাবাক্য বলে দিয়েছেন। “যারা আন্তরিক ধ্যান জপ করছে তাদের এখানে আসতেই হবে।” আবার ঠাকুর মনিকে দিয়ে মিলিয়ে নিচ্ছেন। ঠাকুর অসুস্থ হওয়ায় সেদিন সকলে চলে গিয়েছেন। আছেন মনি একা। পদসেবা করছেন আর ভাবছেন, এই অসুস্থ শরীর হলেও ঈশ্বর বই কোনও কথা বলেন না। আর কিছুই জানেন না। তখন বলছেন, “বলরাম বলে, আপনারই এই, তাহলে আমাদের আর হবে না কেন?” অর্থাৎ যদি উনি অবতার হয়ে রোগ, তাহলে তাদের হবে না কেন! ঠাকুর বলছেন, “রাম, সীতার দুঃখ এতই কাতর যে ধনুক তুলতে পারছেন না। পঞ্চ ভূতের ফাঁদে, ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে।” মণি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, যিশুখ্রিষ্ট ভক্তের দুঃখ দেখে অন্য লোকের মতো কেঁদেছিলেন।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।