রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

১: মূর্খবানরের গল্প

করটক বলে, কোনও এক নাম না জানা নগরের পাশে সবুজ বনরাজির মধ্যে নির্জন স্থানে কোনও এক বণিকপুত্র কোনও এক দেবতার মন্দির বানানোর কাজ শুরু করেছিল। সেখানে যত “কর্মকার” মানে ছুতোর ও “স্থপতি” বা রাজমিস্ত্রিরিরা ছিলেন তারা সকলে দল বেঁধে দুপুর বেলায় চলে যেতেন শহরের মধ্যে মধ্যাহ্ন ভোজন সারতে। একবার এইরকম এক দুপুরে কোথা থেকে একদল বাঁদর তাদের স্বভাবসুলভ বাঁদরামি করতে করতে এসে উপস্থিত হয় সেই নির্জন বনপ্রান্তরে, যেখানে সেই মন্দির নির্মাণের কাজটি চলছিল। সেখানে কোনও এক স্থপতি একটি অশন (বা অর্জুন) বৃক্ষের তৈরি কাঠের স্তম্ভ দু’ খণ্ড করছিলেন। কিন্তু সেটাকে কিছুটা চেরাই করে তার ফাঁকে একটি কীলক বা গোঁজ আটকে মাঝপথেই ফেলে নগরে চলে গিয়েছিলেন সেদিন মধ্যাহ্ন ভোজনের বিরতিতে। ফলে বানরের দল একেবারে ফাঁকা জায়গা পেয়ে অর্ধনির্মিত সেই মন্দিরের কাঠের তৈরি স্তম্ভগুলোর মাথায় চড়ে এবং সেইসঙ্গে নির্জন বনের বড় বড় গাছে উপরে উঠে মনের আনন্দে খেলতে শুরু করলো। তাদের মধ্যে একটি তার স্বভাবসুলভ চঞ্চলতায় সেই অর্জুন কাঠের স্তম্ভটা যেটাকে আধ চেরাই করে গোঁজ আটকে রেখে কর্মকার গিয়েছিলেন মধ্যাহ্ন ভোজনে, সেটার মধ্যে বসে মনের আনন্দে হাত দিয়ে সেই গোঁজটি ধরে টানাটানি করতে শুরু করে। একসময় যে মুহূর্তে সেই গোঁজটি খুলে আসে সে মুহূর্তেই আধ-চেঁড়াই করা কাঠের ফাঁকটি সশব্দে বন্ধ হয়ে তার ফাঁকে সেই বাঁদরের বৃষণ মানে অণ্ডকোষটি (Testicles) আটকে গিয়ে তত্ক্ষণাৎ পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে।
প্রথম কাহিনি সমাপ্ত

মূর্খবানরের এই গল্পটা শুনিয়ে সাবধানী করটক দমনককে বললেন যে এই কারণেই আমার মত হচ্ছে যে, এইসব অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে মাথা না গলানোই ভালো; আর তার উপর খাওয়া-দাওয়াটা যখন আমাদের জুটেই যাচ্ছে, তখন এই সব ঝুট-ঝামেলার মধ্যে গিয়ে লাভটা কী? উল্টে অকাজে মাথা ঘামালে গোঁজ উপড়ে মরে যাওয়া সেই বাঁদরটার মতো অবস্থা হবে আমাদের।

তাতে দমনক শান্ত মাথায় রাজনীতির প্রথম পাঠটি দেয় করটককে। বলে, আমরা কী কেবল খাবার খেতেই জন্মেছি নাকি? খাবার-দাবার তো কাকেরও মতো তুচ্ছ প্রাণীরও ভাগ্যে জুটে যায়। এটা কোনও যুক্তিই নয় যে খাবার-দাবার জুটে যাচ্ছে বলেই আমরা উচ্চাশা করা ছেড়ে দেবো। লোকে তো রাজার সঙ্গ চায় অন্য কারণে—

