সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


‘রিমঝিম রিমঝিম, রুমঝুম রুমঝুম, ভিগি ভিগি রুত মে, তুম হাম হাম তুম’। কুমার শানু এবং কবিতা কৃষ্ণমূর্তি দু’জনেই নিজেদের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে গানটি গেয়েছেন তো বটেই। কিন্তু গানটির সার্বিক অ্যারেঞ্জমেন্টটি যদি খুব সূক্ষ্ম ভাবে লক্ষ্য করা যায়, বিস্মিত তো হতেই হয়! গানের দৃশ্যটি যদি আপনি নাও দেখেন, শুধু প্রিলুডটিই আপনাকে দিয়ে যাবে বারিধারায় সিক্ত হয়ে ওঠার অনুভূতি। আর বাকি কাজটি করে দেবে অবশিষ্ট গানটি। আমাদের মানসচক্ষে ভেসে উঠবে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরে পরার একটি মনোরম দৃশ্য। তাল ধরে রাখছে তবলা। তার সঙ্গে স্যাক্সোফোনের রোম্যান্টিক টাচ। সন্তুর যেন শুধু বৃষ্টির কথাই বলে চলে। মূলত, মনোহারি সিং এবং বাবলু চক্রবর্তীকে সঙ্গে নিয়েই এই গানটিকে এবং এই ছবির বাকি গানগুলিকে অ্যারেঞ্জ করেন আর ডি বর্মণ। আর সঙ্গে ছিল তাঁর চিরসাথী ‘মেলোডি’। যে ‘মেলোডি’ তাঁকে কোনওদিনও ধোঁকা দেয়নি। যে ‘মেলোডি’ বাংলার একরত্তি টুবলুকে করে তুলেছিল স্বনামধন্য বিশ্ববরেণ্য পঞ্চম।

তেমনই অবিস্মরণীয় আর একটি গান ‘দিল নে কাহা চুপকে সে, পেয়ার হুয়া চুপকে সে’। কবিতা কৃষ্ণমূর্তির গাওয়া এই গানটিতে তবলার উপর ড্রাম স্টিক দিয়ে যে শব্দ সৃষ্টি করা হয়েছে সেটি পঞ্চমের পক্ষেই সম্ভব। আর সেতারের ব্যবহার রীতিমত আলোচ্য একটি বিষয়। এক কথায় অভিনব।
এই ছবির আরও একটি কালজয়ী গান ‘এক লড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লগা’কে নিয়ে খুব মজার একটি গল্প বলেছিলেন কবি জাভেদ আখতার। সম্ভবত কোনো একটি অনুষ্ঠানে অথবা সাক্ষাৎকারে। ‘১৯৪২ আ লাভ স্টরি’ ছবির জন্য একটি গান তৈরি করে মিউজিক সিটিংয়ে সবাই মিলে একদিন বসার কথা ছিল। তারিখটিও সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। যে সিটিংয়ে থাকবেন পঞ্চম, তাঁর দলের সদস্যরা সবাই এবং পরিচালক স্বয়ং। জাভেদ সাহেবকে সেই দিনের জন্য তাঁরা একটি গান লিখে নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। যাতে গানটিকে সুরে ফেলে অন্তত একবার রিহার্সাল সেরে ফেলা যায়।

যথারীতি সময়মতো সেদিন সবাই পঞ্চমের বাড়িতে উপস্থিত। কিন্তু জাভেদের দেখা নেই। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন জাভেদ এসে পৌঁছলেন না, তখন বাধ্য হয়ে তাঁকে ফোন করা হল। এদিকে জাভেদ আখতার তো বেমালুম ভুলে গিয়েছেন। এমনকি গানটিও তখনও লেখা হয়নি। সর্বনাশ! এ বার কী হবে তাহলে? সবাই যে সেদিন তাঁরই জন্য প্রতিক্ষারত! ফোন পেয়ে উপস্থিত বুদ্ধি প্রয়োগ করেন তিনি। বলেন, তিনি পঞ্চমের বাড়িতে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছচ্ছেন। এদিকে তাঁর তো মাথায় বাজ পড়ার জোগাড়! তবু নিজেকে কিছুটা সামলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন পঞ্চমের বাড়ির উদ্দেশ্যে। পৌঁছে সটান চলে গেলেন মিউজিক রুমে। ঢুকেই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, তিনি গাড়ি চালাতে চালাতে একটি লাইন মনে মনে ভেবেছেন। যদি বাকিরা সম্মতি দেন তবে তিনি তখনই গানের বাকি অংশটুকু লেখা শেষ করবেন। কথাটি শুনে বাকিরা কেউই বিন্দুমাত্র অবাক হননি। কারণ খেলার ছলে, খুব দ্রুত গান রচনা করার তাঁর সেই বিরল ক্ষমতার কথা বাকিদের অজানা ছিল না।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬৮: কুছ না কহো, কুছ ভি না কহো…

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা

জাভেদ প্রথম লাইন যখন সবাইকে শোনালেন, সবাই প্রায় সমস্বরেই তাঁকে বলে উঠলেন তক্ষুনি গানটির লেখা সম্পন্ন করতে। গান লেখা তো শেষ হল। গানটি নিজের মতো করে বাংলায় লিখে নিলেন পঞ্চম। বসলেন নিজের হারমোনিয়াম নিয়ে। এক মুহুর্ত না ভেবে, সবাইকে অবাক করে দিয়ে তখনই গাইতে শুরু করলেন গানটি। সবাই তখন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন পঞ্চমের দিকে। আর তিনি চোখ বন্ধ করে গেয়ে চলেছেন— ‘এক লাড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লাগা, জ্যায়সে খিলতা গুলাব…’।

