শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব। ছবি: সংগৃহীত।

কোন অবস্থাতে ঈশ্বর লাভ হতে পারে? অমৃতকুণ্ডে যে কোনও প্রকারেই হোক একবার পড়তে পারলেই অমর হওয়া যায়। কেউ যদি স্তব-স্তুতি করে পড়ে, সেও অমর হয়। আর যদি কাউকে জোর করে বা কোনও ভাবে ফেলে দেওয়া হয়, সেও অমর হয়। ”এমনই ভগবানের নাম যে কোনও প্রকারই হোকও করলেই তার ফল হবেই হবে।”

নিষ্ঠা আচরণের মধ্য যেন কোনও ফাঁক না থাকে। যদি সত্য সত্যই ভগবান লাভ হয় সে নির্মল পবিত্র হয়ে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেন, “তরঙ্গ পূর্ণ ময়লা জলের মধ্যে চন্দ্রবিম্ব যেমন খণ্ড খণ্ড দেখায়; সংসারী মানবের অন্তরে সেই রূপ ঈশ্বরের আংশিক আভা মাত্র দেখা যায়।”
প্রতিহিংসা পরায়ণ মানুষের হৃদয় যখন কলুষিত হয়, শত্রু ভাবাপন্ন হয় তখন সত্য বস্তু থেকে দূরের অন্য নিম্ন কোনও বস্তু নিয়ে মন দ্বন্দ্বমুখী হয়ে পড়ে। প্রতিহিংসা এমনই বিপজ্জনক যে, যতই বড় সম্রাজ্য হোক না কেন, কৌরব বংশের মতো বিশাল সাম্রাজ্যেরও ধংস করে দিয়ে ছিল। ধারণা, শক্তি কমের জন্যে উচ্চ চিন্তা, উচ্চ ভাবনা করতে মন অক্ষম হয়ে পড়ে। মনের সীমা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। নিজ স্বার্থ পূরণের মানসে নিজের ভাবনাকে একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। অন্য উচ্চ ভাবনা, ধর্ম বিষয়ে গভীর তত্ত্বকে মানতে মন রাজি হয় না। অন্তত ঈশ্বরের প্রাপ্তির অনন্ত পথ সম্বন্ধে সে ধারণা আসবে কী করে!

চার সের দুধ এক সের পাত্রে ধরবে কী করে? তখন অন্য সমস্ত ভাবনাকে অসত্য মনে হয়। যা আপদ পতিত হচ্ছে তাকে ধ্রুব সত্য মনে করে সংকীর্ণ ভাবনায় মানুষ পাক খেয়ে মরে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, “যত মত তত পথ, আপনার মতে নিষ্ঠা রাখিও। কিন্তু অপরের মতের দ্বেষ বা নিন্দা করিও না।”
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-২৯: প্রাণ ব্যাকুল হলে, ঈশ্বর দর্শন হবেই…

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৩: কোচবিহার ও রাজ পরিবার— নানা ধর্ম ও মানুষের মিশ্রণ

যখন অল্প বৃষ্টি হয়, তখন জমির জল টুক্ টুক্ করে পুকুরে পড়ে। কিন্তু অধিক বৃষ্টি হলে আর সে শব্দ থাকে না। তখন পুকুর ডোবা একাকার হয়ে যায়। অল্প বিদ্যা, বুদ্ধি দিয়ে ধর্ম বিচার করলে মানুষ মরে, কিন্তু গভীরতা জন্মালে আর সেরূপ করতে পারে না। বাসনা তাড়িত মন নিজের স্বার্থ পূরণে সদায় ব্যস্ত নিজের ভালো কিসে হয় তা বোঝে না। অপরকে ছোট করে কেউ বড় হতে পারে না। মহত্বের প্রমাণ, যে সকলের মধ্যে মহৎকে খুঁজে পায় এবং অপরের প্রশংসা শুনে সহ্য করার ক্ষমতা থাকে ও অপরের সৎ গুণের সুখ্যাতি করে। যে আত্মপ্রশংসা করে, সে তো অধম।

অপরিষ্কার আয়নাতে সূর্যালোক প্রতিফলিত হয় না, কিন্তু স্বচ্ছতে হয়। মায়ামুগ্ধ ময়লা ও অপবিত্র হৃদয় ঈশ্বরের আভা দেখতে পায় না। কিন্তু বিশুদ্ধ আত্মা দেখিতে পান। অতএব, আমাদের বিশুদ্ধ হবার চেষ্টা করতে হবে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১৫: রাজা যে কখন, কার উপর, কী কারণে সদয় হন সেটা জানা সত্যিই দুষ্কর

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৮: বাবা, ‘পিতা নোহসি’ বলো — এই কথাটি ঘুরেফিরেই কবির কানে বেজে উঠত

সবায় তাঁর দর্শন পাবে। যে আন্তরিক হয়ে তাঁকে ডাকবে সেই তাঁর দর্শন লাভে সার্থক হবে। এক পথ এই সত্য অন্য পথ নয়, এ হতে পারে না। অনন্তের ধারণা এই ছোট মস্তিষ্কে কী করে হবে। তবে যে ব্যাকুল হয়ে তাঁকে ডাকবে তিনি কৃপা করে পথ বলে দেবেন, নিয়ে যাবেন। তাঁর কৃপাও অনন্ত। পথ সকল তো অনন্তের সন্ধান দেয় মাত্র। কালে আরও কত ধর্ম পথ হতে পারে যা অনন্ত ঈশ্বরের সন্ধান দেবে। সে সব পথই সত্যের মধ্য দিয়ে অনন্তের আভাস দেবে। শ্রীমদ্ভাগবত গীতায়, শ্রী ভগবান নিজের মুখে বলেছেন অল্প বুদ্ধি, মন্দ মতি ব্যক্তিগণ আমার স্বরূপ না জেনে অবজ্ঞা করে, “অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্। পরং ভাবমজানন্তো মম ভূত মহেশ্বরম্।
আরও পড়ুন:

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৪০: গিরিশচন্দ্রের অন্যতম সেরা গীতিনাট্য ‘স্বপ্নের ফুল’

বিচিত্রের বৈচিত্র, তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম…

ভগবানের প্রশংসার প্রয়োজনীয়তা নেই। তিনি চান না যে, তাঁর মহত্ত্বের কাছেও কেউ মাথা নত করুক। কিন্তু তারা ভাগ্যবান যারা তাঁকে চিন্তে পারে। প্রকৃত ভক্ত তার প্রভুর মর্যাদার কখনও লঙ্ঘন করে না। পরন্ত মর্যাদার মাধ্যমে নিজের মান বাড়ায়। ভগবানের মর্যাদাই ভক্তের মর্যাদা।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content