সুহৃদামুপকারকারণাদ্ দ্বিষতামপকারকারণাৎ।
নৃপসংশ্রয় ইষ্যতে বুধৈর্জঠরং কো ন বিভর্তি কেবলম্‌।। (মিত্রভেদ-২২)
মানেটা হল, লোকে নিজের পেটভরা খাওয়ারটুকু পাওয়ার জন্যই শুধু যে রাজনীতি করে তা নয়। এই ধরুন আপনার বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয় পরিজনের কিছু সমস্যা হয়েছে, যেমন ধরুন পাশের বাড়ির লোক তাদের অসুবিধা করছে; বা তাদের বাড়ির সামনের রাস্তার গাছের ডালের জন্য আপনার বাড়ি অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, সূর্যের আলো ঢুকছে না তাই গাছ কাটতে হবে; কিংবা ধরুন তাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা খারাপ, সারানো হচ্ছে না অনেকদিন ধরে— আপনি যদি রাজার সঙ্গে থাকেন এইসব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় অতি সহজেই। ব্যাপারটাকে আজকের দিনের মতন করে যদি দেখেন তাহলে বলবো ধরুন আপনি যদি সেই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে থাকেন, যে রাজনৈতিক দল এখন ক্ষমতায় আছে, তাহলে দেখবেন সহজেই আপনার একটা ফোনে কিংবা একটা কথায় আপনার আত্মীয়-পরিজন বা বন্ধুবান্ধবদের এইসব কাজগুলো কেমন চোখের নিমেষে হয়ে যাবে। এটা যদি আপনি রাজার সঙ্গে বা ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে না থাকেন তাহলেই দেখবেন যে সামান্য থেকে অতিসামান্য কাজের জন্যও আপনাকে কেমন ভূক্তভোগী হতে হচ্ছে। এই কারণেই মানুষ রাজার সঙ্গে থাকতে চায়; কারণ খাওয়া-দাওয়া কিন্তু মানুষের এমনই জুটে যায়। তবে মানুষ যে সবসময় আত্মীয়-পরিজন বা বন্ধুবান্ধব বা দেশের-দশের উপকার করবে বলেই রাজনীতির করে এমনটা নয়, পঞ্চতন্ত্রকারের মতে শত্রুদের, মানে তার বিরোধী লোকেদের ক্ষতি করবার জন্যও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে থাকে। না হলে ভেবে দেখুন তো এমন কোন মানুষ কি সত্যিই আছে যে শুধু নিজের খাবারটুকু জোটানোর জন্য রাজার সঙ্গে থাকে? অধিকাংশ মানুষই তাঁর নিজের ভালোর পাশাপাশি নিজের বিরোধীদের ক্ষতিটিও কিন্তু করতে চান।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে শ্রীকৃষ্ণ যেমন তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছিলেন দমনক একেবারে সেইরকম ভঙ্গীতে দার্শনিকের মতন করটককে বোঝাতে শুরু করে। বলে, বুঝলে ভায়া! এ সংসারে আসলে সেই মানুষটার বেঁচে থাকাটাকেই আসল বেঁচে থাকা বলে, যিনি বেঁচে থাকলে আরও বহু মানুষ তাঁকে অবলম্বন করেই বেঁচে থাকতে পারে। না হলে কাকের মতো বহু প্রাণীরাই যারা শুধু খায়-দায় বেঁচে থাকে আর তারপর মরে যায় তাদের বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়ায় পৃথিবীর কোনও ক্ষতিই হয় না। সেভাবে বাঁচাটা আসলে কোন বাঁচাই নয়। শ্রেষ্ঠগুণগুলি নিয়ে একজন জ্ঞানী মানুষ যদি স্বল্প দিনও জীবিত থাকেন পণ্ডিতরা সেই বেঁচে থাকাটাকেই মহান বলেন— “তন্নাম জীবিতমিহ প্রবদন্তি তজ্ঞাঃ”। যে মানুষ নিজের প্রচেষ্টায় বা অন্য কোনও ভাবে আত্মীয়-পরিজন, দীন-দরিদ্র কিংবা জগৎ সংসারের কোনও রকম উপকারে আসে না এই পৃথিবীতে তাঁর জীবনটাই আসলে নিষ্ফল। এইধরণের মানুষ আর গৃহস্থ বাড়ির ওইসব ভূক্ত্বাবশেষ, মানে এঁটো-কাঁটা খেয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা কাক—দু’ জনে একই গোত্রের।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭: ঝুঁকি না নিলে জীবনে বড় কিছুই অর্জন করা যায় না

