সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব।

সেদিন ঠাকুরের কাছে তারক, রাখাল, রাম, কেদার সম্মুখে উপস্থিত আছেন। শ্রীশ্রী ঠাকুর, তারকের চিবুক ধরে আদর করছেন। শ্রী তারক পুষ্পমালা দিয়ে ঠাকুরের পাদপদ্মকে সুশোভিত করেছেন। এ বার ভাবাবিষ্ট হয়েছেন। রাখালকে বলছেন, “আমি অনেকদিন এখানে এসেছি, তুই কবে এলি?” (কথামৃত, পৃ: ২০৭) মাস্টার ঠাকুরের কথার মধ্যে দেখলেন, তাঁর পূর্ব-পূর্ব যুগে মনুষ্য রূপে লীলার সংকেত। আর এঁরা রাম, তারক, রাখাল ওঁরা, তাঁর লীলার সঙ্গী হিসাবে এসেছেন। শুধু সময়ের অপেক্ষা।

১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ। শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তদের অবতারের স্বরূপ সম্বন্ধে অবহিত করাচ্ছেন। তাঁদের সহজে চেনা যায় না। সাধারণের সঙ্গে অবতার পুরুষের আচরণে অমিল পাওয়া কঠিন। তাঁরা গোপনে আসেন। “দু’-চারজন অন্তরঙ্গ ভক্ত জানতে পারে। রাম পূর্ণব্রহ্ম অবতার এ কথা ১২ জন ঋষি কেবল জানতো।” যিনি অখণ্ড সচ্চিদানন্দ, তিনি আবার রাম। মনুষ্য শরীর ধারণ করে অবতীর্ণ হয়েছেন। বস্তুত মায়াকে আশ্রয় করেছেন বলে মানুষের মতো দেখাচ্ছে।
শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে ভক্তেরা অবতার তত্ত্ব শুনছেন, আর ভাবছেন বেদ উক্ত অখণ্ড সচিদানন্দ, যা বাক্য মনের অতীত তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ রূপ ধারণে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আর তা যদি না হতো তাহলে কী রূপে তিনি রাম, রাম উচ্চারণ করতে করতে সমাধিস্থ হতেন! তিনি নিশ্চয়ই হৃদ পদ্মে রাম রূপ দর্শনে মথিত হচ্ছেন।

এ ঘটনা অবলম্বনে এটা বোঝা যায়, অখণ্ড ব্রহ্ম সর্বব্যাপী হয়েও শরীর ধারণ করেন। অবতার লীলা করেন, ভক্তদের সঙ্গে প্রেম আস্বাদনের জন্য। শ্রী গৌরাঙ্গের যখন অন্তর্দশা তখন জড়বৎ সমাধিস্থ। যখন অর্ধাবাহ্য দশা তখন প্রেম আবিষ্ট হয়ে নিত্য, আবার বাহ্যদশাতে ভক্ত সংগে সংকীর্তন করেন। শ্রীশ্রী ঠাকুর সতত দিন রাত এই তিন ভাবেই থাকতেন। তাঁর সমাধি অবস্থায় প্রেম অনুরঞ্জিত চন্দ্রবদন দেখে সকলে ভক্তদের এ কথায় প্রত্যয় হত, যে এই আনন্দঘন মূর্তি, জ্যোতির্ময় রূপ দর্শনে তাদের হৃদয় রঞ্জিত হয়ে যায় তিনি শ্রীরাম বা শ্রীকৃষ্ণ বা শ্রীচৈতন্য ছাড়া আর অন্য কেউ না।

ঈশ্বরই কর্তা, তিনি কাউকে চৈতন্য বা অচৈতন্য করে রেখেছেন কেন? পক্ষপাতিত্বের কারণ কী? আন্তরিক হলে তিনি প্রার্থনা শুনেন। ব্যাকুল হয়ে প্রার্থনা করতে হয়। যতক্ষণ আমি বোধ আছে প্রার্থনা করতেই হবে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “লীলা ধরে ধরে নিত্যে যেতে হয়। যেমন সিঁড়ি ধরে ধরে ছাদে ওঠা। নিত্য দর্শনের পর, নিত্য থেকে লীলায় এসে থাকতে হয়, ভক্তি-ভক্ত নিয়ে। এটি পাক মত।” … “তাঁর নানা রূপ, নানা লীলা-ঈশ্বর লীলা, দেবলীলা, নরলীলা, জগতলীলা। তিনি মানুষ হয়ে অবতার হয়ে যুগে যুগে আসেন প্রেম ভক্তি শিখাবার জন্য। অবতার হলেন গাভীর বাঁট যেখান দিয়ে ক্ষীর আসে। অবতারের মধ্য দিয়ে প্রেম ভক্তির প্রকাশ দেখা যায়।” শ্রীরামকৃষ্ণ রূপে সেই ভাবের পূর্ণ প্রকাশ, যার মধ্যে দিয়ে প্রেম ভক্তি রূপ ক্ষীর প্রাওয়া যায়।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৬৫: অমৃতের সন্ধানে মাস্টারমশাই /১

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের প্রকৃত ম্যানগ্রোভ ও ম্যানগ্রোভ-সহযোগীরা

সেদিন একুশে জুলাই, ১৮৮৩। শ্রীরামকৃষ্ণ অতি গুহ্য কথা মাস্টার মহাশয়কে শোনাচ্ছেন। চৈতন্য তত্ত্ব। মায়া দ্বারা ঢাকা রয়েছে, সাধারণ মানুষ মায়াতে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে বলে সেই চৈতন্যকে

