রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত বেসনগর থেকে প্রাপ্ত বেলেপাথরের তৈরি পুষ্যমিত্র শুঙ্গের প্রতিকৃতি।

 

মিত্রভেদ

সেই জঙ্গলেই করটক ও দমনক নামে অতিধূর্ত দুটো শেয়াল ছিল। পাঠকদের সঙ্গে তাদের দু’ জনের পরিচয় করিয়ে দিতে পঞ্চতন্ত্রকার বলেছেন, যে তারা ছিল “মন্ত্রিপুত্রৌ ভ্রষ্টাধিকারৌ সদানুযাযিনৌ”। তিনি স্পষ্ট করে গল্পের মধ্যে বলে না দিলেও, এই তিনটি বিশেষণকে অর্থগত দিক থেকে আলাদা আলাদা ভাবে অর্থশাস্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে যদি বিবেচনা করেন তাহলে এই দুটি শেয়ালের বিষয়ে বেশ কতগুলো নতুন ও সেইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আপনি নিজেই খুঁজে পেয়ে যাবেন। ব্যাপারটাকে বুঝতে গেলে অন্য প্রসঙ্গের কতগুলো কথা এখানে আগে ভাগেই বলে নেওয়াটা ভালো। আমার বিশ্বাস, এ বিষয়গুলি আগে থাকতে জানা থাকলে, পরে পঞ্চতন্ত্রের অন্যান্য গল্পগুলো শোনবার সময়েও দেখবেন সেই কথাগুলো ‘ব্যাক অফ দ্য মাইন্ড’-এ কেমন ভাবে আপনার অজান্তেই আপনাকে অনেক কিছু অর্থ বুঝে নিতে সাহায্য করবে।

প্রথমে “মন্ত্রিপুত্রৌ” এবং “ভ্রষ্টাধিকারৌ”—এই বিশেষণ দুটিকে আগে বুঝে নেওয়া যাক। পঞ্চতন্ত্রকার জানাচ্ছেন যে এই শেয়াল দু’ জন ছিলেন মন্ত্রীর পুত্র এবং তারা আগে মন্ত্রী পদে থাকলেও কোনও অজানা কারণে আজ তারা ভ্রষ্টাধিকার—মন্ত্রিত্বের পদ তাদের চলে গিয়েছে। অথচ তারা দু’ জনেই আবার “সদানুযাযিনৌ”, মানে পিঙ্গলক সিংহের সঙ্গেই আছে, তার সংস্পর্শ ছাড়েনি। সিংহের দলবলের সঙ্গেই তাদের দু’ জনের চলাফেরা। এখন এ-প্রশ্ন আপনার মনে আসতেই পারে যে এইটুকুর মধ্যে আলাদা করে বোঝবার আর আছেটা কি? যা অর্থ, সেটা তো সবটাই অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে তিনটে বিশেষণের মাধ্যমেই বলা হয়েছে। এর মধ্যে জটিলতা কোথায়? আমি বলবো যে জটিলতা তেমন না থাকলেও অর্থশাস্ত্রের যে বিষয়গুলো এখানে এই বিশেষণ তিনটির মাধ্যমে ইঙ্গিত করা হয়েছে, সেগুলোকে একটু ধরিয়ে দেওয়ার জন্যেই পঞ্চতন্ত্র নিয়ে নতুন করে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে কথা বলছি আমরা।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের প্রথম অধিকরণটির নাম হল “বিনয়াধিকরণ”। এখানে মূলত রাজা ও রাজকর্মচারীদের বিনীত বা বিনম্র করার জন্য কী কী শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন সেসব বিষয়ে মোট আঠেরোটি (১৮) প্রকরণ জুড়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেই বিনয়াধিকরণের চতুর্থ প্রকরণের অষ্টম অধ্যায়ের “অমাত্যদের নিয়োগ” বিষয়ে দীর্ঘ একটি আলোচনা পাওয়া যায়। “অমাত্য” হল রাজার সহায়। কারণ “সহায়সাধ্যং রাজত্বং চক্রমেকং ন বর্ততে”— রাজার পক্ষে একা একা সহায়-সম্বলহীন ভাবে রাজ্যশাসন করা বা রাজ্য পরিচালনা করা কোনটাই সম্ভব নয়। তাই সবকিছু সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য রাজার প্রয়োজন হয় সঠিক সহায়ের; আর “অমাত্য”ই হল রাজার সহায়। অর্থশাস্ত্রের সুপারিশ অনুযায়ী সেই অমাত্যদের মধ্যে যাঁরা শ্রেষ্ঠ হতেন তাঁরাই মন্ত্রীপদ লাভ করার যোগ্য হন। সেই কারণেই অমাত্য নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রের “অমাত্যোত্পত্তিঃ” নামের অধ্যায়ে অমাত্যদের নিয়োগ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। সেখানেই “কৌণপদন্ত” ও “ব্যাতব্যাধি” নামের কৌটিল্য পূর্ববর্তী দুই অতি প্রাচীন আচার্যের মধ্যে কিছু বাদাদানুবাদের উল্লেখ আছে। সেখানে কৌণপদন্তের বক্তব্য হল—

