মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


কিশোর, আশা ও পঞ্চম।

সুর রচনার ক্ষেত্রে পঞ্চমের ‘আউট অফ দা বক্স’ চিন্তাগুলি যে বেশি মাত্রায় প্রাধান্য পেতো তাঁর প্রমাণ ‘মহুয়ায় জমেছে আজ মৌ গো’ গানটি। গানটির ছন্দটি খেয়াল করুন। সেই সঙ্গে লক্ষ্য করুন আশা ভোঁসলের গাওয়ার ধরনটি। ছন্দের ক্ষেত্রে খুব সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সত্যি কথা বলতে কি, এমন একটি সুরের জন্ম দিতে গেলে সেটি গবেষণা ব্যতীত অসম্ভব। সুরের প্রবাহটি খুব ভালো করে খেয়াল করলে আশা করি আপনারা আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন। চিরাচরিত প্রথায়, রাগ রাগিণীর ছাঁচে ফেলে জন্ম দেওয়া একটি সুর এটি একেবারেই নয়। গানটির ছত্রে ছত্রে রয়েছে অন্তরালে চালিয়ে যাওয়া সুরকারের সেই গবেষণার প্রমাণ। গানটি শুধু শোনার জন্য শুনলে এই সত্যটি আমাদের অগোচরেই রয়ে যাবে।
‘একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে’ গানটি শুনলে একটি কথা খুব বলতে ইচ্ছে হয়। সেটি হল কিশোর এবং পঞ্চমের একসঙ্গে কাজ করার যে সুযোগ সর্বশক্তিমান করে দিয়েছিলেন, সেটি হয়তো শ্রোতাদের স্বার্থেই। তা না হলে এই ধরনের গান কি আমরা আদেও শুনতে পেতাম? সেই একই কথা আবারও বলতে হয়। কিশোর পঞ্চম জুটি এক এবং অদ্বিতীয়।

এই উক্তিটির সাক্ষ্য বহন করে অজস্র গানের মধ্যে আরও একটি গান। সেটি হল ‘সে তো এলোনা, সে এলো না’। কিশোর কণ্ঠে বেদনামিশ্রিত অভিমান ঝরে পড়ে অঝোর বারিধারার মতো। পঞ্চমের মেলোডি সেই বেদনাকে বাড়িয়ে তোলে কয়েকশো গুণ।

কোনো এক যুবকের কৈশোরে হারিয়ে যাওয়া প্রেমের স্মৃতি হঠাৎ যেন ভেসে ওঠে তার স্মৃতির পর্দায়। সেই যুবকের হয়ে পঞ্চম গেয়ে ওঠেন ‘মনে পড়ে রুবি রায় কবিতায় তোমাকে একদিন কত করে ডেকেছি’। এবং তখনই আমরা যেন সেই যুবকটিকে নিজেদের মধ্যে খুজে পাই এক নিমেষে। এই গানের মহিমা এমনই। শচীন ভৌমিকের লেখা এবং পঞ্চমের এই সুর রাজযোটক।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬৩: আমার মালতী লতা কী আবেশে দোলে…

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৪: দীনেন গুপ্তের আগে ‘দেবী চৌধুরাণী’ করতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়

কিংবা ধরুন আশার গাওয়া সেই গানটি। ‘না এখনই না, যাবে যদি যেও কিছু পরে’। প্রেমিকের প্রতি প্রেমিকার আকুতিকে নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন আশা ভোঁসলে। সেটি নিঃসন্দেহে সত্য। কিন্তু যে সুরে তিনি তাঁর কণ্ঠকে নির্দ্বিধায় ভাসিয়ে দিয়েছেন সেটিকে আমরা উপেক্ষা করি কীভাবে? এই সুর শোনার পর একটি প্রশ্নই মনের কোণে উঁকি দিতে থাকে। ইনি কি সেই একই সুরকার যিনি ‘আও টুইস্ট করে’ অথবা ‘জানে যা ও মেরি জানে যা’র মতো গানগুলিতে সুর দিয়েছিলেন? কিন্তু পরক্ষণেই মনকে বোঝাই যে সুরকারের নাম যে রাহুল দেব বর্মন ! তাই রাগাশ্রই গানই হোক অথবা চটকদার কোনো গান, দুই ক্ষেত্রেই যে সুরকার মানুষটি একই মাত্রায় সাবলীল! তখনই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাই। আর সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকে না।

