শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও শ্রীমা।

শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনের ফলিত ধর্ম প্রকাশ ছিল অভিমানশূন্যতা, যা তাঁর ভাবকে সদা নিজস্ব রূপে প্রকাশ করত। অহং একটু থাকতে ঈশ্বর লাভ হয় না। তিনি জানালেন— “সত্যতে থাকবে তো হলেই ঈশ্বর লাভ হবে।” (কথামৃত পৃঃ ২৩৪)

শ্বেতাশ্বেতরোপনিষদ্ (১/১৫) এ উল্লেখ আছে—
“তিলেষু তৈলং দধিনীব সর্পিরাপঃ স্রোতঃস্বরণীষু চাগ্নিঃ।
এবমাত্মাত্মানি গৃহ্যতেঽসৌ সত্যেনৈনং তপসা যোঽনুপশ্যতি।।


অর্থাৎ, যিনি শ্রাবনাদির পর ‘সত্য’ ও ‘তপস্যা’ সহায় দুগ্ধে অনুস্যূত ঘৃতের ন্যায় সর্বব্যাপী এই আত্মাকে আত্মজ্ঞান ও তপস্যার দ্বারা লভ্য ও মুক্তির আশ্রয়ীভূত সুপ্রসিদ্ধ ব্রহ্ম রূপে সাক্ষাৎকার করেন, তাঁরই দ্বারা ওই পরমাত্মা তিল মধ্যগত তৈল, দধি মধ্যগত ঘৃত, ভূগর্ভস্থ জল ও কাষ্ট মধ্যগত অগ্নির ন্যায় আপনার আত্মারই মধ্যে গৃহীত হন।
শ্রীরামকৃষ্ণ জীবন ছিল সত্যে প্রতিষ্ঠিত, শ্রীশ্রীজগতমাতা। বালককে কখনও পা বেচালে পড়তে দেয়নি। সর্বদা ঈশ্বর সান্নিধানে সে তন্ময়তা পেয়েছেন। ঈশ্বর চিন্তায় মস্তিষ্কের সন্তুলন নষ্ট হয় না। তিনি উদ্ঘাটন করছেন উপনিষদের রহস্য। শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন উপনিষদের সহজ ভাষ্যকার। শিক্ষক মহাশয় চিনতে ভুল করেননি। ঈশ্বর দর্শনের লক্ষণ, সম্বন্ধে বোঝাতে গিয়ে রামকৃষ্ণ পাঁচ বছরের বালকের উপমা দিচ্ছেন। একই ভাবে শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতার দ্বিতীয় আধ্যায়ে রয়েছে। যেমন সরল, উদার, অহংকার নেই। কোনও জিনিস এই আসক্ত নয়। কোনও গুণের বশ নয়। শুধু তাই নয়, আবার সুচি অশুচি বোধ নেই। আপন পর বোধ নাই, আচার অনাচার বোধ নাই, কোনও কর্ম করেন না আবার সতপ্রণদিত হয়ে কর্মের করেন। এক বৈষ্ণব ভক্তের প্রশ্নের উত্তরে বলছেন, তিনি জিজ্ঞেস করছেন, কারও এরূপ হয় কিনা? শিক্ষক মহাশয় পাশে থেকে কথা শুনছেন আর ভাবছেন, কীভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের অবস্থার কথা বর্ণনা করছেন!
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৬৬: অমৃতের সন্ধানে মাস্টারমশাই /২

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৬: সুন্দরবনের লৌকিক চিকিৎসায় ম্যানগ্রোভ—হরগোজা ও কেয়া

আবার শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “তুমি আর তোমার এটি জ্ঞান, আমি আর আমার এটি অজ্ঞান। হে ঈশ্বর, তুমি কর্তা আর আমি অকর্তা এটি জ্ঞান। যে অজ্ঞান সেই বলে, ঈশ্বর সেথায় সেথায় অনেক দূরে; যিনি জ্ঞানী তিনি বলেন তিনি নিকটে হৃদয় মধ্যে অন্তর্যামী রূপে আবার নিজে এক একটি রূপ ধরে রয়েছে।” (কথামৃত পৃঃ ২৪০)

‘অঙ্গুষ্টমাত্রঃ পুরুষোঽন্তরাত্মা সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ।’ (কঃউঃ ২/৩/১৭)

অঙ্গুষ্টমাত্র পুরুষ যা অন্তরাত্মা রূপে সর্বদা প্রতিটি জীবের হৃদয়ে অবস্থান করছে। শ্রীরামকৃষ্ণের মুর্হুমুর্হু সমাধি আগন্তুক মাত্রই দেখতে পায়। আবার উৎসাহী ও মেধাবী আগন্তুক হলে তো কথাই নেই। শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গদের মধ্যে মাস্টার একজন যিনি একটি কাজের জন্য নির্দিষ্ট ছিলেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬০: আধুনিক ভারতীয় রাজনীতির চালচিত্রে কি দশরথ ও কৈকেয়ীর ছায়া?