“পিতৃপৈতামহানমাত্যান্‌ কুর্বীত, দৃষ্টাপদানত্বাৎ। তে হ্যেনমপচরন্তমপি ন ত্যজন্তি, সগন্ধত্বাৎ।”

কৌণপদন্ত হলেন ভীষ্ম, কুরু-পাণ্ডবকুলের পিতামহ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে কুরুবীর পিতামহ ভীষ্ম যখন শরশয্যায় জীবনের অন্তিম দিনগুলি কাটাচ্ছেন সে সময়ে বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ নতুন রাজা যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে আসেন তাঁর কাছ থেকে রাজনীতি বিষয়ে উপদেশ শোনানোর জন্য। পিতামহ ভীষ্মের রাজনীতি বিষয়ক দীর্ঘ সে উপদেশের খানিকটা খোঁজ আপনি পেতে পারেন মহাভারতের শান্তিপর্বে। কিন্তু সেখানেও সবটা নেই। সেকালে যতো না পুঁথির পাতায় লেখা থাকতো তার চেয়ে বেশি থাকতো আচার্যদের স্মৃতিতে, আজকের পরিভাষায় যাকে আমরা “ওরাল হিস্টোরি” নাম দিয়েছি, এ জ্ঞানগুলো ছিল তেমনই। কৌণপদন্তের নামের আড়ালে অর্থশাস্ত্র পরম্পরার রাজনীতি বিষয়ক একটি জনপ্রিয় গ্রন্থ যে অতি প্রাচীনকাল থেকেই পিতামহ ভীষ্মের নামে প্রচলিত ছিল, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অর্থশাস্ত্রকার কৌটিল্যও তাঁর গ্রন্থে বহু ক্ষেত্রে সসম্মানের এই শাস্ত্রের অভিমত উল্লেখ করেছেন। সেখানেই বলা হয়েছে যে পিতৃ-পিতামহক্রমে যে সমস্ত ব্যক্তিরা অমাত্যের পদ অলঙ্কৃত করে আসছেন রাজার উচিত তাঁদেরকেই অমাত্যরূপে নিয়োগ করা। কৌণপদন্তের বক্তব্য এইটাই। কারণ রাজা তাঁর পূর্বপুরুষের কাল থেকেই তাঁদের চারিত্রিক সততা সম্পর্কেও বংশ পরম্পরায় পরিজ্ঞাত থাকেন। সোজা কথায়, কৌণপদন্ত রাজাকে বংশ পরম্পরায় অমাত্যের পুত্রকেই অমাত্য পদে নিযুক্ত করতে পরামর্শ দিয়েছেন, যেহেতু বংশ পরম্পরায় তাঁদের কর্মদক্ষতা ও সততা রাজা জানতে পারেন, তাঁর পূর্বপুরুষের কাল থেকেই। এ-প্রসঙ্গে অপর আরেকটি সুন্দর যুক্তিও দেখিয়েছেন কৌণপদন্ত। তাঁর মতে, বংশপরম্পরায় নিযুক্ত অমাত্যদের সঙ্গে সময় বিশেষে অন্যায় আচরণ বা অপকারসাধণ করলেও রাজার সঙ্গে পুরুষানুক্রমে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ থাকায় তাঁরা রাজাকে কখনও পরিত্যাগ করে না।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬: টাকা-পয়সা খরচ করে পরিদর্শনের লোক রাখলেও, নিজে পর্যবেক্ষণ না করলে সবকিছুই বিনষ্ট হয়

