বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


আশা, কিশোর ও আরডি। ছবি: সংগৃহীত।

বিবাহ বিচ্ছেদ এবং পরবর্তীকালে বাবাকে হারানো—এই দুটি ঘটনাই পঞ্চমকে চূড়ান্ত ভাবে ব্যথিত করেছিল। একের পর এক কাজ করে চলেছিলেন ঠিকই, তবু এক নিদারুণ একাকিত্ব তাঁকে গ্রাস করেছিল। তখন তাঁর মন হয়তো এমন একজন বন্ধুর খোঁজে ছিল, যার সঙ্গে প্রাণখুলে জীবনের সব কিছু ভাগ করে নেওয়া যায়। সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না সবই। এমন একজন যাকে জীবনের সব রকমের ওঠাপড়ায় পাশে পাওয়া যায়। বেশ কিছুদিন ধরেই পঞ্চম তাঁর জীবনে এমন একজন মানুষের অনুপস্থিতি টের পাচ্ছিলেন।

মা মীরা দেববর্মণ তো পাশে ছিলেনই, কিশোর কুমারও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন পঞ্চমের সঙ্গে। মাঝে মাঝেই তাঁরা ছোটখাটো ঘরোয়া আড্ডায় অথবা পার্টিতে মিলিত হতেন। তবু দিনের শেষে বাড়ি ফিরে মন বিশেষ কাউকে খুঁজতো। এদিকে, কাজের সুত্রে আশা ভোঁসলের সঙ্গে তাঁর একটি নির্ভেজাল বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। আশার সঙ্গে গান নিয়ে আলোচনা বা তাঁকে যে কোনও রকম গান গাওয়ার অনুরোধ অথবা আবদার, এই সবই পঞ্চম নির্দ্বিধায় করতে পারতেন। আশাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পঞ্চমের অনুরোধ অথবা আবদারে সাড়া দিতেন।
পঞ্চম ও আশার মধ্যে তৈরি হয়েছিল এক অদ্ভুত সম্পর্ক, যার সঠিক নামকরণ করা যথার্থই কঠিন ছিল। যদিও তাঁদের সতীর্থরা বেশ বুঝতে পারতেন দু’ জনের মধ্যে এই তালমিলের বিষয়টি। পঞ্চমের চরম একাকিত্বই হয়তো নিজের অজান্তেই মনে আশার জন্য একটি জায়গা তৈরি করে ফেলে। আশার ঈশ্বরপ্রদত্ত কণ্ঠ এবং তাঁদের গভীর থেকে গভীরতর হয়ে ওঠা বন্ধুত্ব পঞ্চমের মনে গায়িকার প্রতি চরম আকর্ষণ তৈরি করে। তবু বিষয়টি তিনি সন্তর্পণে গোপনই রেখেছিলেন। এমন কি আশাকেও এ নিয়ে কোনও ইঙ্গিত দেননি। মনের কথা মনেই লুকিয়ে রেখে ব্যস্ততার সাগরে ডুবিয়ে রাখতে থাকেন নিজেকে।

১৯৭৯ সাল। শুরু হয় পঞ্চমের আরও একটি কর্মময় বছর। ‘জুরমানা’ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গাওয়ানো হয় একটি কালজয়ী গান ‘শাওন কে ঝুলে পড়ে, তুম চলে আও’। এই পঞ্চম কিন্তু একেবারে অন্য পঞ্চম। কেন? এর প্রধান তিনটি কারণ হল—সুরের কাঠামো, গানের প্রবাহ এবং বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। গানটির মধ্যে দিয়ে কোথাও যেন তিনি আমাদের শচীন কর্তার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি যে শচীনদেব বর্মণের সুযোগ্য পুত্র এই গানটি তারই সাক্ষ্য বহন করে।
আরও পড়ুন:

পর্ব-২১: পঞ্চমের সুরের মাদকতায় বুঁদ হয়ে আশা গাইলেন সেই তোলপাড় করা গান ‘পিয়া তু আব তো আজা…’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭: সুন্দরবনের লুপ্ত রাষ্ট্র গঙ্গারিডি

এই গানের কথার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা আবেগকে কী অসাধারণ ভাবেই না তুলে ধরেছেন পঞ্চম! গায়িকার কণ্ঠে হালকা ইকো এফেক্টের সঙ্গে অব্লিগেটোর অসাধারণ প্রয়োগ গানটিকে অনন্য করে তুলেছে। এই রকমের একটি দৃশ্যে এবং সুরে লতাকে বাদ দিয়ে অন্য কারও কথা হয়তো ভাবতেই পারেননি পঞ্চম।

