রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


লতা ও পঞ্চম। ছবি: সংগৃহীত।

কিশোর, আশা এবং লতা এই তিন ক্ষণজন্মার কাছ থেকে যতটা সম্ভব ততটাই নিংড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন আরডি বর্মণ। পঞ্চমকে সুরকার হিসেবে যদি সত্যিকারের বিশ্লেষণ করতে হয়, যদি নতুন কিছু শিখতে হয়, তাহলে তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিকে সমান আগ্রহে শুনতে হবে। তাঁর সুর সৃষ্টির কৌশলকে বুঝতে হবে। তবেই আমাদের কাছে পরিষ্কার হবে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা। তাহলেই আমরা অনুধাবন করবো একটি চরম সত্য। সেটি হল এই যে তিনি তাঁর ছোট্ট কর্মজীবনে যতটুকুই আমাদের উপহার দিয়ে গিয়েছেন সেটি একটি হিমশৈলের চূড়া মাত্র। আরও অনেক কিছুই বাকি রয়ে গিয়েছে।
১৯৮১ সাল পঞ্চমের আরও একটি উল্লেখযোগ্য বছর। এ বছরে একের পর এক কালজয়ী সুর সৃষ্টি করেন পঞ্চম। ‘কুদরত’ ছবির ‘হামে তুমসে পেয়ার কিতনা’ গানটিতে কিশোর হয়তো নিজের রোম্যান্টিকতার শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছেন। তিনি স্বয়ং যেন কাউকে প্রেম নিবেদন করেছেন। মজরু সুলতানপুরী এবং কতিল শিফাইয়ের লেখাও অনবদ্য। তবে এই গানটির ক্ষেত্রে পঞ্চম একটু ভিন্ন ঘরানার আশ্রয় নিয়েছেন। ছন্দের জাদু খুব একটা কানে ধরা দেয় না ঠিকই, কিন্তু মাদকতাময় মেলোডি এবং একটি মিষ্টি বেদনায় শ্রোতাদের ভরিয়ে রাখেন পঞ্চম। গানটি শোনার সময় কোনও বিঘ্ন ঘটলে একটু রাগ হয় বইকি!
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৮: প্যায়ার করনে ওয়ালে প্যায়ার করতে হ্যায় শান সে— আশার কণ্ঠ ও আরডি-র সুর, অনবদ্য

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৭: তোমায় পড়েছে মনে আবারও…

আরও একটি মন মাতানো গান ‘তুনে ও রঙ্গিলে ক্যায়সা জাদু কিয়া’ গানটি গাওয়ানো হয় লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে। অসম্ভব একটি মিষ্টি সুরের আড়ালে কোথাও কানে ধরা পরে একটি পাহাড়ি ধুন। নায়িকা হেমা মালিনীর সঙ্গে লতার কণ্ঠকে সম্পূর্ণ ভাবে মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতে দেখতে পাওয়া যায়।এবং এই গানটির ক্ষেত্রেও পঞ্চমকে একটু ভিন্ন রূপে পাই আমরা।

আশা ভোঁসলে গান ‘সাজতি হ্যায় ইঁউ হি মেহফিল’ গানটি। সেমি ক্লাসিক্যাল এই গানটি পঞ্চমের এক অনবদ্য সৃষ্টি। সুরটি যে তাঁর অর্ধাঙ্গিনী আশার কথা মাথায় রেখেই তৈরি করেছিলেন পঞ্চম, গানটি শুনলেই তা বোঝা যায়। আশার তেমনই উপস্থাপনা। বারবার শুনতে ইচ্ছে হয়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৭: নাক বন্ধ হলেই নাকের ড্রপ? এতে শরীরে কোনও ক্ষতি হচ্ছে না তো?

