
ছবি: প্রতীকী।
মিত্রসম্প্ৰাপ্তি
সোমিলক নিজের স্ত্রীকে বুঝিয়ে বললে, নিজের সামর্থ্য অনুসারে কঠোর পরিশ্রম করেও দুর্ভাগ্যবশত যদি কোনও মানুষের কার্যসিদ্ধি না হয়, তাহলেও সেই মানুষকে কিন্তু কখনই হতোদ্যম করা উচিত নয়। কারণ সে অন্তত প্রচেষ্টা করেছে। তাই অবশ্যই এখন অন্য দেশে যাওয়াটাই আমার প্রয়োজন।
এইসব চিন্তাভাবনা করে সোমিলক বর্ধমানপুরে গেল এবং সেখানে বছর তিনেক থেকে প্রায় তিনশো স্বর্ণমুদ্রা উপার্জন করে নিজগৃহের পথে রওনা হল। মাঝপথে এক গভীর অরণ্যের মধ্যে সে যখন প্রবেশ করেছে ঠিক তখনই সূর্য অস্তাচলে গিয়েছে। চারিদিকে অন্ধকার ক্রমশ ঘনীভূত হতে শুরু করলো। সোমিলক তখন হিংস্র জানোয়ারের ভয়ে এক বিশাল বটবৃক্ষের একটা মোটা ডালে গিয়ে চড়ে বসল। সারাদিনে পথশ্রমে মধ্যরাত্রে সে যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন স্বপ্নে ভয়ঙ্কর দেখতে দুই পুরুষকে পরস্পরের মধ্যে কথা বলতে শুনল। তাদের মধ্যে একজন বলল, কর্তা গো! তুমি তো এ-কথা ভালো করেই জানো যে এই সোমিলকের ভাগ্যে কেবল খাওয়া-পরার মতন অর্থ ছাড়া অতিরিক্ত কিছুই নেই। তাহলে কেন তুমি একে তিনশো স্বর্ণমুদ্রা দিলে?
কর্তা তখন বলল, ওহে কর্ম! এই সোমিলক একজন উদ্যোমী মানুষ আর যে উদ্যোমী তাকে তো আমি অবশ্যই ধনসম্পত্তি দেব। তবে সে সম্পত্তি তার কাছে থাকবে কি থাকবে না সেটা যদিও তোমার উপর নির্ভর করছে।
এইসব চিন্তা করে পুনরায় সে আবার সেই বর্ধমানপুরেই ফিরে গেল। সেখানে এক বছরের মধ্যেই পাঁচশো স্বর্ণমুদ্রা রোজগার করে আবার যখন গৃহের পথে চলতে শুরু করল তখন সেই আগের জঙ্গলেই সূর্যাস্ত হল। কিন্তু পথশ্রমে প্রবল ক্লান্ত হলেও এ বার কিন্তু সে ঘুমালো না। ঘর পৌঁছনোর উত্সাহে দ্রুত সেই অন্ধকারেই পথ চলতে শুরু করলো সে। এরই মধ্যে আগের মতন সে আবার সেই ভয়ঙ্কর দর্শন দুইজন পুরুষকে দেখল। এখন সে দু’জনকেই বেশ ভালোভাবেই চিনতে পারলো। তাদের একজন কর্ম আর অপরজন হলেন কর্তা। কর্ম বললেন, ওহে কর্তা! তুমি তো দেখছি একে পাঁচশো স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছো। তুমি কি জানো যে খাওয়া-পরার অতিরিক্ত ধন এর কলাপে নেই?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৫: রবীন্দ্রনাথ ভয় পেতেন মহর্ষিদেবকে

শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন
শুনেই সোমিলক নিজের থলেতে হাত দিয়ে দেখে তাতে কোনও স্বর্ণমুদ্রাই অবশিষ্ট নেই। সে তখন আবার অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে চিন্তা করল, আমার মতো ধনহীনের এভাবে বেঁচে থেকে আর কি হবে? তাই এই বটবৃক্ষেই ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ে প্রাণত্যাগ করাই ভালো।
এইসব ভেবে সে জঙ্গলে আপনা থেকেই গজিয়ে ওঠা অনেক কুশঘাস জড়ো করে বেশ মোটা একটা দড়ি বানালো। বুনন কার্যে তার মতো ওস্তাদ যে খুব কমই ছিল, সে কথা আমরা আগেই জেনেছি। সেই দড়িতে ফাঁস লাগিয়ে সোমিলক যখন গলায় পরে ঝুলে পড়তে যাবে ঠিক সেই সময় আকাশমার্গে শূন্যে এক পুরুষ ভেসে উঠে বললে— “ভোঃ ভোঃ সোমিলক! মৈবং সাহসং কুরু।” —ওহে সোমিলক! এমন দুঃসাহস করো না। আমিই সেই ব্যক্তি যে তোমার ধন হরণ করেছি। অন্ন-বস্ত্রের উপযোগী সম্পদ ছাড়া অতিরিক্ত কোনও সম্পদই তোমার হলে তা আমি সহ্য করতে পারি না। তাই তুমি এখন নিজের ঘরে ফিরে যাও। এছাড়াও তোমার এই দুঃসাহসের প্রচেষ্টায় আমি খুশি হয়েছি বলেই তোমার সামনে আবির্ভূত হয়েছি। তাই আমার দর্শন তোমার ব্যর্থ হবে না; তুমি ঈপ্সিত বর প্রার্থনা কর।

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৬: যদি হই চোরকাঁটা

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮১: সুন্দরবনের পাখি—বেনে বউ
সেই দিব্যপুরুষ তখন বললেন, যে ধন তুমি ভোগ করতে পারবে না সেই অতিরিক্ত ধন পেয়ে কি হবে? কারণ অন্ন-বস্ত্রের অতিরিক্ত সম্পদ তোমার ভাগ্যে নেই। সেই সম্পদটা দিয়ে হবেটা কি? যে সম্পদ কেবল নিজপত্নীর মতন কেবল নিজের উপভোগের জন্য মাত্র? সামান্য একজন বেশ্যার মতনও যে ধন পথিকজনদের কাজে লাগে না, সে ধনের কোনও সার্থকতা নেই। কেবল নিজের জন্য সম্পদ অর্জনে কোনই সার্থকতা নেই, সেই অর্জিতধন যদি বহু মানুষের কাজে লাগে তবেই সে ধনের সার্থকতা।
সোমিলক বললে, সে সম্পদ আমার ভোগে না লাগলেও আমি চাই সে সম্পদ আমার হোক। আমার প্রভূত ধনসম্পত্তি হোক। পণ্ডিতেরা বলেন— যে লোকের কাছে ধনসম্পত্তি থাকে সে লোক কৃপণ হোক বা নীচ মানসিকতার মানুষই হোক, সকলেই তাকে সম্মান করে। এমনকি সজ্জন পুরুষেরাও যদি সেই ধনবান নীচ মানসিকতার ব্যক্তিকে তার ব্যবহারের জন্য পরিত্যাগও করেন, তাহলেও সকল লোকে তাকে সম্মান করে। শুধু তার টাকাপয়সা থাকে বলেই।
শুধু কি তাই? সেই শেয়ালটার গল্প জানেন তো? যে সুদৃঢ় ঝুলন্ত সেই ষাঁড়টির অণ্ডকোষ দুটো খুলে পড়বে, নাকি কি পড়বে না। এই প্রতীক্ষায় তার দিকে নিরন্তর তাকিয়ে থাকতে থাকতে পনেরো বছর কেটে গেল।
সেই দিব্য পুরুষটি বলল, “কিমেতৎ?” সে ঘটনাটা আবার কি রকম?
সোমিলক বলতে শুরু করল—।

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৫: বিরোধিতায় নয়, মৈত্রীবন্ধনেই রয়েছে পারিবারিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানসূত্র

