বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত বেসনগর থেকে প্রাপ্ত বেলেপাথরের তৈরি পুষ্যমিত্র শুঙ্গের প্রতিকৃতি।
মিত্রভেদ
সেই জঙ্গলেই করটক ও দমনক নামে অতিধূর্ত দুটো শেয়াল ছিল। পাঠকদের সঙ্গে তাদের দু’ জনের পরিচয় করিয়ে দিতে পঞ্চতন্ত্রকার বলেছেন, যে তারা ছিল “মন্ত্রিপুত্রৌ ভ্রষ্টাধিকারৌ সদানুযাযিনৌ”। তিনি স্পষ্ট করে গল্পের মধ্যে বলে না দিলেও, এই তিনটি বিশেষণকে অর্থগত দিক থেকে আলাদা আলাদা ভাবে অর্থশাস্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে যদি বিবেচনা করেন তাহলে এই দুটি শেয়ালের বিষয়ে বেশ কতগুলো নতুন ও সেইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আপনি নিজেই খুঁজে পেয়ে যাবেন। ব্যাপারটাকে বুঝতে গেলে অন্য প্রসঙ্গের কতগুলো কথা এখানে আগে ভাগেই বলে নেওয়াটা ভালো। আমার বিশ্বাস, এ বিষয়গুলি আগে থাকতে জানা থাকলে, পরে পঞ্চতন্ত্রের অন্যান্য গল্পগুলো শোনবার সময়েও দেখবেন সেই কথাগুলো ‘ব্যাক অফ দ্য মাইন্ড’-এ কেমন ভাবে আপনার অজান্তেই আপনাকে অনেক কিছু অর্থ বুঝে নিতে সাহায্য করবে।
প্রথমে “মন্ত্রিপুত্রৌ” এবং “ভ্রষ্টাধিকারৌ”—এই বিশেষণ দুটিকে আগে বুঝে নেওয়া যাক। পঞ্চতন্ত্রকার জানাচ্ছেন যে এই শেয়াল দু’ জন ছিলেন মন্ত্রীর পুত্র এবং তারা আগে মন্ত্রী পদে থাকলেও কোনও অজানা কারণে আজ তারা ভ্রষ্টাধিকার—মন্ত্রিত্বের পদ তাদের চলে গিয়েছে। অথচ তারা দু’ জনেই আবার “সদানুযাযিনৌ”, মানে পিঙ্গলক সিংহের সঙ্গেই আছে, তার সংস্পর্শ ছাড়েনি। সিংহের দলবলের সঙ্গেই তাদের দু’ জনের চলাফেরা। এখন এ-প্রশ্ন আপনার মনে আসতেই পারে যে এইটুকুর মধ্যে আলাদা করে বোঝবার আর আছেটা কি? যা অর্থ, সেটা তো সবটাই অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে তিনটে বিশেষণের মাধ্যমেই বলা হয়েছে। এর মধ্যে জটিলতা কোথায়? আমি বলবো যে জটিলতা তেমন না থাকলেও অর্থশাস্ত্রের যে বিষয়গুলো এখানে এই বিশেষণ তিনটির মাধ্যমে ইঙ্গিত করা হয়েছে, সেগুলোকে একটু ধরিয়ে দেওয়ার জন্যেই পঞ্চতন্ত্র নিয়ে নতুন করে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে কথা বলছি আমরা।
“পিতৃপৈতামহানমাত্যান্ কুর্বীত, দৃষ্টাপদানত্বাৎ। তে হ্যেনমপচরন্তমপি ন ত্যজন্তি, সগন্ধত্বাৎ।”
