রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


আরডি বর্মণ ও লতা মঙ্গেশকর।

যে সুরকারের প্রতিটি ধমনীতে বয়ে চলেছে সুরের মহাস্রোত, তিনি ছবির বাজেটের দিকে নজর রেখে সুরের মানের সঙ্গে আপস করে সুরের জন্ম দেবেন, তা কি কখনও সম্ভব? তাই অনেক কম বাজেটের ছবিতেও তাঁর, অর্থাৎ পঞ্চমের সুরের অঝোর বারিধারায় শিক্ত হয়েছি আমরা। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলা ছবি ‘আনন্দ নিকেতন’-এর কথা। ছবির একটি গান “চলে যাবে সময় ধুলোর মতো যাবে উড়ে” গানটি শুনলে আপনি মুগ্ধ হবেনই।

কেন? কারণ, গানটি পঞ্চমের প্রতিভার একটি প্রতিবিম্ব হিসেবে ভাবা যেতেই পারে। গানটির সুর, ছন্দ এবং তার বৈচিত্র। সঙ্গে ইনস্ট্রুমেন্টের যথাযথ ব্যবহার। বিশেষে কিছু জায়গায় করাসের ছোঁয়া এবং সর্বোপরি আশা ভোঁসলে এবং অমিত কুমারের সার্বিক উপস্থাপনা। এই সব কিছুরই নেপথ্যে পঞ্চমের জাদুকাঠি। এই গানটি যদি আজকের দিনে কোনও ডিজিটাল স্টুডিয়োতে নতুন করে রেকর্ডিং করা হয়, গানটি দাবানলের মতো দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য। যদি না শুনে থাকেন, একবার শুনে দেখতে পারে। যারা সেই সময়, অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ধরেই নিয়েছিলেন যে পঞ্চমের ভাণ্ডার শেষ হয়ে আসছে, তাঁদের সেই ধারণাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল এই গানটি।
‘অহংকার’ ছবির “বলেছ যে কথা তুমি নিজের মুখে” গানটির কথাই যদি ধরা যায়। সেমি-ক্লাসিক্যাল টাচ। তাই বেছে নেওয়া হয়েছে লতা মঙ্গেশকারকে। তবলা ভিত্তিক ছন্দ। এবং ভায়োলনে বেজে চলা পঞ্চমের অতিপ্রিয় সেই অবলিগেটো। সঙ্গে রয়েছে বাঁশি এবং মন মাতানো সেতারের ঝংকার। এই গানের স্বাদই অন্যরকম।

‘শ্বেত পাথরের থালা’ ছবির সেই বিখ্যাত গান ‘যে প্রদীপ জ্বালছ তুমি’ গানটি কি আমরা আজও ভুলতে পেরেছি? মুকুল দত্তের সেই অসামান্য লেখা এবং সেটিতে পঞ্চমের উপযোগী সুর। দুইয়ে মিলে যে গানের জন্ম হয়েছিল ১৯৯২ সালে, সেটি আজও স্বমহিমায় বেঁচে আছে আপামর শ্রোতার মনের মণিকোঠায়। মেলোডির কথা না হয় নাই বা বললাম। ভায়োলিন যেন কথা বলে গিয়েছে এই গানে। ইন্টারলুডের বৈচিত্রের সঙ্গে গায়িকা লতা মঙ্গেশকরের মন কেড়ে নেওয়া গায়কী। কোন কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। সুরকার পঞ্চমের আভিজাত্য সুস্পষ্ট ভাবে প্রকাশ পায় এই গানে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬১: হায়রে কালা একি জ্বালা…

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২১: গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী—এক শক্তির গল্প

অথচ সেই পঞ্চমই যখন ‘অধিকার’ ছবির অমিত কুমারের গাওয়া ‘চলতে চলতে জানি না’ গানটিতে সুরারোপ করেন, তখন তিনি আবার সেই নবপ্রযন্মের পঞ্চম। আক্ষরিক অর্থেই একটি ‘ফুট ট্যাপিং নম্বর’ এর জন্ম দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অবশ্যই মেলোডির সঙ্গে বিন্দুমাত্র আপোস করে নয়। পার্কাশন, হারমোনিকা, কিছুটা আকর্ডিয়ান ইফেক্ট, অক্টোপ্যাড, বঙ্গ—কি নেই? এতকিছুর সঙ্গে অমিতকণ্ঠ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে গানটিতে। এ যেন আধুনিক প্রজন্মের এক পরম পাওয়া। পিকনিক হোক অথবা পার্টি, ঘরোয়া আড্ডা হোক অথবা কোনো গেট-টুগেদার। এই গান সর্বত্র জায়গা করে নিতে সক্ষম।