অজানার সন্ধানে: পাচার হয়েছিল টন টন সোনা ও দামি ধাতু! ৮৫ বছরের সেই ভূতুড়ে রেলস্টেশন এখন অভিজাত হোটেল

পাঠক-পাঠিকাদের খেয়াল করতে বলবো, করটক চরিত্রটির নামের আড়ালে পঞ্চতন্ত্রকার তার মধ্যে যে সাবধানী কাকের প্রবৃত্তিটিকে দেখাতে চেয়েছেন সেইটাকে ব্যঙ্গ করেই কিন্তু দমনক তার ভাই করটককে বলে চলছে যে কাকের মতো শুধু খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাটা আসলে কোন বেঁচে থাকাই নয়। যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে জীবনধারণের জন্য সেটুকুই যথেষ্ট—এই চিন্তা নিয়ে বেঁচে থাকাটাকে কাপুরুষের বেঁচে থাকা বলে। ক্ষুদ্রলোকেরা এভাবে বেঁচে থাকে, মহৎ মানুষেরা নয়। দমনক রাজনীতি শাস্ত্রের শ্লোক শোনায়—

সুপুরা স্যাৎ কুনদিকা সুপুরো মূষিকাঞ্জলিঃ।
সুসন্তুষ্টঃ কাপুরুষঃ স্বল্পেনাপি তুষ্যতি।। (মিত্রভেদ-২৬)


মানেটা হল, যে নদীর নাব্যতা নেই সংস্কৃত ভাষায় তাকে বলে “কুনদী”। সেই কুনদী সামান্য জলেই পূর্ণ হয়ে যায়। বেশি জল ধারণের ক্ষমতা বা যোগ্যতা কোনওটাই থাকে না তার। মূষিক মানে ইঁদুরের অঞ্জলিও অত্যন্ত ছোট। ইঁদুরের মতো ক্ষুদ্রপ্রাণীরা দু’হাত পাতলে সামান্য কয়েক দানা খাবারও যদি তাদের হাতে ছুঁড়ে দেন দেখবেন সেই অঞ্জলি সহজেই ভরে যায়। কারণ বেশি গ্রহণ করবার ক্ষমতা তাদের নেই; তাই বেশি দেওয়ার প্রয়োজনও হয় না তাদের। কাপুরুষদের দশাও তেমনই। সামান্য কিছু পেলেই তারা সন্তুষ্ট হয়ে যায়— জীবনে বেশি কিছু পাওয়ার আশাও তারা করে না। তারা চায় নিশ্চিন্তের জীবন আর সেইসঙ্গে খাওয়া-পরার ব্যবস্থাটুকু মাত্র। তাদের উচ্চাশা থাকে না। তাদের পরিশ্রমের ফলটুকু সমস্তটা উদ্যোগী পুরুষেরাই ভোগ করে। নিজেরা তারা খাওয়া-পরাটুকু নিয়েই জীবন কাটিয়ে দেয়। কারণ কাপুরুষেরা অনিশ্চয়তার ভয়ে নিজের পুরুষকারের উপরও ভরসা করতে পারে না। উচ্চাশা করতেও ভয় পায় তারা। নিজের ক্ষমতা বা যোগ্যতায় তারা জীবনে যে কতখানি উন্নতি করতে পারে সেটা পরীক্ষা পর্যন্ত করতে ভয় পায় তারা। তাই বঞ্চনা ছাড়া তাদের জীবনে আর কিছুই প্রায় জোটে না। দমনকের মতে, করটকের চিন্তাভাবনা সেইরকম কাপুরুষদের মতনই শোনাচ্ছে। নিজের ক্ষমতা বা যোগ্যতা যে তার কতটা সেটা যাচিয়ে দেখতে ভয় পায় সে। এইরকম কাপুরুষের মতন বেঁচে থাকাটাকে কি আদৌ বেঁচে থাকা বলে?