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১২: সিদ্ধাশ্রমে সাফল্য, বিশ্বামিত্রের বংশবর্ণনা এবং নদীকথায় কীসের ইঙ্গিত?

এমনকি মনুষ্যেতর প্রাণীদের মধ্যেও এইরকম ব্যবহার দেখা যায়। খেয়াল করে দেখবেন, গরুও “অসগন্ধ” অর্থাৎ অপরিচিত গরুর দলকে ছেড়ে, নিজেদের পরিচিত ও সম্পর্কযুক্ত দলের সঙ্গেই মিশে থাকে — “অমানুষেষ্বপি চৈতদ্‌ দৃশ্যতে। গাবো হ্যসগন্ধং গোগণমতিক্রম্য সগন্ধেষ্বেবাবতিষ্ঠন্তে ইতি”। হয়তো পরিচিত গন্ধের সঙ্গে মানুষ কিংবা মনুষ্যেতর প্রাণীও অন্তরের সম্বন্ধ অনুভব করে। এবার তাহলে মেলাতে পারলেন কী যে শেয়ালদুটির ক্ষেত্রে কেন পঞ্চতন্ত্রকার “মন্ত্রিপুত্রৌ”, “ভ্রষ্টাধিকারৌ”, আর “সদানুযাযিনৌ”— এই তিনটি বিশেষণ পর পর প্রয়োগ করেছেন? সম্ভবত কৌণপদন্তের রাজনীতির জ্ঞানটির উপর ভরসা করেই পিঙ্গলক মন্ত্রীপুত্র দুই শেয়ালকে অমাত্যপদে নিযুক্ত করেছিলেন এই ভরসায় যে তাদের অপকারসাধন করলেও তাঁরা রাজাকে ছেড়ে যাবে না। তাই বিশেষ কোনও কারণে নিজেদের কোনও কুকর্মের জন্যই পিঙ্গলক তাদেরকে পদচ্যূত করলেও তারা ছিল “সদানুযাযিনৌ”— সর্বদা রাজাকেই তারা অনুসরণ করতো। কারণ বংশ পরম্পরায় রাজবৃত্তিতেই তাঁরা অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় সেই সুখের জীবিকা ছেড়ে সহসা অন্য কিছু ভাবতে পারে না তারা। এইটাই হয়তো মনুষ্য চরিত্র — তারা চাকরীদাতার পিছন পিছন ঘুরে বেড়ায় আর ভাবে কীভাবে সেই পদটি তারা আবার ফিরে পাবে অথবা কিভাবেই বা আবার রাজার চোখে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারবে? এই মন্ত্রীপুত্রদ্বয়ের অবস্থা তখন এমনই ছিল।

কিন্তু বংশপরম্পরায় মন্ত্রীপুত্র মন্ত্রী হলে যে কতরকম গোলমালের সম্ভাবনা থাকে শ্রীকৃষ্ণের মন্ত্রী উদ্ধব, মানে রাজনীতিশাস্ত্রে যিনি বাতব্যাধি নামে পরিচিত, তিনি উল্লেখ করেছেন। কৌণপদন্তের মতের বিরোধিতা করে তিনি বলেছেন—

“তে হ্যস্য সর্বমগৃহ্য স্বামিবৎ প্রচরন্তীতি। তস্মান্নীতিবিদো নবানমাত্যান্‌ কুর্বীত। নবাস্তু যমস্থানে দণ্ডধরং মন্যমানা নাপরাধ্যন্তীতি”।