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৮: কাপুরুষরাই শুধু দৈবের দোহাই দিয়ে নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দেয়
৬: ষাঁড়ের পিছনে পিছনে চলতে থাকা শেয়ালের কাহিনি
কোনও এক জায়গায় তীক্ষ্ণবিষাণ নামে মহাদেবের ষাঁড়ের মতো বিশাল চেহারার এক শক্তিশালী ষাঁড় বাস করতো। সে ছিল একেবারে স্বার্থকনামা। নিজের শারীরিক শক্তির কারণে সে এতটাই দাম্ভিক ছিল যে সে তার দলের অন্যান্যদের সঙ্গে থাকতো না। সে একা একাই নদীর ধারে ঘুরে বেরাতো। তীক্ষ্ণ শিং দুটো দিয়ে নদী তীরের মাটি তুলতো আর মরকত মণির মতো সবুজ কচি কচি ঘাস খেয়ে জঙ্গলে সর্বত্র ঘুরে বেড়াতো।
সেই বনেই প্রলোভক নামে এক শেয়াল বাস করতো। কোনও একদিন সে তার পত্নীর সঙ্গে নদীতীরে সুখে বসে ছিল। ঠিক তখনই তীক্ষ্ণবিষাণ নামের সেই ষাঁড়টি জল খেতে নেমেছিল নদীতটে। তখন তার ঝুলন্ত অণ্ডকোষ দুটিকে দেখে শৃগালপত্নী তাঁর স্বামী প্রলোভককে বললেন, হে স্বামী! চেয়ে দেখুন একবার এই ষাঁড়টির ঝুলে থাকা ওই মাংসপিণ্ড দু’টি! দেখে মনে হচ্ছে এখনই বা কিছু সময়ের মধ্যেই ওটা খসে পড়বে। তাই আমার মনে হয় এর আপনি এর পিছনে পিছনেই থাকুন। অনায়াসে এই মাংসখণ্ড দু’টো তখন আমরা পেয়ে যাব।

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪৩: বীরবিক্রম ত্রিপুরায় শিক্ষা সম্প্রসারণে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১১: কাঁটার মুকুট
ধ্রুবাণি তস্য নশ্যন্তি অধ্রুবং নষ্টমেব চ।। (মিত্রসম্প্রাপ্তি, ১৪২)
অর্থাৎ কোনও বস্তু নিশ্চিতভাবে পাওয়া যাবে জেনেও যদি কোনও ব্যক্তি সেটাকে বাদ দিয়ে অনিশ্চিতের পিছনে ছোটে তাহলে তার মতো বোকা লোক এই দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি হয় না। নিশ্চিত বস্তুটা তো হাত ছাড়া হয়ই, আর সেই অনিশ্চিত জিনিসটা আদৌ পাওয়া যাবে কি যাবে না সেটা কেউই বলতে পারে না। কারণ সেটা প্রকৃত অর্থেই অনিশ্চিত।
প্রলোভকের কথা শুনে শৃগালী ঝাঁঝিয়ে বলল, তুমি আসলে একটা কাপুরুষ। যাহোক কিছু একটা পেলেই তোমার আকাঙ্খা মিটে যায়। লোকে ঠিকই বলে, যে নদীতে নাব্যতা নেই সে নদী সামান্য জলেই ভরে যায়। ঠিক যেমন সামান্য চাল দিলেই ইঁদুরের দু’হাত ভরে যায়। কাপুরুষরাও তেমনই হয়, সামান্য কিছু পেলেই তারা সন্তুষ্ট হয়ে যায়। তাই বড় কিছু পাওয়া আর তাদের ভাগ্যে ঘটে না। মানুষের মনের মধ্যে বড় কিছু করবার উত্সাহ না থাকাটা নিতান্তই অনুচিত। একমাত্র তোমার মতন কাপুরুষরাই যে কোনও কাজ করতে বললেই পিছিয়ে আসে।—চলবে।