বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


পঞ্চম ও আশা।

চলতে থাকে কর্মযোগ। কাজ আসতে থাকে একের পর এক। সুর রচনা করেন ‘ধন দৌলত’ ছবির গানগুলি। জনপ্রিয় হয় কিশোর-আশার দ্বৈত কণ্ঠে গাওয়া ‘জিনা কেয়া আজই পেয়ার বিনা’, ‘হো যায় ফির উস দিন কা’, ‘ওহ জিন কি নেয়ি হ্যায় দুনিয়া’ গানগুলি। আশাকে দিয়ে গাওয়ানো হয় ‘শিকোয়া কই তুমসে না হ্যায় তুম পে কই জোর’ গানটি। অসম্ভব সাড়া ফেলে গানটি। পরবর্তীকালে, এই একই সুর পঞ্চম একটি বাংলা ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন। গাইয়েছিলেন সেই আশাকে দিয়েই। গানটি হল ‘কথা হয়েছিল তবু কথা হল না’। সেই ছবির কথায় পরে আসবো।
‘টক্কর’ ছবির ‘দুনিয়া কেয়া হ্যায় দৌলত কেয়া হ্যায়’ গানটি খুবই ন্যায্য কারণে আবার গাওয়ানো হয় আশাকে দিয়ে। পঞ্চম ব্র্যান্ডের রিদম, চটকদার প্রেলুড এবং ইন্টারলুড, গানটি জুড়ে বেস গিটারের প্রাধান্য এবং পাশ্চাত্য ঘেঁষা বাদ্যযন্ত্রের সমবেত মূর্ছনায় শ্রোতাদের এক কথায় নির্বাক করে রাখার ক্ষমতা রাখে গানটি।

এই ছবির ‘ইয়ে তানহাইয়া’ গানটি শুনলেই বুঝে যাবেন গানটির ক্ষেত্রে আশাকে বেছে নেওয়ার কারণটি। কি অসাধারণ অভিনয় এবং রেন্ডিশন। গায়িকা স্ত্রীকে দিয়ে সুরকার স্বামী কি অসাধারণ ভাবেই না উপস্থাপিত করেছেন গানটি।

‘সিতারা’ ছবিটিতে আমরা শুনতে পাই পঞ্চমের কিছু অসাধারণ সৃষ্টি। ‘আপ আয়ে গরীবখানে মে’ গানটির কথা ভাবুন। পঞ্চম যে শচীনকর্তার সুযোগ্য পুত্র সেটির প্রমাণ গানটির আনাচে কানাচে দেখতে পাওয়া যায়। রাগের আশ্রয়ে এগিয়ে চলা আশাকণ্ঠ যেন গানটি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও প্রতিধ্বনিত হয় শ্রোতাদের কানে। গানটির মাদকতা এমনই।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৭: আশাকে নিয়ে পঞ্চমের সব প্রশ্নের জবাব চিঠিতে জানিয়েছিলেন লতা

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৬: তোমার গানের এই ময়ুরমহলে

‘সাথ সাথ তুম চলো’ গানটি গাওয়ার গুরুভার দেওয়া হয় ভূপিন্দর সিং এবং আশা ভোঁসলেকে। নায়ক মিঠুনের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে খাপ খাওয়াতেই হয়তো এক্ষেত্রে গায়ক ভূপি সাহেবকে বেছে নেওয়া হয়। গানটির মধ্যে লুকিয়ে থাকা দুষ্টুমিকে তুলে ধরতেই আশাকে নিয়োজিত করা হয়েছে।

অথচ দেখুন, এই ছবির ‘থড়ি সি জমিন থোড়া আসমান’ গানটির ক্ষেত্রে কিন্তু ভূপিন্দরের সঙ্গে গাওয়ার দ্বায়িত্ব পান লতা মঙ্গেশকর। কেন? ভালো করে গানটির দৃশ্যায়নটি একবার চাক্ষুষ করলেই বুঝে যাবেন। নায়ক এবং নায়িকা এই ক্ষেত্রে অনেকাংশেই সংযত। তাই মহিলাকণ্ঠ হিসেবে পঞ্চমের পছন্দ তাঁর লতা দিদিকে।

এ বার খেয়াল করুন, ‘ইয়ে সায়ে হ্যায় ইয়ে দুনিয়া হ্যায়’ গানটি যথেষ্টই ধীর গতির সেমি ক্লাসিক্যাল একটি গান। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আশাকে বেছে নেওয়ার প্রধান কারণ গানটির প্যাথস। নায়িকার বিরহকে আশা কি নিদারুণ ভাবেই না ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর কণ্ঠের মাধ্যমে। আর গুলজার সাহেবের রচনা? সেটি প্রসংশা করার যোগ্যতা আমার অন্তত নেই। গানের এহেন কথা, সুর এবং গায়িকার কণ্ঠ—এই তিনের মহামিলনে যে গান জন্ম নেয়, সেটির মৃত্যু কি কোনও দিনও সম্ভব?
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৭: সে কোন প্রভাতে হইল মোর সাধের ‘নবজন্ম’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৩: সুন্দরবনের গ্রামরক্ষক দেবতা আটেশ্বর

