বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি : প্রতীকী।

মিত্রসম্প্ৰাপ্তি


০১: হিরণ্যক ও তাম্রচূড়ের কথা
দাক্ষিণাত্য জনপদে মহিলারোপ্য বলে একটি নগর ছিল। সেই নগরের কাছেই ভগবান মহাদেবের একটি মন্দির ছিল। সেখানে তাম্রচূড় নামে এক শৈব সন্ন্যাসী বাস করতো। নগরে ভিক্ষাবৃত্তি করে সে যা কিছু পেতো তাই দিয়েই তার জীবন চলে যেতো। উপরন্তু যেটুকু ভিক্ষান্ন তার অবশিষ্ট থাকতো সেটা তার সেই ভিক্ষা পাত্রের মধ্যেই রেখে ছাদ থেকে ঝুলতে থাকা একটি ‘নাগদন্ত’ অর্থাৎ আঁকশির মধ্যে ঝুলিয়ে রাখতো। সকালে সেই অবশিষ্ট ভিক্ষান্নের বিনিময়েই কর্মকারদের দিয়ে সেই মন্দিরচত্বর সে পরিষ্কার-পরিছন্ন করাতো সে। পরিব্রাজক তাম্রচূড়ের দিন চলছিল এই ভাবেই।

একদিন আমার [অর্থাৎ ইঁদুর হিরণ্যক আত্মীয়-পরিজনেরা সকলে এসে বলল, হে স্বামী, ঐ শৈবমঠের সন্ন্যাসী রোজ ভিক্ষা করে পাওয়া চালগুলো ইঁদুর ভয়ে ভিক্ষাপাত্রে রেখে সেটাকে একটা উঁচু আঁকশিতে ঝুলিয়ে রাখে। ফলে আমরা আর সেগুলো নাগালে পাই না। কিন্তু আপনার কাছে কিছুই দুর্গম নয়— এটা আমরা জানি। আপনি সর্বত্রই যেতে পারেন। তাই চারিদিক অকারণে অন্নের জন্য ঘুরে বেরাবার কোনও মানেই হয় না। আপনি একটু সহায় হলেও আপনার অনুগ্রহে সেখানে গিয়ে আমরা সকলেই আপনার প্রসাদ পেতে পারি— “অদ্য তত্র গত্বা যথেচ্ছং ভুঞ্জামহে ভবতঃ প্রসাদাৎ”। মানেটা হল এত উঁচুতে অন্ন ঝোলানো আছে যে আমরা নাগলে পাচ্ছি না, কিন্তু আপনি সব জায়গায় যেতে পারেন তাই আপনি যদি একটু উদ্যোগ নেন তাহলে আমরাও অনায়াসে একটু ভালোমন্দ খেতে-টেতে পাই।
আমি তখন সব ইঁদুরদের নিয়ে তখনই সেখানে এসে উপস্থিত হলাম। অনাসায়ে লাফিয়ে নাগদন্তে খোলানো সেই ভিক্ষাপাত্রে উঠে গেলাম। সেখান থেকে রোজ সেই সমস্ত বিশেষ বিশেষ খাবারগুলো আমার সকল অনুচরদের আগে দিয়ে পরে যেটুকু অবশিষ্ট থাকতো সেটা পেট ভরে খেয়ে নিজের ডেরায় ফিরে যেতাম। এইভাবে রোজই আমাদের বেশ মহাভোজ চলছিল। সেই পরিব্রাজকও নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী আমাদের হাত থেকে সেই ভিক্ষাপাত্র বাঁচাবার চেষ্টা করতো। কিন্তু যখনই সে ঘুমাতে যেতো তখনই আমি সদলবলে এসে সেই ভিক্ষাপাত্রে লাফিয়ে উঠে নিজেদের কাজ সেরে নিতাম।

এরপর সেই পরিব্রাজক আমাদের তাড়ানোর জন্য অভিনব একটা উপায় খুঁজে বের করল। কোথা থেকে একটা ফাটা বাঁশের টুকরো নিয়ে এল আর সবসময় সেটাকে তার হাতের কাছে রাখত। এমনকি যখন সে ঘুমাতো সেই সময়েও ঘুমের মধ্যে আমাদের ভয় দেখানোর জন্য সেই ফাটা বাঁশের আওয়াজ করতো। আমিও কিছুটা খেয়ে আবার বাঁশের ঘা খাওয়ার ভয়ে পালিয়ে যেতাম আবার সুযোগ বুঝে আবার সেই ভিক্ষাপাত্রে লাফ দিয়ে উঠতাম। সেও আবার ফাটা বাঁশের শব্দ করে ভয় দেখাতো। এভাবে সারাটা রাত্রি জুড়ে আমাদের মধ্যে একটা ‘বিগ্রহ’ চলতো।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬১: মিষ্টি কথার মানুষের কোনও শত্রু হয় না