বাতব্যাধির মতে, বংশ পরম্পরায় যদি তাঁরা রাজার অমাত্য কর্মে নিযুক্ত থাকেন তাহলে তাঁদের প্রভুর বৈভব আত্মস্থ করে নিজেরাই একদিন রাজার মতো আচরণ করে। তবে শুধু যে বংশ পরম্পরায় নিযুক্ত হলেই এমনটা হয় তা নয়; অনেকক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে যে এই ধরণের রাজকর্মচারীরা, যাঁদের হাতে ক্ষমতা বেশি থাকে, অনেক সময়ে রাজাকেই তারা উত্ক্ষাত করে নিজেই রাজা হয়ে বসে। এ-প্রসঙ্গে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস থেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারি।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৬: আবার নুনিয়া

দশভুজা, পিকনিক দল থেকে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু: তাঁর লেন্সের বিস্তৃতি ছিল বিস্ময়কর

প্রথমত, মৌর্য সাম্রাজ্যের শেষ রাজা বৃহদ্রথ মৌর্যকে তাঁর সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ হত্যা করেন এবং খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ১৮৫ অব্দে স্বয়ং শুঙ্গ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাস বইয়ের পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষায় লেখা “অশোকাবদান” গ্রন্থের শেষ পাতাটি নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলেও এ ঘটনার একটা বিস্তৃত বিবরণ আপনি পেয়ে যাবেন সহজেই।

দ্বিতীয় তথ্যটি হল, খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ৭৫ অব্দে সেই শুঙ্গবংশেরই শেষ রাজা দেবভূতিকে হত্যা করে তাঁরই অমাত্য কাণ্ব বসুদেব মগধের পাটলিপুত্রে কাণ্ব বংশের প্রতিষ্ঠা করেন, যদিও পাথুরে প্রমাণ হিসেবে তাঁদের অধিকাংশ মুদ্রাগুলি পাওয়া গিয়েছে মধ্যভারতের বিদিশা অঞ্চলের আশেপাশে, যেখানে পরবর্তীকালে শুঙ্গদের রাজধানী স্থানান্তরিত হয়েছিল শুঙ্গসম্রাট ভগভদ্রের আমলেই আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১১০ অব্দে। মধ্যপ্রদেশের সাঁচী বেড়াতে গিয়ে যদি অতিরিক্ত মিনিট কুড়ি আপনি ব্যয় করেন তাহলে বিদিশার কাছে হেলিওডোরাস স্তম্ভ দেখে আসতে পারেন, যেখানে ব্রাহ্মী অক্ষরে লেখা একটি শিলালেখ থেকে জানতে পারি যে তক্ষশীলার বাসিন্দা দিওয়েনের পুত্র হেলিওডোরাস ইন্দো-গ্রিক শাসক আন্তিয়াল্কিদাস নিকেফোরোসের দূত হয়ে শুঙ্গসম্রাট কাসিপুত্ত (কাশিপুত্র?) ভগভদ্রের শাসন কালে বিদিশা নগরীতে উপস্থিত হয়ে বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে সেই স্তম্ভ স্থাপন করেন।

মধ্যপ্রদেশের বিদিশায় হেলিওডোরাস স্তম্ভ (খ্রিস্টপূর্ব ১১০ অব্দ)। ব্রাহ্মী অক্ষরে লেখা শিলালেখ।