ভাবা যায়? সদ্য লেখা একটি গান। সুরকারের কাছে কোনও পূর্বাভাস ছিল না গানটি সম্বন্ধে। গানটিকে নিয়ে ভাবার কোনও সময়ও পাননি তিনি। অথচ এমন ভাবে গাইছেন যেন, গানটি তাঁর কতই না পরিচিত। জাভেদ আখতারকে অজস্র ধন্যবাদ। ঘটনাটির অবতারণা তিনি না করলে আমাদের আজও হয়তো অজানাই রয়ে যেতো। পরবর্তীকালে কেদারনাথ ভট্টাচার্য, অর্থাৎ কুমার শানু যখন রেকর্ডিং করেন গানটি, সেটি একটি অন্য মাত্রায় পৌঁছয়। তাঁর কণ্ঠের টেক্সচার খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, সেটি তাঁর ঈশ্বরপ্রদত্ত কণ্ঠের থেকে একটু হলেও ভিন্ন। সব মিলিয়ে গানটির জনপ্রিয়তা এক অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছয়। যে গানের প্রাসঙ্গিকতা এবং জনপ্রিয়তা আজকের তারিখেও একই উচ্চতায় বিরাজমান।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭১: সাইকেল ও জীবন

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫১: জয়রামবাটির যথার্থ রক্ষয়িত্রী

প্রসঙ্গত, কুমার শানু এক সাক্ষাৎকারে এই ছবির গান রেকর্ডিং সম্পর্কে অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিলেন। একদিন তিনি ঠিক সময় মতো রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে পৌঁছে গিয়েছেন। সেখানে উপস্থিত পঞ্চম এবং তাঁর সতীর্থরা। শানুর কথায়, সেদিন নিজের আবরণ সম্পর্কে খুব একটি যত্নবান হয়ে রেকর্ডিং করতে যাননি। গাল ভর্তি দাঁড়ি। মাথার চুল উস্কোখুস্কো। পোশাকও খুবই নৈমিত্তিক। পঞ্চম লক্ষ্য করেন সেটি। শানুকে আরডি বলেন, সেদিন রেকর্ডিং হবে না। তাঁকে আর একদিন আসতে অনুরোধ করেন রেকর্ডিংয়ের জন্য। তবে এও বলেন, সেই দিন তিনি যেন অবশ্যই নিজেকে আয়নায় ভালো করে দেখে তারপর আসেন। পরের নির্দিষ্ট দিনে রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে ঢোকেন শানু। এই শানুকেই তো চেয়েছিলেন পঞ্চম! পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল, গাল চকচক করছে। ধোপদুরস্ত পোশাক-আশাক। এমনকি পায়ের জুতোজোড়াও কারও নজর এড়াচ্ছে না।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৪: পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে

শানুকে রেকর্ডিং রুমে নিয়ে যান পঞ্চম। শেষ হয় রেকর্ডিং। গায়ক এবং সুরকার তো যারপরনাই খুশি। সেইদিন পঞ্চম শানুকে খোলসা করে আসল কথাটি বলেন। তিনি বলেন, সংগীত হল অনেকগুলি সাধনার মধ্যে একটি। অন্য সাধনাগুলির ক্ষেত্রেও যেমন শরীর এবং মনের পরিচ্ছন্নতা বাঞ্ছনীয়, সংগীতের ক্ষেত্রেও তাই হওয়া উচিত। যদি গায়ক হিসেবে নিজেকে একশো ভাগ বিলিয়ে দেওয়া সম্ভব। তবেই সেই সংগীত অমর হয়ে থাকবে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম লোকের মুখে মুখে ঘুরবে। কী অসাধারণ জীবনদর্শন! ভেবে দেখুন, আমরা স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে যদি এই দর্শনকে মেনে চলি (এটি পরীক্ষিত সত্য) তবে দক্ষতা, কর্মক্ষমতা এবং কর্মের গুণমান বৃদ্ধি পেতে বাধ্য। অর্থাৎ, শরীর শুদ্ধ তো মন শুদ্ধ। সেই শুদ্ধ মন নিয়ে যদি নিজ নিজ কর্মে নিজেদের শপে দেওয়া যায়, সাফল্য আসবেই। কথাগুলি চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক বলে মনে হলেও এর সত্যতা কি খণ্ডন করা সম্ভব?
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯২: মহর্ষিদেব নাতজামাইকে দিয়েছিলেন সোনার কলম

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৮: আনন্দের নির্বাসন থেকে উত্তরণের উপায়?

চূড়ান্ত সাফল্য পায় ‘১৯৪২ আ লাভ স্টরি’। ছবির গল্প, গান, সুর এবং আবহ সংগীত সবকিছুই প্রশংসিত হয় অন্য মাত্রায়। পঞ্চম ঘনিষ্ঠ মহলে ঘোষণাও করেছিলেন যে, তিনি ফিরছেন তাঁর নতুন সুরের ডালি সাজিয়ে। আবারও তিনি হয়ে উঠবেন অপ্রতিরোধ্য। নতুন করে এমনই আত্মবিশ্বাস জন্ম নিয়েছিল ছিল তাঁর মনে। বিধু বিনোদ চোপড়ার বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য সহস্র যুদ্ধ জয় করা একটি তোলোয়ারকে এতদিন পর খাপ থেকে আবারও বের করে নিয়ে আসার জন্য। যে দুঃসাহস গত কয়েক বছর তেমন ভাবে কেউ দেখাবার প্রত্যয় পাননি। যে তলোয়ারে আজও মরচে পড়েনি। যে তলোয়ার আজও একই রকম ধারালো।—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content