শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব।

মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত তখনও শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে ভালোভাবে চিনতেন না। তিনি পরমহংসদেবের খোঁজে দক্ষিণেশ্বর এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রথম দিনে তিনি জ্ঞান ও অজ্ঞান সম্বন্ধে ‘জ্ঞান’ লাভ করলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের কথা তাঁর মনে মৌতাত তথা আবেশ ধরিয়ে দিল। শ্রীরামকৃষ্ণলীলা সঙ্গীকে ঠিক-ই চিনেছিলেন যে, মহেন্দ্র নাথই তাঁর বাণীর গ্রন্থনা করবেন। তাই, যিনি শ্রীরামকৃষ্ণ কথাঅমৃত পরিবেশন করবেন, তার রসায়নটা জেনে নেওয়া দরকার ছিল। সুদক্ষ ধর্মাচার্য্য, মহেন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করে বুঝে নিতে চাইতেন, সে কী বুঝল! আমার কথামৃত প্রবাহে দেখতে পাব মাস্টার মহাশয়ের স্বাদ আস্বাদনের পরিবর্তন।

মাস্টার মহাশয় প্রথমদিকে যখন তারিখ লিখেননি, ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাস হবে। মাস্টার মহাশয় ও ঠাকুর, দক্ষিণেশ্বরে নাট মন্দিরে বেড়াচ্ছেন। শ্রীরামকৃষ্ণের গানের মাধুর্য তিনি আপ্লুত। তাঁর ঈশ্বরের প্রতি সরল বিশ্বাস ও বালকের মতো মায়ের কাছে আবদার আগে এমনটি মাস্টার মহাশয় কখনও দেখেননি। তাই তিনি যেন ঠাকুরের প্রতি একটা প্রবল আকর্ষণ বোধ করছেন। আবার এসেছেনও ঠাকুরের কাছে তাই। ঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন, “আমাকে তোমার কি বোধ হয়?”
শ্রীরামকৃষ্ণ জেনে নিচ্ছেন, মাস্টার মহাশয় এর তাঁর সম্বন্ধে ধারণা কি? তিনিও শ্রীরামকৃষ্ণকে বোঝার চেষ্টা করছেন কিনা। রামকৃষ্ণ অনুধ্যান করছেন কিনা। মাস্টার মহাশয়ের বোঝার উপর অনেক নির্ভর করে; তাঁর আগামী পরিকল্পনা। সেই জন্য আবার জিজ্ঞাসা করছেন, “আমার কয় আনা জ্ঞান হয়েছে?” (কথামৃত পৃঃ ৩২)
যে কারণে উপনিষদ বলছেন, “তাঁকে সকলে জানতে পারে না, ইন্দ্রিয় দিয়ে জানা যায় না। তিনি এ সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে অতীত সত্ত্বা।” শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং তত্ত্বকে জেনে এতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন। তাঁকে মাস্টার মহাশয় কি করে বোঝাবেন! তিনি ভাবের ঘরে চুরি না করে যা অনুভব করছেন তাই প্রকাশ করেন। ঠাকুর বুঝে গিয়েছেন, যে শিক্ষক রেখে ঢেকে বলার মতো লোক নয়। মাস্টার মহাশয় বললেন, ‘আনা’ একথা বুঝতে পারছি না, তবে এরূপ জ্ঞান বা প্রেম ভক্তি বা বিশ্বাস বা বৈরাগ্য বা উদারভাব কখনও কোথাও দেখি নাই।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৬৪: ভক্তের জ্ঞান যেন চাঁদের আলো, ভিতর বাইর দেখা যায়

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ

অনন্ত ব্রহ্ম তার সীমা পাওয়া যায় না, আবার ভক্তের কল্যাণে তিনি শরীর ধারণ করেন ও লীলা করেন। সেই পূর্ণ ব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণ রূপে এসেছেন অর্জুন স্তব করছেন। জ্ঞানী অবতার মানেন না, কারণ ব্রহ্ম কোন পরিণাম রহিত। তিনিই প্রকাশিত রয়েছেন। শুধু জ্ঞানী ব্রহ্ম জ্ঞান লাভে তাঁর সাথে এক হয়ে যান। যারা ব্রহ্মকে জানেন তারা ব্রহ্মই হয়ে যান। সকলেই এক চৈতন্য সত্তা সমভাবে প্রকাশিত।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, আমি সাকারবাদীর কাছে সাকার, আবার নিরাকার বাদীর কাছে নিরাকার। তিনি যে অনন্ত ভাবময়। সবার একই রকম ভাবের নয়। তিনি নিজেই সেই রঙের গামলা, যার যে রঙের কাপড় লাগবে তাকে সেই রঙে কাপড় চুবিয়ে দেন। যেকোনও ধর্ম ভাবের লোক আসুক না তিনি তাদের ভাবেরই অন্তহীন মানুষ হয়ে দাঁড়ান। মাস্টার মহাশয় সহাস্যে কথাটি বলছেন, “যাঁর কথা হচ্ছে তিনি, ঈশ্বর যেমন অনন্ত আপনিও তেমনি অনন্ত। আপনার অন্ত পাওয়া যায় না।”
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৩: ‘সুরের পরশে’ তুমি-ই যে শুকতারা