কিং তেন জাতু জাতেন মাতুর্যৌবনহারিণা।
আরোহতি ন যঃ স্বস্য বংশস্যাগ্রে ধ্বজো যথা।। (মিত্রভেদ-২৭)
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১৩: কুরুপাণ্ডবদের দুই পিতামহের একজন — ভীষ্ম এবং তাঁর মা গঙ্গা

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২২: সামাজিক প্রতিবন্ধকতার দ্বিচারিতা

মায়ের যৌবন হরণ করে শুধু শুধু এ জগতে জন্মগ্রহণ করে হবেটা কী, যদি না কেউ নিজের যোগ্যতায় আর কর্মদক্ষতায় বাঁশের দণ্ডের উপরে বাঁধা সেই পতাকার মতন উচ্চ মর্যাদায় তার বংশগৌরবকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে। দমনক বলে, আমি মনে করি নদীতীরে জন্মানো সেই তৃণভূমির জন্মও সার্থক যাকে আঁকড়ে ধরে নদীতে ডুবতে বসা মানুষ নিজেকে বাঁচাতে পারে। আকাশে মেঘের উদয় হলে সে মেঘ যেমন গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড তাপ হরণ করে মানুষকে প্রকৃত শান্তি দেয়, সেরকম মেঘের মতন প্রকৃত সজ্জন ব্যক্তিও এ জগতে সত্যিই বিরল, যাঁরা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করে মানুষকে প্রকৃত শান্তি দিতে পারে। তাই রাজনীতিতেও আমাদের মতো যোগ্য লোকের প্রয়োজন, যাঁরা মেঘের মতো সন্তপ্ত মানুষকে শান্তি দিতে পারে। শুকনো কাঠের মধ্যে যে আগুন জ্বালানোর শক্তি আছে সেটা আগুণের সংস্পর্শে না এলে কেউ জানতে পারে না। শুকনো কাঠে আগুন না লাগা পর্যন্ত লোকে তার যোগ্যতাকে যেমন খেয়ালও করে না, তেমনভাবে পাত্তাও দেয় না। নিজের ভিতরে থাকা যোগ্যতা ও সামর্থ্যকে প্রকাশ করতে না পারলে লোকজন সেই মানুষকে শুকনো কাঠের মতনই উপেক্ষা করে এড়িয়ে যায়।

অপ্রকটীকৃতশক্তিঃ শক্তোঽপি জনস্তিরস্ত্রিয়াং লভতে।
নিবসন্নন্তর্দারুণি লঙ্ঘ্যো বহ্নির্ন তু জ্বলিতঃ।। (মিত্রভেদ-৩২)


ব্যাপারটাকে একটু লৌকিক উদাহরণ দিয়ে বললে বোধহয় বুঝতে আরেকটু সুবিধা হবে। ধরুন আপনি খুব ভালো গান গাইতে পারেন। আপনার গানের গলা, সুরের জ্ঞান সব কিছুতেই আপনি অনন্য। কিন্তু আপনার সেই প্রতিভার আগুনটাকে নিয়ে আপনি যদি চুপ করে বসে থাকেন, নিজেকে লুকিয়ে রাখেন তাহলে লাভ কিসের? নিজেকে যথার্থ জায়গায় মেলে ধরতে পারলে তবেই তো সেই প্রতিভার সার্থকতা। সোজা কথায় নিজের প্রতিভার আগুনকে যথাযথ জায়গায় স্থাপন করতে গেলে নিজেকেই নিজের প্রতিভার প্রচার করতে হবে অন্যের কাছে। না হলে সেই আগুনের শক্তি কেউ কোনও দিন জানবে না। আগুনকে মানুষ শ্রদ্ধা করে, ভয়ও করে। কিন্তু সেই আগুন যদি ভিতরে চাপা থাকে, সেই আগুনের অধিকারীকে কেউ কখনও ভয়ও করে না, শ্রদ্ধাও করবে না। তাই নিজের মার্কেটিং নিজেকেই করতে হয়। নিজের সম্ভাবনাকে নিজেকেই তৈরি করতে হয়। তাই দমনকের মত হল, ভাগ্যের উপর ভরসা না করে নিজের ক্ষমতার উপরেই ভরসা রাখাই উচিত। না হলে ভাগ্যের দোহাই দিয়ে কাপুরুষরা ওই কাকের মতন জন্মায়, খায়-দায় আর মরে যায়। তাদের বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়া কোনও কিছুতেই কারও কিছু এসে যায় না।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১: আমি ‘কেবলই’ স্বপন…

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২২: স্টেরয়েড বড় ভয়ঙ্কর ওষুধ?