দেখতে পাচ্ছে না। শ্রীরামকৃষ্ণ উদাহরণ দিচ্ছেন “কামারপুকুরের একটি পুকুরের যেখানে জল পান করতে গিয়ে একটি লোক পানা সরিয়ে জল খেলো, চৈতন্য সেই রূপ মায়া সরিয়ে দেখতে হবে।” যে চৈতন্যকে দর্শন করছেন শ্রীরামকৃষ্ণে, সে কথা তিনি মাস্টারকে জানাচ্ছেন। যে চৈতন্যে জগৎ চৈতন্যময়।

তিনি বলছেন, “একবার দেখি ছোট ছোট মাছের ভিতর সেই চৈতন্য কিলবিল করছে, এক একবার দেখি বর্ষায় যেরূপ পৃথিবী জরে থাকে, সেই রূপ এই চৈতন্যতে জগৎ জরে রয়েছে।” তিনি তারপর ঠিক গ্রিস দেশের জ্ঞানী সক্রেটিসের মতো করে বললে উঠলেন, ‘কিন্তু এত তো দেখা হচ্ছে, আমার কিন্তু অভিমান হয় না।” (কথামৃত, পৃ: ২৩৩) সে সকল দর্শন বা উপলব্ধি, তার জন্য অভিমান না আসাটাই স্বাভাবিক। যিনি সর্বদাই চৈতন্য সত্তাকে অন্তর জগৎ ও বহির্জগতের উপলব্ধি করছেন, তাঁর কাছে জগতের জগৎ ভাবনাটাই অস্বাভাবিক। সত্যকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি না বলেই এ জাতীয় মানুষদের সর্বদাই আলাদা করেছি বা তাঁদের নির্মম পরিণতির দিকে পৌঁছে দিয়েছি।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৬: ভয়ের না ‘অভয়ের বিয়ে’

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, তিনি কিই বা জানেন যে এত লোক আসে! তাঁর কাছে বৈষ্ণবচরণ বা গৌরী পণ্ডিত বা আরও যাঁরা আসতেন তাঁদের সম্বন্ধে বলছেন। বৈষ্ণবচরণ বলছেন, শ্রী রামকৃষ্ণ যে সকল কথা বলেন সব শাস্ত্রে পাওয়া যায়। কিন্তু সেইগুলি রামকৃষ্ণের মুখে শুনতে আসেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সেই শাস্ত্রগুলি পড়েননি, কিন্তু তিনি যে সত্যগুলি উপলব্ধি করেছেন তা বেদের সঙ্গে মিলে। তিনি যে আলোক দর্শন করেছেন সেই আলোকে সমস্ত শাস্ত্র প্রতিহত হয়। তাই তাঁর কাছে আসা।

শ্রীমদ্গীতাকে পঞ্চম বেদ বলা হয়ে থাকে। সেই ভগবানের শ্রীমুখ নিঃসৃত বাণী বা বৈদিক যুগেও ঋষিদের সত্য বলে উপলব্ধি হয়েছিল, সেই সত্যই শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপর যুগে অর্জুনকে উপলক্ষ করে সমস্ত মানবজাতির উদ্দেশ্যে বলেছেন, শ্রীরামকৃষ্ণ এই যুগে সেই গীতায় উল্লেখিত তত্ত্বকে আবার সহজতম ভাষায় সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের কথার সত্যতা প্রমাণ করতে হলে স্মরণ করতেই হবে, ‘সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরনং ব্রজ।’ (১৮/৬৬) শ্রীরামকৃষ্ণ গীতার সার বলছেন, “গীতা
গীতা বারবার বললে তাগি তাগি হয়ে যায়। তাগি ও ত্যাগী অর্থ এক। হে জীব সমস্ত কিছু অভিমান ত্যাগ করে ঈশ্বরের শরণাপন্ন হও” (কথামৃত, পৃ: ২৩৩) অর্থাৎ গীতার মূল তত্ত্ব, কর্ম ও কর্মফল ত্যাগের মধ্যেই উচ্চ উপলব্ধি নিহিত আছে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৫: ভূপেনবাবুর ভূত

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪১: প্রতিকার না করেও রাজা যদি প্রজার দুঃখটুকুও শোনেন তাহলেও যথেষ্ট

শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞাসা করছেন, তাঁর সঙ্গে আর কারও মিল আছে কি না। কোন পণ্ডিত বা সাধুর সঙ্গে? মাস্টারমশাই কোনও মিল খুঁজে পাননি কারও সঙ্গে; কিন্তু যেভাবে উত্তর দিয়েছেন তাঁদের শ্রীরামকৃষ্ণের এক পৃথক সত্তা, পৃথক পরিচয় উপস্থাপিত করে। যাঁরা আসেন, অবতীর্ণ হন তাঁদের মতোই হয়ে। অন্য কারও সঙ্গে মিল পাওয়া যায় না, এঁরা নতুন সভ্যতা গড়ে তোলেন। মাস্টারমশাই সেই উপলব্ধি থেকে বলছেন, যা তাঁর একান্ত। ‘আপনাকে ঈশ্বর স্বয়ং হাতে গড়েছেন। অন্য লোকদের কলে ফেলে তয়ের করেছেন—যেমন আইন অনুসারে সব সৃষ্টি হচ্ছে।’—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content