রবিবার ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব। ছবি: সংগৃহীত।

ভগবত তত্ত্ব সকলের বোধগম্য হয় না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একে গুঢ়তত্ত্ব বলেছেন। অদ্ভুত অনন্য সে তত্ত্ব অনেকে না বুঝেই অন্যকে আবার বোঝানোর চেষ্টা করেন। মুণ্ডকোপনিষদ-এ উল্লেখ আছে, “অবিদ্যায়ামন্তরে বর্তমানাঃ স্বয়ং ধীরাঃ পন্ডিতন্মন্যমানাঃ। জঙ্ঘন্যমানাঃ পরিযন্তি মূঢ়া অন্ধেনৈব নীয়মানা যথান্ধাঃ।।” (মুঃউ ১|২|৮) অবিদ্যার অন্ধকারে মধ্যে ডুবে রয়েছে এমন ব্যক্তি নিজেদের জ্ঞানী, পণ্ডিত বলে মনে করে। বহু অনর্থে পীড়িত হতে হতে অন্ধের দ্বারা পরিচালিত অন্ধের মতো পরিভ্রমণ করতে থাকে।
যিনি তাঁকে উপলব্ধি করেন তিনি চুপ হয়ে যান। উপনিষদে আছে সেই উপাখ্যান, এক ঋষির দুই পুত্র ছিল। তারা প্রত্যেকে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য গুরুর গৃহে গমন করেন। ফিরে আসলে পিতা তাদের প্রশ্ন করলেন, তোমরা যে উদ্দেশ্যে গিয়েছিলে তা সফল হয়েছে কি? ছোট পুত্র ব্রহ্ম সম্বন্ধে অনেক তত্ত্ব কথা পিতাকে শুনিয়ে বোঝাতে চাইলেন তিনি জ্ঞান লাভ করেছেন। কিন্তু বড় পুত্র তিনি পিতার প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। পিতা বুঝলেন তার বড় পুত্রেরই ঠিক ঠিক জ্ঞান লাভ হয়েছে। ব্রহ্ম যে কী, তাকে ব্যাখ্যা করা যায় না।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, “যিনি জ্ঞানী তিনি নম্র হন। কিন্তু হীন বুদ্ধি গর্বভাবে আপনাকে সকলের উপর ভাবে। তত্ত্ব জ্ঞানপ্রাপ্ত হলে মানুষের পূর্ব স্বভাব বদলে যায়।” যেমন আলু, পটল সিদ্ধ হলে নরম হয়। কাঁচা অবস্থায় শক্ত থাকে। কাঁচা অবস্থায় গর্ব, অভিমান, অহংকারে মানুষের মন অশুদ্ধিতে ভরে থাকে। তবে কেউ যদি ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়, তবে তার সে ভাব কেটে যায়।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৩০: ভগবানের মর্যাদাই ভক্তের মর্যাদা

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৪: রাজ পরিবারের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক ও ব্রাহ্মবাদ

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন, “জ্ঞানী কেবল ঈশ্বরের কথা ভালোবাসে, বিষয়ের কথা হলে তার বড় কষ্ট হয়। কিন্তু বিষয়ীরা আলাদা লোক, তাঁদের অজ্ঞানতার পাপড়ি খসে না। তাই ঘুরে ফিরে ওই বিষয়ের কথা এনে ফেলে। বিষয়বুদ্ধি ত্যাগ না করলে চৈতন্য হয় না। সরল না হলে তাকে পাওয়া যায় না। জনক রাজা অমনি মুখে বললেই হয় না, নির্জনে কত তপস্যা করেছিলেন। জনক নির্লিপ্ত বলে তার আরেকটা নাম বিদেহ। কি না দেহে দেহ বুদ্ধি নাই। জনক সংসারের থেকেও জীবন মুক্ত হয়ে বেড়াতেন। দেহ বুদ্ধি যাওয়া অনেক দূরের কথা। খুব সাধনা চাই। সরল বিশ্বাস ও অকপটতা থাকলে ভগবান লাভ হয়।”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৯: গাধা পিটিয়ে ঘোড়া

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭: সুন্দরবনের লুপ্ত রাষ্ট্র গঙ্গারিডি

এক জন লোকের এক সাধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। লোকটি বিনীত হবে সাধুর নিকট উপদেশ প্রার্থনা করলেন। সাধু বললেন, ভগবানকে প্রাণ মন দিয়ে ভালোবাস। লোকটি বলে, ভগবানকে কখনও দেখিনি তার বিষয়ে কিছু জানি না, কি করে তাঁকে ভালবাসবো? শুধু জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কাকে ভালোবাস? লোকটি বললে আমার কেউ নেই, শুধু একটা ভেড়া আছে। ওকেই ভালোবাসি। সাধু বললেন, ওই ভেড়ার ভিতর নারায়ণ আছেন। ওকেই প্রাণ মন দিয়ে সেবা করলে ও ভালোবাসবে। এই বলে সাধুটি চলে গেলেন। লোকটিও ওই ভেড়ার ভিতর নারায়ন আছেন বিশ্বাস করে মনে প্রাণে তাহার সেবা করতে লাগলো।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬৬: ঈল মাছের এই রহস্য নিশ্চয়ই একদিন উদঘাটন হবে

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১৬: কাউকে অপদস্ত করতে হলে তাঁকে নারীঘটিত বিষয়ে জড়িয়ে দিতে হয়

ওই সাধু বহুদিন পরে সে রাস্তায় ফিরে যাওয়ার সময় লোকটির সন্ধান করে তাঁর জিজ্ঞাসা করলেন, এখন কেমন আছো? লোকটি প্রণাম করে বললেন, আপনার কৃপায় বেশ আছি। আপনি যেমন বলেছিলেন, সেইরূপ করে ভেড়ার ভিতর এক অপরূপ সুন্দর মূর্তি দেখতে পাই। তাঁর চার হাত। তাঁকে দর্শন করে আমি পরম সুখেই আছি।

শ্রীশ্রী ঠাকুর বলছেন, “সরলতা লাভ করা পূর্বজন্মের অনেক তপস্যা না থাকলে হয় না। দেখ না, ভগবান যেখানে অবতীর্ণ হয়েছেন সেইখানেই সরলতা। দশরথ কত সরল। নন্দ ঘোষ কত সরল। ভগবানের সরলতা প্রিয়। তাঁকে সরল শুদ্ধ মনে সোজা পথে ডাক, নিশ্চয়ই তাঁকে পাবি।” বৃথা তর্কে কী লাভ, সরল ভাবে ভগবানকে ডেকে নিজের কাজ গুছিয়ে রাখা ভালো।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content