করটক তখন বলে, “আবাং তাবদপ্রধানৌ তৎ কিমাবযোরনেন ব্যাপারেণ?”—সবই তো বুঝলাম ভাই। কিন্তু আমরা দু’ জনেই তো এমন কেউ নই যে রাজার কাছে গিয়ে কথা বলবো আর রাজাও আমাদের কথা শুনবেন। বরং বিনা অধিকারে অযাচিত ভাবে যারা রাজাকে পরামর্শ দিতে যায় তাদের যে শুধু অসম্মানই হয় তেমন নয়, নানা বিড়ম্বনারও শিকার হতে হয়। কোনও জায়গায় স্থায়ী রং করবার জন্য শিল্পী যেমন সাদা কাপড় খোঁজেন, তেমনই ভাবে সেই রকম জায়গাতেই মুখ খোলা উচিত যেখানে মুখ খুললে প্রকৃত অর্থেই কথার দাম থাকে। অযাচিতভাবে কথা বলতে যায় যারা তারা আসলে মূর্খ। তাদের কপালে অপমান ছাড়া আর কিছুই জোটে না।

বচস্তত্র প্রযোক্তব্যং যত্রোক্তং লভতে ফলম্‌।
স্থাযী ভবতি চাত্যন্তং রাগঃ শুক্লপটে যথা।। (মিত্রভেদ – ৩৪)


করটককে তখন পাল্টা যুক্তি দেয় দমনক। বলে “মা মৈবং বদ”—এমন কথা বলো না ভাই। আসল কথাটা কি জানো তো —

অপ্রধানঃ প্রধানঃ স্যাৎ সেবতে যদি পার্থিবম্।
প্রধানোঽপ্যপ্রধানঃ স্যাৎ যদি সেবাবিবর্জিতঃ।। (মিত্রভেদ – ৩৫)


মানেটা হল, তুচ্ছাতিতুচ্ছ সাধারণ মানুষও যদি রাজার সেবায় নিজেকে যুক্ত রাখে তাহলে রাজার অনুগ্রহে সেই ব্যক্তিই একজন কেউকেটা হয়ে ওঠে; ঠিক তেমনই রাজার সেবা না করলে ওই কেউকেটা লোকটাকেই দেখবেন শুধু রাজার হাত মাথায় না থাকার কারণে দিনের শেষে অপ্রাসঙ্গিক একজন মানুষ হয়ে গিয়েছেন। আজকের দিনেও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লোকে দেখবেন ঠিক এই কারণেই থাকে। আপনার বাড়ির আশেপাশে তাকালেও চেনা-পরিচিতদের মধ্যেও এইরকম বহু মানুষই আপনি দেখতে পাবেন, যারা কাল হয়তো একজন অপ্রধান ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু রাজনৈতিক পালাবদলের খেলায়, শুধু ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকার কারণে, সেই লোকটিই আজ একজন প্রধান ব্যক্তি হয়ে উঠেছে। তাই অপ্রধান থেকে প্রধান হতে গেলেও রাজসহায় লাগে। বাস্তবটা হল এটাই যে জীবনে উন্নতি করতে হলে কিংবা যথার্থভাবে বেঁচে থাকতে গেলে রাজার সঙ্গে, মানে আজকের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আপনাকে থাকতে হবে। না হলে আপনার মধ্যে প্রচুর কিছু করবার সম্ভাবনা থাকলেও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে একজন অপ্রাসঙ্গিক লোক হয়েই হয়তো সারাটা জীবন আপনাকে কাটাতে হতে পারে।—চলবে
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content