মুক্তি পায় ‘রকসা’ ছবিটি। এই ছবিতেও গায়িকা হিসেবে পঞ্চম বেছে নেন তাঁর স্ত্রীকেই। ‘নয়ে পুরানে সাল মে’ গানটিতে আশা এবং কিশোরকে গানের কিছু অংশ স্ট্যাকাটোর ঢংয়ে গাইতে শোনা যায়। যেটি এখনও অবধি তাঁদের কণ্ঠে শোনা যায়নি। অর্থাৎ আবার একটি অভিনবত্বের ছোঁয়া। গায়ক যখন কিশোর এবং গায়িকা যখন আশা, নতুন কিছু না হলেই যে চলে না! তাই পঞ্চমের এই প্রচেষ্টা।

যদি ধরা যায় ‘জানি দিলবার জানি’ গানটির কথা। ক্যাবারের ছোঁয়ায় আলোকিত এই পার্টি সংটিতে আমরা পাই পঞ্চম-আশার যৌথ কর্মকাণ্ডের আরও একটি উদাহরণ। নায়িকা পারভিন বাবির উচ্ছলতাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে আশার দুষ্টুমিষ্টি কণ্ঠ। যার নেপথ্যে সেই পঞ্চম।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৫: ‘আপনজন’ Chronicles

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১১: মাতৃরূপে প্রথম পুজোগ্রহণ

‘মিল গায়ে দিল মিল গায়ে’ গানটি কিশোর-আশা দৈতকণ্ঠে গেয়েছেন ঠিকই কিন্তু এই গানটিতে কোথাও যেন পঞ্চম নিজেকে নিজের ঘরানা থেকে একটু সরিয়ে রেখেছেন। কেউ বলে না দিলে এটি যে পঞ্চমেরই সৃষ্টি সেটি অনুধাবন করা কঠিন হয়ে পড়ে! বেশ কিছু অংশে ছন্দ তো বটেই, এমন কি গানটির প্রবাহও কিঞ্চিৎ ভিন্ন ধাঁচের। এক কথায়, এ এক অন্য পঞ্চম।

একই কথা এই ছবির আরেকটি গান অর্থাৎ, ‘তেরে লিয়ে মেরে লিয়ে’র ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। গানটি কিশোরকে দিয়ে গাওয়ানো হলেও কোনও এক অজানা কারণে এই গানটিতেও সেই পরিচিত পঞ্চম ধরা দিতে নারাজ। তাঁকে আমাদেরই খুঁজে নিতে হবে। ‘কাচ্চে হিরে’ ছবির ‘ছাড়ি জওয়ানি’ গানটি কি অসাধারণ গেয়েছেন আশা! অনেকটাই পাঞ্জাবি গানের ধাঁচে সুরটি রচনা করা হয়েছে এবং রাহুল-জায়া গেয়েছেনও সর্বস্ব দিয়ে। বলতে পারেন আশা-ম্যাজিক।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৬: ‘কোনওদিন কিছুই ছিল না, কিছুই কিছুই নেই আমাদের আজ’

পরিযায়ী মন, পর্ব-৬: বৈতরণীর পারে…

এই ছবির ‘হারে না ইনসান’ গানটির কথাই একবার ভাবুন তো! খানিকটা সাসপেন্সের ধাঁচে প্রেলুডটি শুরু হচ্ছে এবং তারপর কিশোরের সেই ম্যানলি কণ্ঠস্বর যেটি কিনা পুরো গানটি জুড়ে রাজত্ব করে যাচ্ছে। ইন্টারলুডও ঢেলে সাজিয়েছেন পঞ্চম। আর গানটির সুরটিকে যে ভাবে মডিউলেট করা হয়েছে সেটি এক কোথায় অসাধারণ। সঙ্গে রয়েছে পুরুষ কণ্ঠে করাসের জাদু। সার্বিকভাবে বলতে গেলে অদ্বিতীয়।

‘মেরে ঝুমকে কা’ গানটির ক্ষেত্রে পঞ্চমের আশাকেই প্রয়োজন। কারণ, বুঝতে খুব বেশি অসুবিধে হয় না। নায়িকা একটি মজলিশে এই দুষ্টু মিষ্টি গানটিতে লিপ দিচ্ছেন। আর তাই আশা ব্যতীত অন্য কারও কথা যে পঞ্চমের মনে পড়বে না সেটিই তো স্বাভাবিক।—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content