একদিন সমাধি ভাঙার পর শ্রীশ্রীভবতারিণী মায়ের সঙ্গে স্বাভাবিক কথা বলছেন। সেখানে রাখাল ঘরের মধ্যে বসে আছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন। “মা, ওকে এক কলা দিলি কেন?” যেমন তিনি ঈশ্বরীয় শক্তির ভাগবাটোয়ারা করছেন। আর যার যতটা প্রয়োজন মায়ের সঙ্গে বসে যেন দিয়ে যাচ্ছেন আগামী দিনের মায়ের কাজ করে যাওয়ার জন্য। যে যেমন আধার তাকে সেই রকম ক্ষমতা দিচ্ছেন। যেন কোনও অনিষ্ঠা না হয়। আবার বলছেন, “মা বুঝেছি এক কলাতেই যথেষ্ট হবে, এক কলাতেই তোর কাজ হবে। জীব শিক্ষা হবে।”

মাস্টারমশাই দেখছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তার অন্তরঙ্গদের মধ্যে শক্তি সঞ্চার করছেন। তিনি শক্তি সঞ্চার করতে পারেন, যিনি অবতার, যুগাচার্য, তিনি শিষ্যের সমস্ত কলুষতা নিমেষে নষ্ট করে তার মধ্যে ঈশ্বরের শক্তি সঞ্চারিত করেন। ভাব বুঝেন, অধিকারীকে কেমন বুঝতে পারেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, যেন কাচের আলমারিতে জিনিস থাকলে দেখা যায়, তেমনই তিনি সকলের অন্তর দেখতে পারেন।

১৮৮৩ সালের ১৮ আগস্ট। সেদিন বলরাম গৃহে ঈশ্বরীয় অবতার প্রসঙ্গ। অবতার লোকশিক্ষার জন্য ভক্তি ও ভক্ত নিয়ে থাকে। যেমন ছাদে উঠে সিড়িতে আনাগোনা করা। উপমা দিয়ে সাধারণভাবে তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন, “যেমন দোকানদার যতক্ষণ না হিসেব মিটে, ততক্ষণ ঘুমায় না, খাতায় হিসাব ঠিক করে তবে ঘুমায়।” অবতারের আশার উদ্দেশ্য জীব কী করে ঈশ্বর দর্শন করে, কী করে জীবনের উদ্দেশ্য পূর্ণ করে জীবনধারণ সার্থক করতে পারে। সেটি দেখানো। তিনি রাস্তার খোঁজ দেন লোকে যাতে প্রত্যেকে অনায়াসে মালিকের খোঁজ পায় বাগানে বাগানে না ফিরে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৬: যন্ত্রণাদগ্ধ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রাঁচিতে পেয়েছিলেন সান্ত্বনার প্রলেপ

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪২: রাজকোষে সঞ্চিত সোনা-রূপা-ধান্যাদি সবই প্রজাবর্গের, রাজার ব্যক্তিগত নয়

শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট হয়ে রাখালকে বলছেন, “এখানকার শ্রাবণ মাসের জল নয়। খুব হুড় হুড় করে আসে, আবার বেরিয়ে যায়। এখানে পাতাল ফোঁড়া শিব, বসানো শিব নয়।” রামকৃষ্ণের প্রতি ভাবনার গাঢ়ত্ব ও গুঢ়ত্ব আরও যেন ঘনীভূত দেখে মাস্টারের স্বভাবত প্রশ্ন আশে, রামকৃষ্ণ কী অবতার? পাতাল ফোঁড়া শিব?” সেদিন অধরের জিহ্বা স্পর্শ করে কি বীজ মন্ত্র লিখে দিলেন। অধর ধন্য হলেন, দীক্ষা হয়ে গেল।

ধ্যান করতে নির্দেশ দিলেন। অবতার পুরুষরা এইভাবে প্রাণে স্পন্দন সৃষ্টি করে থাকেন। তিনি সর্বদাই অন্তরঙ্গদের কথা ভাবেন, কিসে তাদের মঙ্গল হয়,কিসে মায়ের যন্ত্রস্বরূপ হতে পারে। মাস্টার ভাবছেন, শিব রূপী শ্রীরামকৃষ্ণ তাদের সামনে রয়েছেন। তিনি বিস্মিত হচ্ছেন ঠাকুরের কথায়। প্রত্যেকে তাঁর সঙ্গে যে সম্পর্কে বাঁধা, তার পরিচিতি করে দিচ্ছে। আর অবতার যেন গাভীর বাঁট সেখান থেকে দুধ আসে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “মানুষে তিনি অবতীর্ণ হন, যেমন গুটির ভিতর মাছ এসে জমে। “(কথামৃত পৃঃ ২৪৭)

ভক্তেরা সকলে ভাবছেন যিনি শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্যদেব বা যিশুখ্রিস্ট তিনিই শ্রীরামকৃষ্ণ অবতারে এসেছেন! তিনি বুঝি আবার লোক কল্যানার্থে আবার অবতীর্ণ হয়েছেন!
—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content