‘সজনী গো প্রেমের কথা প্রেমের ব্যথা জানে বলো কয়জনা’ গানটির ক্ষেত্রে পঞ্চম গায়ক হিসেবে বেছে নেন নিজেকেই। সুরের ধাঁচটি শুনলে গ্রামবাংলার একটি প্রেক্ষাপট মানসচক্ষে যেনো ভেসে ওঠে। সেটিকে অনেকাংশে প্রসারিত করে আপন খেয়ালে বেজে চলা বাঁশির সুর। সঙ্গে একতারা থেকে উৎপত্তি হওয়া ছন্দ। খেয়াল করুন, কিছুটা বাউলগানের আকারে গানটি উপস্থাপিত করেছেন পঞ্চম। প্রেমের গান নিয়ে এও এক ধরনের গবেষণা বইকি? আর হবে নাই বা কেন? মাটির সুর যে তাঁর প্রতিটি ধমনীতে বইছে। এটি যে পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৩: মহাভারতে উল্লিখিত মিথ্যাশ্রয়ের প্রাসঙ্গিকতা কী আজও আছে?

‘মধুমাস যায় মধুমাস নাই যে বধূ’ গানটির আবেদন কি সত্যি ভোলা যায়? এটি রাহুল দেব বর্মনের গবেষণার আরও একটি নিদর্শন। অত্যন্ত ধীর গতির একটি ছন্দ। কিন্তু সার্বিকভাবে গানটিতে যে আবেগের সঞ্চার হয়েছে তার মূলে রয়েছে জায়গা বিশেষে সারেঙ্গী, ভায়োলিন, অ্যাকর্ডিয়ান, বাঁশি এবং সন্তুরের সুরস্রোত। এবং অবশ্যই পঞ্চমের কণ্ঠ, যা একজন পুরুষের বিরহবেদনাকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করে গিয়েছে পুরো গানটি জুড়ে। কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।

ঠিক একইভাবে এক নারীর বিরহযন্ত্রনাকে কি অসামান্য ভাবেই না ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ‘কথা দিয়ে এলে না’ গানটিতে। ১২ স্ট্রিং গিটারে ইন্ট্রো এবং তারপর আশা কণ্ঠে সংক্ষিপ্ত আলাপের পর গায়িকার কণ্ঠে থেকে যে বিরহ ঝরে পড়ে সেটি নিঃসন্দেহে ভাসিয়ে নিয়ে চলে আমাদের। তবলার ছন্দে ছন্দে এগিয়ে চলে গানটি। সুরের বৈচিত্রগুলিও এই গানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। গায়িকার কণ্ঠে হরকত গুলি যেন গায়ে কাঁটা দেয়।এই গান সাধারণ কোনো গান নয়। এই গান আমাদের মনোরঞ্জনের পাশাপাশি অনেক কিছু শেখায়। ভালো গান শোনার অনুপ্রেরণা যোগায়। পঞ্চমের সুরগুলিকে আবার নতুন করে শোনার এবং বোঝার উৎসাহ দেয়। সর্বোপরি নিজের অজান্তেই পঞ্চমময় হয়ে উঠি আমরা।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৬: শ্রীমায়ের দুই ভ্রাতৃবধূর কথা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৯: ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ওড়া, কেওড়া, চাক কেওড়া ও কৃপাল

মেলোডির স্রোতে যদি নিজেকে ভাসাতে চাই, তবে তো ‘আসবো আরেকদিন আজ যাই’ গানটি শুনতেই হবে। আশা ভোঁসলের দুষ্টুমিষ্টি উপস্থাপনার যে জুরি মেলা ভার সে কথা তো সর্বজনবিদিত। সেই সুনাম শতকরা একশভাগ বজায় রেখে এই গানটির ক্ষেত্রেও গায়িকা নিজেকে করে তুলেছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মন মাতানো ছন্দ, যেটির মিষ্টতা অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে মাদল এবং রেসো রেসোর উপস্থিতিতে। মনে হয় আবার শুনি। শুনতেই থাকি।—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content