‘শান’ ছবির ‘প্যায়ার করনে ওয়ালে প্যায়ার করতে হ্যায়’-এর মতো একটি ‘পার্টি সং’ আবারও সেই আশাকেই দেওয়া হয়। পারভিন বাবির লিপে আশা সেই আবার অনবদ্য। আসে ‘আলিবাবা আউর ৪০ চোর’ ছবিটি। আনন্দ বক্সী রচনা করেন গানগুলি। প্রাণ ঢেলে সুরসৃষ্টি করেন পঞ্চম। ‘আজা সর এ বাজার’ গানটি শুনেছেন কখনও? একটি যেন স্বর্গীয় সুর। কেন বলছি? সেটি জানতে গেলে শুনতে হবে গানটি। হেমা মালিনীর লিপে এই গানটিতে লতাকেই মানায়। তাই গাওয়ানোও হয়েছে লতাকে দিয়েই। তবলার ছন্দের সঙ্গে রয়েছে বেস গিটারের ছোঁয়া এবং নেপথ্যে পঞ্চমের বহু পছন্দের সেই অব্লিগেটো। যেটি লতা কণ্ঠের আবেগকে পৌঁছে দিয়েছে সর্বোচ্চ শিখরে। আর ইন্টারলুড? সেটি নিয়ে কোনো কথাই যেন চলে না। শুধু দু’ চোখ বন্ধ করে উপভোগ করে যেতে হয় গানটিকে।

‘সারে শহর মে’ গানটির ক্ষেত্রে এবার দুই বোনেরই ডাক পরে। অর্থাৎ এবার লতা এবং আশা, দু’ জনকেই এই গানটিতে একসঙ্গে চাই পঞ্চমে। হলও তাই। গানটিতে দুই নায়িকা অর্থাৎ হেমা মালিনী এবং জিনাত আমনকে একসঙ্গে দেখা যাবে। তাই এহেন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন পঞ্চম। হেমার কণ্ঠ হয়ে ওঠেন লতা এবং জিনাতের আশা। দুজনেই যথাযথভাবে উপস্থাপিত করেন গানটি।

‘ফির ওহি রাত’ ছবির ‘বিন্দিয়া তরসে কাজরা বরসে’ গানটির মধ্যে পাওয়া যায় পঞ্চমের সৃজনশীলতার আরও একটি নিদর্শন। লতার কণ্ঠে গানটির আবেদন যেন বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ। যদি সঠিকভাবে উপভোগ করতে চান গানটিকে, তবে এটি শুনুন আলোআঁধারি কোনও একটি জায়গায়। অথবা নিঝুম রাতে। আপনার মন ছুঁয়ে যাবেই।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৭২: প্রজননক্ষম মাছের চাষে মুনাফা ভালো, তবে কোন কোন বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে?

পরিযায়ী মন: নীলনদের দেশে পিরামিড মানে অপার বিস্ময়

এই ছবিরই আরেকটি গান ‘ফির ওহি রাত আই যানে যান’ যেটির মুড সম্পূর্ণ ভিন্ন, সেটির ক্ষেত্রে কিন্তু মাঠে নামেন আশা। স্বামীর সৃষ্টি করা ছন্দের তালে নিজের কণ্ঠকে সপে দিয়ে যে গান তিনি উপহার দেন সেটি আজও সমহিমায় বেচেঁ আছে আমাদের হৃদয়ে।
‘ছালকাও ঝুমকে’ গানটিতে যেহেতু রাজেশ খান্না লিপ দেবেন। তাই কিশোরকে তো চাই-ই চাই! তাঁকে সরিয়ে রেখে এই গান কি করেই বা তৈরি করবেন পঞ্চম। শুনে দেখবেন। নায়কের অভিনয়, গানের সুর এবং গায়কের উপস্থাপনা—কেউ যেন কম যান না।
পাহাড়ি ধুনকে আশ্রয় করে কতশত গানের জন্ম দিয়েছেন পঞ্চম। তার মধ্যে একটি হল কিশোর লতার গাওয়া ‘সঙ্গ মেরে নিকলে থে সাজন’ গানটি। চোখ বন্ধ করে যদি শোনেন গানটি, আপনার মনশ্চক্ষু দিয়ে একটি পাহাড়ঘেরা অঞ্চল আপনি দেখতে পাবেনই পাবেন। মেলোডি এবং ছন্দের জোর এতটাই।

কিশোর আশার আরও দুটির জাদুর সাক্ষী হতে চান? শুনে নিন ‘রেড রোজ’ ছবির ‘কিস কি সদায়ে মুঝ কো বুলায়ে’ এবং ‘তেরে বিন জিনা কেয়া’ গান দুটি। তার সঙ্গে বাড়তি পাওনা পঞ্চমের সেই পরিচিত ছন্দ, প্রেলুড এবং ইন্টারলুডের রকমারি ইন্সট্রুমেন্টেশন।

‘বুলান্দি’ ছবির ‘অভি তো হাম হুয়ে জাওয়া’ গানটি কিশোর গেয়েছেন কিশোরের ঢং এই। অথচ মনে হবে নায়ক ড্যানিই গাইছেন গানটি। কোনও অংশে বেমানান মনে হবে না। ‘কহো কাহা চলে’ গানটি বোধহয় কিশোর-আশার অগুন্তি প্রথম সারির গানগুলির মধ্যে একটি। কি অসাধারণ সুরের বিন্যাস, বিশেষ করে অন্তরাগুলিতে। গায়ক-গায়িকা দু’ জনেই এই ক্ষেত্রে আবারও অপ্রতিরোধ্য। মেলোডি, রিদম এবং গায়কীর কোনও প্রসংশাই যেন যথেষ্ট নয়।—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content