কৌণপদন্ত হলেন ভীষ্ম, কুরু-পাণ্ডবকুলের পিতামহ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে কুরুবীর পিতামহ ভীষ্ম যখন শরশয্যায় জীবনের অন্তিম দিনগুলি কাটাচ্ছেন সে সময়ে বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ নতুন রাজা যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে আসেন তাঁর কাছ থেকে রাজনীতি বিষয়ে উপদেশ শোনানোর জন্য। পিতামহ ভীষ্মের রাজনীতি বিষয়ক দীর্ঘ সে উপদেশের খানিকটা খোঁজ আপনি পেতে পারেন মহাভারতের শান্তিপর্বে। কিন্তু সেখানেও সবটা নেই। সেকালে যতো না পুঁথির পাতায় লেখা থাকতো তার চেয়ে বেশি থাকতো আচার্যদের স্মৃতিতে, আজকের পরিভাষায় যাকে আমরা “ওরাল হিস্টোরি” নাম দিয়েছি, এ জ্ঞানগুলো ছিল তেমনই। কৌণপদন্তের নামের আড়ালে অর্থশাস্ত্র পরম্পরার রাজনীতি বিষয়ক একটি জনপ্রিয় গ্রন্থ যে অতি প্রাচীনকাল থেকেই পিতামহ ভীষ্মের নামে প্রচলিত ছিল, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অর্থশাস্ত্রকার কৌটিল্যও তাঁর গ্রন্থে বহু ক্ষেত্রে সসম্মানের এই শাস্ত্রের অভিমত উল্লেখ করেছেন। সেখানেই বলা হয়েছে যে পিতৃ-পিতামহক্রমে যে সমস্ত ব্যক্তিরা অমাত্যের পদ অলঙ্কৃত করে আসছেন রাজার উচিত তাঁদেরকেই অমাত্যরূপে নিয়োগ করা। কৌণপদন্তের বক্তব্য এইটাই। কারণ রাজা তাঁর পূর্বপুরুষের কাল থেকেই তাঁদের চারিত্রিক সততা সম্পর্কেও বংশ পরম্পরায় পরিজ্ঞাত থাকেন। সোজা কথায়, কৌণপদন্ত রাজাকে বংশ পরম্পরায় অমাত্যের পুত্রকেই অমাত্য পদে নিযুক্ত করতে পরামর্শ দিয়েছেন, যেহেতু বংশ পরম্পরায় তাঁদের কর্মদক্ষতা ও সততা রাজা জানতে পারেন, তাঁর পূর্বপুরুষের কাল থেকেই। এ-প্রসঙ্গে অপর আরেকটি সুন্দর যুক্তিও দেখিয়েছেন কৌণপদন্ত। তাঁর মতে, বংশপরম্পরায় নিযুক্ত অমাত্যদের সঙ্গে সময় বিশেষে অন্যায় আচরণ বা অপকারসাধণ করলেও রাজার সঙ্গে পুরুষানুক্রমে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ থাকায় তাঁরা রাজাকে কখনও পরিত্যাগ করে না।
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬: টাকা-পয়সা খরচ করে পরিদর্শনের লোক রাখলেও, নিজে পর্যবেক্ষণ না করলে সবকিছুই বিনষ্ট হয়
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১২: সিদ্ধাশ্রমে সাফল্য, বিশ্বামিত্রের বংশবর্ণনা এবং নদীকথায় কীসের ইঙ্গিত?