যাইহোক ইতিহাস ছেড়ে আবার গল্পের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। তাই বাতব্যাধির মত হল যোগ্যতা সম্পন্ন নতুন কাউকেই অমাত্য পদে নিয়োগ করা উচিত, কারণ নতুন সেই অমাত্যরা রাজাকে যমের মতো উগ্রদণ্ড ভেবে কোনও প্রকার অপরাধ করতে সাহস পাবে না। তবে কৌটিল্যের মত কিন্তু এদের সকলের থেকে আলাদা। কৌটিল্যের বক্তব্য হল সকলের মতই গ্রহণ করতে হবে অবস্থা বিচার করে— “সর্বমুপপন্নমিতি কৌটিল্যঃ”। কৌটিল্যের পূর্ববর্তী আচার্যরা অমাত্য নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে যা যা বলেছেন সে সব কথা মাথায় রেখেই প্রয়োজন ও অবস্থা বুঝেই অমাত্য নিয়োগ করতে হয়—সব মতোই গ্রহণযোগ্য আবার কোনওটাই যথার্থ নয়।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৯: পাকা আম খাবেন, নাকি কাঁচা আম?

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-২০: রায়পুর থেকে রাজিম

করটক ও দমনক ছিলেন মন্ত্রীপুত্র। বংশ গরিমার কারণে অতীতে তারা মন্ত্রীপদ লাভ করলেও, এখন তারা অজ্ঞাত কোনও কারণে পদচ্যূত; তবুও তারা রাজার সঙ্গেই ঘুরে বেড়ায় আর সুযোগের সন্ধানে থাকে যে কি করে সেই পদমর্যাদা আবার ফিরে পাওয়া যায়। সিংহরাজা পিঙ্গলক তাঁর পিপাসা নিবৃত্তির জন্য যমুনা কচ্ছে জল খেতে নেমে, সঞ্জীবকের গর্জন শুনে জল পান না করে ব্যূহরচনা করে চতুর্মণ্ডলের একেবারে কেন্দ্রে মুখে দুঃশ্চিন্তা নিয়ে লুকিয়ে থাকে। এইসব দেখে দুজনের মনেই সন্দেহ জাগে যে হয়তো কোনও কারণে ভয় পেয়েছে পিঙ্গলক। তাই এই সুযোগটারই সদ্ব্যবহার করা উচিত, মানে যদি কোনও ভাবে এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্থানটিকে আবার রাজার পাশে পাকাপোক্ত করে নেওয়া যায় তো ক্ষতি কী? কিন্তু করটক ছিলো বিচক্ষণ ও সাবধানী। সংস্কৃতে “করটক” শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল কাক। বাস্তব জগতেও দেখবেন কাক খুবই সাবধানী একটি প্রাণী; সামান্য কিছু বিপদ দেখলেই সে যেমন মূহুর্তে সে স্থান ছেড়ে উড়ে পালিয়ে যায়, করটকের চরিত্রও ঠিক তেমনই। সে শেয়ালের মতো বুদ্ধিমান আবার কাকের মতো সাবধানী। কিন্তু অপরদিকে “দমনক” শব্দের অর্থ হল যে দমন করতে পারে বা জয় লাভ করে। সে বুদ্ধিমান শেয়াল কিন্তু সেই সঙ্গে হঠকারীও, ঝুঁকি নিতে ভয় পায় না সে। আবার এটাও ঠিক যে ঝুঁকি না নিলে জীবনে বড় কিছু অর্জনও করা যায় না।

তাই দমনককে সাবধান করে করটক বলে, “ভদ্র কিমাবয়োরনেন ব্যাপারেণ?”— এইসব অপ্রয়োজনীয় ঝামেলার মধ্যে মাথা গলিয়ে লাভ কী? কারণ যারা নিজের কাজের বাইরে অন্যের কাজে বেশি মাথা ঘামায় তাদের সেই কীলক (বা চেড়াই করে ফাঁক করা কাঠের তক্তার মাঝে আটকানো গোঁজ) উপড়ে ফেলায় মরে যাওয়া সেই বাঁদরটার মতো অবস্থা হয়।

অব্যাপারেষু ব্যাপারং যো নরঃ কর্তুমিচ্ছতি।
স এব নিধনং যাতি কীলোত্পাটীব বানরঃ।।


দমনক বলে, সে ব্যাপারটা তো জানা নেই – “কথমেতৎ?” করটক তখন মূর্খবানরের গল্পটা বলতে শুরু করে।—চলবে
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content