বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

মিত্রসম্প্ৰাপ্তি

বিবাহের শুভ মুহূর্ত যখন প্রায় উপস্থিত, তার কিছু সময় পূর্বে থেকেই সে দেশের শ্রেষ্ঠীর ঘরের দরজার সামনে সজ্জিত মণ্ডপে তাঁর পুত্রী বিবাহ বেদীতে মঙ্গলসূত্র বেঁধে বিবাহের উপযুক্ত মঙ্গল বেশভূষা ধারণ করে প্রতিক্ষা করছিল বরকীর্তির জন্য। ঠিক সে সময়েই কোথা থেকে এক মদমত্ত হাতি তার পিঠে বসা মাহুতকে মেরে পালাতে পালাতে বরযাত্রীদের কোলাহলের মধ্যে ঢুকে পড়লো। তাকে দেখে সকল বরযাত্রীরা বরকে শুদ্ধ নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে এদিক ওদিক পালিয়ে গেল।

ঠিক সেই সময়েই ‘প্রাপ্তব্যমর্থ’ ভয়ে চঞ্চল নেত্রে স্থিত কন্যাকে দেখে বললো ‘মা ভৈষীঃ! অহং পরিত্রাতা’ —ভয় পেয়ো না! আমি তোমাকে পরিত্রাণ করবো। আমি তোমার রক্ষক। এই বলে সে সেই কন্যার ডানহাতটি ধরে অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে বিকট শব্দ করে হাতিটিকে বকাঝকা শুরু করলো এবং কাকতালীয় ভাবে হাতিটা সেখান থেকে পালিয়েও গেল।

তার কিছুক্ষণ পরে, তখন বিবাহলগ্ন পেরিয়ে গিয়েছে, বরকীর্তি তখন সকল বরযাত্রীদের নিয়ে বিবাহ মণ্ডপে ফিরে এসে দেখে শ্রেষ্ঠী কন্যা ‘প্রাপ্তব্যমর্থ’-এর হাত ধরে আছে। কন্যাকে অন্যের হস্তগত দেখে সেই বরকীর্তি তখন শ্রেষ্ঠীকে বললো, ওহে শ্বশুরমশাই! এই কাজটা তো আপনি ঠিক করলেন না। আমাকে দেবেন বলে এই কন্যাকে অন্যের হাতে সমর্পণ করে দিলেন? এতো আপনার ধর্মবিরুদ্ধ কাজ হল।

শ্রেষ্ঠী তখন রীতিমতো অপ্রস্তুত। তাঁর বিন্দুমাত্রও ধারণা ছিল না যে ঠিক কী থেকে সেই মুহূর্তে কি হয়ে গিয়েছে! সে বলল, আমিও তো হাতির ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। আপনাদের সঙ্গেই ফিরে এলাম। আমি নিজেও তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না যে কি এমন ঘটল! তারপর কন্যাকে বললেন, পুত্রী এই কাজটি তো তুমি ঠিক করোনি। তুমিই এবার বলো যে কি ভাবে এইসব ঘটলো?

শ্রেষ্ঠীকন্যা তখন ‘প্রাপ্তব্যমর্থ’কে দেখিয়ে বললে, মত্ত হাতির ভয়ে আপনারা সকলে যখন পালিয়ে গিয়েছিলেন, এই মানুষটিই তখন আমাকে আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। তাই ইনি জীবিত থাকতে অন্য কেউ আমার পাণিগ্রহণ করতে পারবে না।

এইসব তর্কাতর্কি করতে করতে সারারাত কেটে গেলো। সকাল হতে না হতেই সেখানে লোকজন জমা হতে শুরু করল তামাশা দেখতে। বেলা যতো বাড়তে লাগল লোকের ভীড় ততোই বাড়তে লাগলো। খবর ছুটতে লাগলো বায়ুর থেকেও দ্রুত। খবর শুনে রাজকুমারী চন্দ্রাবতী এবং নগররক্ষক কোটালের কন্যা বিনয়বতীও সেখানে এসে উপস্থিত হলো। লোকজনের ভীড় জমেছে শুনে দেশের রাজাও এসে উপস্থিত হলেন সেখানে। তিনি এসে ‘প্রাপ্তব্যমর্থ’কে বললেন, নির্ভয়ে তোমার সকল বৃত্তান্ত বলো? আমরা সবটা শুনতে চাই।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৬: দরিদ্রেরা কিছু দান করবার ইচ্ছা নিয়ে এলেও লোকে ভাবে কিছু চাইতে এসেছে

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০২: দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি

সে উত্তরে সেই একই কথা বলল, ‘প্রাপ্তব্যমর্থং লভতে মনুষ্যঃ’—যে মানুষ নিজের প্রাপ্য জিনিষটুকুই পেয়ে থাকেন। রাজকন্যা চন্দ্রাবতী বললেন, ‘দেবোঽপি তং লঙ্ঘযিতুং ন শক্তঃ’ – কোনও দৈবশক্তিতেই সেই দ্রব্য প্রাপ্তিতে তার বাধা দিতে পারে না। নগররক্ষক কোটালপুত্রী বিনয়বতী বললেন, ‘তস্মান্ন শোচামি ন বিস্মযো মে’। তাই আমি শোকগ্রস্তও যেমন হই না, আশ্চর্যও হই না। সকল কাহিনি বলে সেই বণিকপুত্র শেষে বললেন, ‘যদস্মদীযং ন হি তত্পরেষাম্’, যা আমার ভাগ্যে আছে তা অন্যের কপালে জুটবে না —এটা আমি নিশ্চিত।

রাজা তখন সমস্ত বৃত্তান্ত আলাদা আলাদা ভাবে শুনে, সেই বণিকপুত্র ‘প্রাপ্তব্যমর্থ’কে অভয় প্রদান করে নিজের কন্যাকে একহাজার গ্রাম, সমস্ত অলঙ্কার এবং অসংখ্য দাসী সহিত ‘প্রাপ্তব্যমর্থ’কে সমর্পণ করলেন এবং তাঁকে নিজের পুত্র বলে ঘোষণা করে যুবরাজ পদেও অভিষিক্ত করলেন। নগররক্ষক কোটালও নিজের কন্যা বিনয়বতীতে আপন ক্ষমতা অনুসারে বস্ত্র অলঙ্কারাদিতে ভূষিত করে ‘প্রাপ্তব্যমর্থ’কে সমর্পণ করলেন। রাজা, কোটাল এবং শ্রেষ্ঠী। এই তিনজনের কন্যাকে বিবাহের ফলে ‘প্রাপ্তব্যমর্থ’ সেই নগরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি হয়ে উঠলেন। এরপর সেই প্রাপ্তব্যমর্থ তাঁর মাতা-পিতা এবং পরিবারের অন্যান্য আত্মীয়পরিজনকে সেই নগরে সসম্মানে নিয়ে এলেন। নিজের পরিবারবর্গের সঙ্গে বৈভবের সঙ্গে নানারকমের সুখ ভোগ করতে করতে সে জীবন অতিবাহিত করতে লাগল।

৪র্থ কাহিনি সমাপ্ত

আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৮: সুন্দরবনের পাখি—শামুকখোল

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৫: ‘ছেলেদের জন্য আমার কোনও নিয়মকানুন থাকে না’

কাহিনি শেষ করে হিরণ্যক কচ্ছপ মন্থরককে বলল, এইজন্যেই আমি বলেছিলাম মানুষ যেটুকু পাওয়ার সেইটুকুই পায়, তার অতিরিক্ত নয়। সত্যি বলতে এইসব সুখ-দুঃখ অনুভব করে আমি এখন অত্যন্ত বিষাদগ্রস্ত হয়ে আছি। তাই এখন এই মিত্র লঘুপতনকের মাধ্যমে আজ আপনার কাছে এসে উপস্থিত হয়েছি। এইসবই এখন আমার জীবনের বৈরাগ্যের কারণ।
মন্থরক বললে, হে ভদ্র! এই বায়স লঘুপতনক নিঃসন্দেহে আপনার একজন অভিন্নহৃদয় বন্ধু। কারণ ইনি ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর হলেও, আপনাকে সে পিঠে করে এতোদূর উড়ে এসেছেন এটা জেনেই যে আপনি তাঁর একটি খাদ্য। এমনকি পথিমধ্যেও আপনাকে সে খাদ্যরূপে গ্রহণ করেননি।

কথায় বলে, প্রচুর ধনসম্পদ পেয়েও যাঁর মন বিকারগ্রস্ত হয় না এবং যিনি সুখে এবং দুঃখে–উভয় সময়েই সমান মিত্রতা বজায় রাখেন, সেইরকম সজ্জনপুরুষের সঙ্গেই মিত্রতা করা উচিত। বিদ্বান পুরুষের উচিত হোমাগ্নির সমান এই সমস্ত লক্ষণের মাধ্যমে মিত্রকে যথাযথভাবে পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত। বিপত্তির সময়ে যে মিত্রতা বজায় রাখে সেই প্রকৃত মিত্র। বৈভবকালে তো দুষ্টব্যক্তিও মিত্রের মতন আচরণ করে। সত্যি বলতে আমারও আজ এই বায়স লঘুপতনকের সঙ্গে মিত্রতায় আর কোনও সন্দেহ নেই। না হলে মাংসাশীপ্রাণীদের সঙ্গে আমাদের মতন জলচর প্রাণীদের বন্ধুত্ব যে স্বাভাবিক নয় সেটা আমরা সকলেই জানি। পণ্ডিতেরা ঠিকই বলেন—

মিত্রং কোঽপি ন কস্যাপি নিতান্তং ন চ বৈরকৃৎ।
দৃশ্যতে মিত্রবিঘ্নস্তাত্কার্যাদ্বৈরী পরীক্ষিতঃ।। (মিত্রসম্প্রাপ্তি ১১৭)