কিন্তু বংশপরম্পরায় মন্ত্রীপুত্র মন্ত্রী হলে যে কতরকম গোলমালের সম্ভাবনা থাকে শ্রীকৃষ্ণের মন্ত্রী উদ্ধব, মানে রাজনীতিশাস্ত্রে যিনি বাতব্যাধি নামে পরিচিত, তিনি উল্লেখ করেছেন। কৌণপদন্তের মতের বিরোধিতা করে তিনি বলেছেন—
“তে হ্যস্য সর্বমগৃহ্য স্বামিবৎ প্রচরন্তীতি। তস্মান্নীতিবিদো নবানমাত্যান্ কুর্বীত। নবাস্তু যমস্থানে দণ্ডধরং মন্যমানা নাপরাধ্যন্তীতি”।
বাতব্যাধির মতে, বংশ পরম্পরায় যদি তাঁরা রাজার অমাত্য কর্মে নিযুক্ত থাকেন তাহলে তাঁদের প্রভুর বৈভব আত্মস্থ করে নিজেরাই একদিন রাজার মতো আচরণ করে। তবে শুধু যে বংশ পরম্পরায় নিযুক্ত হলেই এমনটা হয় তা নয়; অনেকক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে যে এই ধরণের রাজকর্মচারীরা, যাঁদের হাতে ক্ষমতা বেশি থাকে, অনেক সময়ে রাজাকেই তারা উত্ক্ষাত করে নিজেই রাজা হয়ে বসে। এ-প্রসঙ্গে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস থেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারি।
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৬: আবার নুনিয়া
দশভুজা, পিকনিক দল থেকে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু: তাঁর লেন্সের বিস্তৃতি ছিল বিস্ময়কর
দ্বিতীয় তথ্যটি হল, খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ৭৫ অব্দে সেই শুঙ্গবংশেরই শেষ রাজা দেবভূতিকে হত্যা করে তাঁরই অমাত্য কাণ্ব বসুদেব মগধের পাটলিপুত্রে কাণ্ব বংশের প্রতিষ্ঠা করেন, যদিও পাথুরে প্রমাণ হিসেবে তাঁদের অধিকাংশ মুদ্রাগুলি পাওয়া গিয়েছে মধ্যভারতের বিদিশা অঞ্চলের আশেপাশে, যেখানে পরবর্তীকালে শুঙ্গদের রাজধানী স্থানান্তরিত হয়েছিল শুঙ্গসম্রাট ভগভদ্রের আমলেই আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১১০ অব্দে। মধ্যপ্রদেশের সাঁচী বেড়াতে গিয়ে যদি অতিরিক্ত মিনিট কুড়ি আপনি ব্যয় করেন তাহলে বিদিশার কাছে হেলিওডোরাস স্তম্ভ দেখে আসতে পারেন, যেখানে ব্রাহ্মী অক্ষরে লেখা একটি শিলালেখ থেকে জানতে পারি যে তক্ষশীলার বাসিন্দা দিওয়েনের পুত্র হেলিওডোরাস ইন্দো-গ্রিক শাসক আন্তিয়াল্কিদাস নিকেফোরোসের দূত হয়ে শুঙ্গসম্রাট কাসিপুত্ত (কাশিপুত্র?) ভগভদ্রের শাসন কালে বিদিশা নগরীতে উপস্থিত হয়ে বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে সেই স্তম্ভ স্থাপন করেন।
মধ্যপ্রদেশের বিদিশায় হেলিওডোরাস স্তম্ভ (খ্রিস্টপূর্ব ১১০ অব্দ)। ব্রাহ্মী অক্ষরে লেখা শিলালেখ।
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৯: পাকা আম খাবেন, নাকি কাঁচা আম?
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-২০: রায়পুর থেকে রাজিম
তাই দমনককে সাবধান করে করটক বলে, “ভদ্র কিমাবয়োরনেন ব্যাপারেণ?”— এইসব অপ্রয়োজনীয় ঝামেলার মধ্যে মাথা গলিয়ে লাভ কী? কারণ যারা নিজের কাজের বাইরে অন্যের কাজে বেশি মাথা ঘামায় তাদের সেই কীলক (বা চেড়াই করে ফাঁক করা কাঠের তক্তার মাঝে আটকানো গোঁজ) উপড়ে ফেলায় মরে যাওয়া সেই বাঁদরটার মতো অবস্থা হয়।
অব্যাপারেষু ব্যাপারং যো নরঃ কর্তুমিচ্ছতি।
স এব নিধনং যাতি কীলোত্পাটীব বানরঃ।।
দমনক বলে, সে ব্যাপারটা তো জানা নেই – “কথমেতৎ?” করটক তখন মূর্খবানরের গল্পটা বলতে শুরু করে।—চলবে