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৯: কামিনী রায়, জনৈক বঙ্গমহিলা

যখন ব্যষ্টি-চৈতন্য সমষ্টি চৈতন্য এক হয়ে যায়, এক চৈতন্যই অবস্থান করে, তারা পৃথক অস্তিত্ব থাকে না। সে কারণে অন্তহীন, অক্ষর, অদ্বৈত থাকে; তাকে বুঝবে কে? তিনি তো সবাইকে দেখেন বুঝেন ও অনুভব করেন। তিনি দাবি করেন বিরাট স্বরূপ তাঁর। জগৎ তাঁর হতে সৃষ্টি ও তাঁতে বিনাশ প্রাপ্ত হয়। তিনি জগৎ রূপে পরিব্যপ্ত।

শ্রী রামকৃষ্ণ বলছেন, জ্ঞান হলে সংসার আসক্তি চলে যায়, কামিনী কাঞ্চনে উৎসাহ সব চলে যায়। তার যত কাছে যাওয়া যায় ততই শান্তি লাভ করা যায়। নিকটে গেলে শীতল বোধ হয়। আনন্দ লাভ হয়। এ জগৎ তাঁর, তিনি চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন। তিনি আছেন বলে সব আছেন। তিনি বিম্ব আর সব তার প্রতিবিম্ব। এক এর শূন্য দিলে সংখ্যা যেমন বেড়ে যায়।
আরও পড়ুন:

বিচিত্রের বৈচিত্র: হে নূতন…

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৮: যুগান্তরেও রামচন্দ্র, পুরুষোত্তমরূপে প্রসিদ্ধ কেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ অনুধ্যানে মাস্টারমশাই দেখছেন, সেই অনন্তের আর এক প্রকাশ ঠাকুরের মধ্যে। তিনি তাঁর স্বরূপ ও ব্রহ্ম, এক করে অনন্তের সন্ধান দিচ্ছেন। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের পয়লা জানুয়ারি শ্রীরামকৃষ্ণ প্রাণকৃষ্ণ ও মাস্টার মহাশয়ের সঙ্গে কথা বলছেন। অনেকে এমন আছেন অনেক উচ্চ স্তরের কথা বলেন। অথচ ঘরবাড়ি টাকা মান দেহসুখ নিয়ে থাকে। অর্থ এই যে, বলা কথার সঙ্গে কাজের মিল থাকে না। যখন জ্ঞান লাভ হয় তখন এ সকলের প্রতি আগ্রহ থাকে না, আসক্তি থাকে না। অন্তরে তখন শান্তি বোধ করে। ঈশ্বর সান্নিধ্যে মনের মধ্যে আত্যন্তিক শান্তি এনে দেয়। তখন জগতের কোন বিষয়ে শান্তি বিঘ্নিত পারে না। এরপর ঠাকুর নিজ স্বরূপের পরিচয় দিচ্ছেন। জগতে প্রকাশ আছে ঈশ্বর আছেন বলে । জীব বা চতুর্বিংশতি তত্ত্ব এ সকল ব্রহ্মে স্থিত হয়ে রয়েছে। তাঁকে বাদ দিলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না।

ঠাকুর বলছেন, “একের পিঠে অনেক অনেক শূন্য দিলে সংখ্যা বেড়ে যায়। এক কে পুছে ফেললে শূন্যের কোন পদার্থ থাকে না।” (কথামৃত পৃঃ ১৩৪) প্রাণকৃষ্ণ ও মাস্টারকে কৃপা করার জন্য ঠাকুর নিজের স্বরূপ এর ইঙ্গিত কে দিলেন। তিনি এ সময়ে এক; যাঁর পিঠে অসংখ্য শূণ্য অর্থাৎ লীলা পার্ষদ সংসারে এসেছে। এর অর্থ কে বুঝবে! স্বয়ং শরীর ধারণ করেছেন লীলা করার জন্য।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content