অর্থাৎ কেউ কারও সব সময়ের শত্রু বা সবসময়ের মিত্র হয় না। কোনও না কোনও উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যেই লোকে শত্রু হয়ে অন্যের বিনাশ করে কিংবা মিত্র হয়ে অন্যকে রক্ষা করে। তাই আপনাদের দুজনকে স্বাগত। এই সরোবরের ধারেই কোথাও আপনারা নিজের বাড়ির মতোই স্বচ্ছন্দে বাস করুন আর আপনাদের যে ধনসম্পত্তি নষ্ট হয়েছে বা আপনাদের যে এইভাবে বিদেশে থাকতে হচ্ছে—এই সব নিয়ে আর দুঃখ করবেন না। কথায় বলে, মেঘের ছায়া, দুষ্টলোকের ভালোবাসা, পাকা ধান, স্ত্রী, যৌবন এবং ধনসম্পদ। এ সব কিছুরই ভোগ করার নির্দিষ্ট সময়কাল থাকে। চিরকাল কেউ এইসব ভোগ করতে পারে না।

আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৯: আসছে আমার পাগলা ঘোড়া

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৩: কালাদেওর কবলে

এই জন্য বিচারশীল এবং সংযতচিত্ত পুরুষেরা ধনসম্পদ নিয়ে বেশি আশা আকাঙ্খা করেন না। প্রকৃতপক্ষে সারাজীবন কষ্টস্বীকার করে অর্জিত এই ধনসম্পদ সঞ্চয় করে এবং তাকে নিজের জন্যে বিন্দুমাত্র খরচ না করে সঞ্চিত এই নিষ্ঠুর ধনসম্পদ সেই ধনস্বামীর মৃত্যুর পর যমের বাড়ি যাওয়ার পাঁচ পা-ও পিছন পিছন অগ্রসর হয় না। তাই ধনসম্পদ এই জন্মে যেটুকু পারো ভোগ করে নেওয়া উচিত। না হলে আপনি যে সঞ্চিত ধনের কথা বলছেন সে তো পরপারে কোনও কাজেই লাগে না। বরং সেটা চলে যাওয়ায় আপনি মোহমুক্ত হওয়ার সুযোগ পেলেন। অন্যভাবে বললে বলতে হয়, মাংসের টুকরো জলে পড়লে যেমন মাছেরা খেয়ে নেয় কিংবা ভূপৃষ্ঠে হিংস্র পশুরা এবং আকাশের পাখিরা নিঃশেষে খেয়ে নেয়; সেই রকমই ধনী পুরুষদেরও অন্যলোকে মাংসের টুকরোর মতো খায়।

মানেটা হল, ধনসম্পত্তি থাকলেই দশটা লোকজুটে যায় কিংবা নতুন নতুন এমন সব বিপদ এসে উপস্থিত হবে যেখানে বাধ্য হয়েই আপনাকে বৃথা বহু সম্পদ খরচ করতে হয়। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা কি জানেন তো ভাই? দোষ না করলেও রাজা ধনী লোককেই দোষী প্রতিপন্ন করে তাঁকে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করে নানা ছলে তাঁর কাছ থেকে ধন লুণ্ঠন করে। উল্টে হাজারটা দোষ করলেও ধনহীন ব্যক্তিকে অনেক উপদ্রব কম সহ্য করতে হয়। সত্যি বলতে –

অর্থানামর্জনে দুঃখমর্জিতানাং চ রক্ষণে।
নাশে দুঃখ ব্যয়ে দুঃখ ধিগর্থান্ কষ্টসংশ্রযান্।। (ঐ, ১২২)

আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৫: ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এবং চলচ্চিত্র

প্রথমত, অর্থ রোজকার করতে কষ্ট। দ্বিতীয়ত, সেই অর্জিত অর্থ রক্ষা করতেও নানা দুঃখ পেতে হয়। তারপরেও সেই ধন যদি নষ্ট হয়ে যায় তার জন্য প্রবলতর দুর্দশা ভোগ করতে হয়। আবার খরচ হয়ে গেলেও দুঃখের শেষ নেই। তাই আগাগোড়া যে ধন শুধু কষ্টের কারণ তাকে ধিক্কার দেওয়াই উচিত। প্রকৃতপক্ষে মানুষ ধনসম্পদ অর্জন করতে যে পরিমাণ দুঃখ সহ্য করে তার একচতুর্থাংশও যদি সে মোক্ষলাভের জন্যে চেষ্টা করে তাহলে অনায়াসে তার মোক্ষলাভ হয়ে যায়। এই কারণেই বিবেকী এবং সংযমী পুরুষের ধনসম্পদের অভিলাষা না থাকাই তাঁদের চিত্তপ্রশান্তির ক্ষেত্রে ভালো। —চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content