এই ছবির ‘নাচু ম্যায় গাও তুম’ গানটি কিন্তু গেয়েছেন পঞ্চম এবং আশা। গানটি একশো শতাংশ পঞ্চম ঘরানার। বঙ্গ, ড্রাম, ট্রাম্পেট, স্যক্সো ফোন, ভায়োলিন, চেলো —কী নেই। সেই সঙ্গে আশার প্রাণোচ্ছল দুষ্টুমিষ্টি উপস্থাপনা। গানটি কানে এলেই বুঝে যাওয়া যায় এর সুরকার পঞ্চম ছাড়া আর কেউ নন।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬৬: ঈল মাছের এই রহস্য নিশ্চয়ই একদিন উদঘাটন হবে

অজানার সন্ধানে: এই ভূতুড়ে দ্বীপে তিনিই একমাত্র মহিলা, দিন কাটে দাগি অপরাধীদের সঙ্গে, ‘দ্বীপের রানি’র কেন এমন সিদ্ধান্ত?

‘বলো কী আছে গো তোমারই আঁখিতে’ গানটি অনেকেরই শোনা। পঞ্চমের নিজের সুরে গাওয়া সেই বিখ্যাত বাংলা গান। সেই একই সুর পঞ্চম ব্যবহার করেন ‘আই সখী রধিকে’ গানটিতে। গানটি গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর এবং মান্না দে। যথারীতি দুই কিংবদন্তি শিল্পী তাঁদের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করে এমন একটি অসাধারণ গান আমাদের উপহার দিয়েছেন।

‘ছোটি সি এক কলি খিলি থি’ গানটি না শুনে থাকলে পঞ্চমের এক অভাবনীয় সৃষ্টির রসাস্বাদন করা থেকে নিঃসন্দেহে বঞ্চিত হবেন। গানের কথার জন্য যেমন আনন্দ বক্সীকে কুর্নিশ জানাতে হয়, ঠিক তেমনি কৃতিত্বের দাবিদার পঞ্চমও। মেলোডি, আবেগ, ছন্দ এবং গানের প্রবাহের মধ্যে আবারও আমরা খুজে পাই সুরসম্রাট পঞ্চমের প্রতিভার নিদর্শন। সঙ্গে লতার সেই খানদানি কণ্ঠের জাদু। গানের যে যে অংশে তিনি তাঁর কণ্ঠকে ক্রেসেনডোতে নিয়ে গিয়েছেন, সেই সেই মুহূর্তে আমরাও যেন কোথাও হারিয়ে গিয়েছি। গানটি শুনে একবার দেখতে পারেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪: শুভ পরিণয়বেলা

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১৫: রাজা যে কখন, কার উপর, কী কারণে সদয় হন সেটা জানা সত্যিই দুষ্কর

‘নকর’ ছবির ‘পল্লু লটকে’ গানটি কিন্তু আবার পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের। খানিকটা পঞ্জাব প্রদেশের গানের ধাঁচে তৈরি সুরে আশা এবং কিশোর অনবদ্য। লতা-কিশোরের যৌথ কণ্ঠে কাওয়ালি শুনতে চান? শুনে নিন ‘সালাম মেমসাব’ ছবির ‘হাম ভি রাহ মে খাড়ে হ্যায়’ গানটি। শুনলে মনে হবে গায়ক-গায়িকা দু’ জনেই কাওয়ালি বিশারদ। তাঁরা যেন শুধুই কাওয়ালিই গেয়ে থাকেন। গানের শুরুতে কিশোরের অভিনয় মাখানো আলাপটিও অসাধারণ।

আবার আশার গাওয়া ‘তেরা কাহা ম্যায়নে কিয়া’ গানটিতে খুঁজে পাওয়া যায় সেই পরিচিত পঞ্চমকে। উত্তেজক ছন্দ, আশার চনমনে উপস্থাপনা এবং সার্বিক অ্যারেঞ্জমেন্ট গানটিকে করে তুলেছে অসাধারণ। আশার কণ্ঠে এই ছবিরই ‘তুম ভি মেরি জান’ গানেও পঞ্চম বাজিমাত করেছেন।

‘ঝুটা কাহিকা’ ছবিতে আবারও সেই পঞ্চম-জাদু। তাঁর নিজেরই সুরারোপিত এবং গাওয়া বাংলা গান ‘শোনো মন বলি তোমায়’ গানটির সুরেই ‘জীবন কে হার মোড় পে’ গানটি আমাদের উপহার দেন পঞ্চম। ঋষি কাপুর এবং নীতু কাপুরের লিপে কিশোর-আশা আবার অপ্রতিরোধ্য। ইলেকট্রিক গিটারের স্ট্রামিং দিয়ে শুরু হওয়া এই গান গাওয়ার জন্য নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ জুটি এঁরা দু’জনই। সেই জন্যই তো পঞ্চম আর দ্বিতীয়বার ভাবেননি অন্য কারও কথা। —চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content