‘শেষ চিঠি’ ছবির আশা এবং কুমার শানুর গাওয়া “মনে হয় তুমি আর তুমি নয়” গানটিতেও নিজের সিগনেচার রিদম ব্যবহার করে গানটির জন্ম দিয়েছেন পঞ্চম। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সাবেকি বাদ্যযন্ত্রের উপস্থিতি খুব একটি পরিলক্ষিত হয় না। মেলোডিকে আশ্রয় করে জন্ম নেওয়া এই গানে রিদম বাকি কাজটুকু করে গিয়েছে। এবং তার সঙ্গে রয়েছে গায়ক এবং গায়িকার যথাসাধ্য প্রচেষ্টা।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬১: মহাভারতের রাক্ষসরা কী আজও বর্তমান? প্রসঙ্গ— বকরাক্ষসবধ

‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ ছবির লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া “বুক ভরা মোর কান্না দিয়ে দিলাম চিঠি লিখে” গানটি কোনও এক অজানা কারণে জনপ্রিয়তা পায়নি। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যিনি গানটি প্রথমবার শুনবেন, তিনি এই গানটিকে ভালোবেসে ফেলবেন। সুরের কি অসাধারণ একটি কাঠামো। সেমি ক্লাসিক্যাল টাচ। ছন্দের বৈচিত্র। সঙ্গে লতাকণ্ঠের মাধুর্য। সবমিলিয়ে গানটির আবেদনে আমরা মুগ্ধ হতে বাধ্য।

‘পুরুষোত্তম’ ছবির “দিতে পারি এ জীবন” গানটি উপস্থাপিত করেন পঞ্চম স্বয়ং। বন্ধু শচিন ভৌমিকের লেখায় সুরারোপ করে নিজেই গেয়ে ফেলেন গানটি। এ যেন সেই পুরোনো পঞ্চম। চটকদার ছন্দ, বাস গিটারের বিপুল ব্যবহার এবং পঞ্চম এর ভয়েস মডিউলেসন। সেই এক রকম। অর্থাৎ ১৯৯২ সালেও একইরকম।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৪: সারদা মায়ের মানসিক দৃঢ়তা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৭: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—বাইন ও গর্জন

এ ছাড়াও এই সময় বেশ কিছু প্রাদেশিক ছবিতেও সুরকার হিসেবে কাজ করেন পঞ্চম। কিন্তু সাফল্য যেন অধরাই থেকে যায়। তিনি বেশ বুঝতে পারেন এই পরিবর্তন। কোথাও কিছু একটা অভাব বোধ করতে থাকেন সুরের বেতাজ বাদশাহ রাহুল দেব বর্মন। কোথায় যে খামতি থেকে যাচ্ছে সেটি সঠিক ভাবে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না। এদিকে বাংলা ছবির কাজ তো থেমে নেই! কিন্তু সেই ভাবে তাঁর চাহিদা কোথায় টলিউডে? হ্যাঁ, ডাক যে একেবারেই আসছিল না তেমনটি নয়। কিন্তু সেই সব হাতেগোনা ডাকে সাড়া দিয়েও তো সাফল্যের দেখা নেই। কিন্তু কেন? তাঁর দিক থেকে তো পরিশ্রমের কোনও ঘাটতি নেই?

ভেবে কূলকিনারা করতে পারেন না পঞ্চম। ছবির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বাণিজ্যিক ছবির ক্ষেত্রে সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়ে থাকে তথাকথিত ‘বক্স অফিস’কে। সেই নিরিখে, সেই সময়ে বাংলা ছবিতে পঞ্চমেত অবদান কোথাও যেন অপর্যাপ্ত থেকে যাচ্ছিল। অন্তত সমালোচকদের একাংশের মতামত তেমনই। কথাগুলি যে পঞ্চমের কানে পৌঁছয়নি তেমনটি নয়। তাই এই বিষয়টি তাঁকে প্রবলভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল। যে বাংলায় তাঁর জন্ম, যে শহরে তাঁর সংগীত শিক্ষার হাতেখড়ি, যৌবনে যে মানুষটি কত শত বাংলা আধুনিক এবং ছায়াছবির গান উপহার দিয়েছেন বাঙালিকে, আজ কিনা সেই বাঙালিই তাঁকে ভুলতে বসেছে? রাতে ঘুম আসে না পঞ্চমে।—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content