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

বাংলাতে যুদ্ধ-বিগ্রহ কথাটা আমরা একসঙ্গে উচ্চারণ করলেও অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায় ‘যুদ্ধ’ আর ‘বিগ্রহ’ জিনিষটা কিন্তু আলাদা। আর সত্যি বলতে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে প্রতিবেশী শক্তিশালী রাজার সঙ্গে সন্ধি করে কার্যসিদ্ধি না হলে সেক্ষেত্রে ‘বিগ্রহ’-এর প্রসঙ্গ আছে। ‘বিগ্রহ’ হল অনেকটা কপট যুদ্ধ। এখানে সরাসরি সৈন্য সাজিয়ে আক্রমণের বার্তা দিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে এসে যুদ্ধ হয় না। এই যুদ্ধ হয় গোপনে। একে ছায়া যুদ্ধও বলা যেতে পারে। গুপ্তচর পাঠিয়ে বা অন্যকোনও উপায়ে প্রতিবেশী রাজাকে অসুবিধায় ফেলবার উপায়ই হল ‘বিগ্রহ’। আর বিগ্রহে কাজ না হলে তখন আসে যুদ্ধের প্রসঙ্গ। অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায় যুদ্ধকে বলে ‘যান’। সৈন্যসামন্ত নিয়ে শত্রুরাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রাকেই বলে ‘যান’। ফলে বাংলায় বহুল ব্যবহৃত এই ‘যুদ্ধ-বিগ্রহ’ শব্দবন্ধনীতে ‘যুদ্ধ’ শব্দটিকে আমরা আগে ব্যবহার করলেও যুদ্ধ বা ‘যান’ কিন্তু হচ্ছে শেষ উপায়। আর ‘বিগ্রহ’-এর মধ্যে যুদ্ধের একটা বৈশিষ্ট্য থাকলেও সে যুদ্ধ কিন্তু সরাসরি যুদ্ধ নয়। পরিব্রাজক তাম্রচূড়ের সঙ্গে সেইরকমই একটা যুদ্ধ চলতো সারারাত জুড়ে সেই ইঁদুর হিরণ্যকের। তাই পঞ্চতন্ত্রকার সুন্দর ভাবে বলছেন— ‘এবং তেন সহ সকলাং রাত্রিং বিগ্রহপরস্য কালো ব্রজতি’। অর্থাৎ এইভাবে তার সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ করেই দিন কেটে যাচ্ছিল বেশ।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৫: সাফল্য কি বংশগত উত্তরাধিকার? না কি ব্যক্তিগত কৃতিত্বের প্রমাণ?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৮: লক্ষ্মীস্বরূপিনী মা সারদা

এর কিছুকাল পরে সেই মঠায়তনে পরিব্রাজক তাম্রচূড়েরই এক মিত্র বৃহৎস্ফিঙ্‌ নামক অপর এক পরিব্রাজক তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে তার অতিথি হয়ে এসে উপস্থিত হল। পাঠকদেরকে এই বিচিত্র ‘বৃহৎস্ফিঙ্‌’ নামটাকে খেয়াল করতে বলবো। বৃহৎ শব্দের অর্থ সুপরিচিত আর ‘স্ফিঙ্‌’ মানে হল নিতম্ব বা পশ্চাৎদেশ। সোজা কথায় পিছন ভাড়ি লোক। সম্ভবত এই নাম পিতৃদত্ত নয়। আপন বৈশিষ্ট্যে যেমন কর্মক্ষেত্রে লোকের বিচিত্র বিচিত্র কৌতূক নামকরণ করা হয়ে থাকে—এইটাও সেইরকমই। সম্ভবত পঞ্চতন্ত্রকার চরিত্রটির স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য বোঝাতেই এই নামটির প্রয়োগ করেছেন। সেই বৃহৎস্ফিঙ্‌-কে দেখে তো তাম্রচূড় অত্যন্ত খুশি হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানালো আর খুব আন্তরিকতার সঙ্গে অতিথি সত্কারের নিজেকে নিয়োজিত করল। নির্জন মঠ-মন্দিরে দুটো মানুষজন অতিথি হয়ে এলে সাধুসন্তদেরও বেশ ভালোই লাগে। অধিকাংশ সময়েই তো একা একাই থাকেন তারা। তাই ক্বচিৎকদাচিৎ লোকজন এলে তারাও খুশিই হন। তাই বৃহৎস্ফিঙ্‌-কে পেয়ে তাম্রচূড় বেশ খুশিই হল এবং তাকে আপ্যায়ন করবার জন্য যথাসাধ্য প্রচেষ্টা করতে লাগলেন।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭০: সুন্দরবনের পাখি: লাল কাঁক

সারাদিনের পর সেদিন রাত্রে একটা কুশের আস্তরণে দু’জনে পাশাপাশি শুয়ে নিজেদের মধ্যে ধর্মকথা বলতে শুরু করল। বৃহৎস্ফিঙ্‌ যখন কথা বলছিল সেই সময়ে তাম্রচূড় আমাদের ইঁদুরদের ভয় দেখানোর জন্য পুরোনো অভ্যেস মতন ভাঙা সেই বাঁশের লাঠিটাকে মাটিতে মেরে মেরে মাঝে মধ্যেই বিকট শব্দ করতে লাগলো। কথাতেই বলে ফাটা বাঁশের মতন আওয়াজ; সে আওয়াজ যে কি মারাত্মক যাদের অভিজ্ঞতা আছে তারাই বলতে পারবেন। তাই নির্জন মঠের মধ্যে রাত্রিতে কেউ যখন কথা বলছে সেই সময়ে মধ্যে মধ্যে কেউ যদি ফাটা বাঁশ মাটিয়ে পিটিয়ে বিরক্তিকর শব্দ করতে থাকে তাহলে সেটা যে কি ভীষণ বিরক্তিকর হবে সেটা নিশ্চয়ই কিছুটা হলেও অনুমান করাই যাচ্ছে।

স্বাভাবিকভাবেই বৃহৎস্ফিঙ্‌-ও ভীষণ বিরক্ত হয়ে তাম্রচূড়কে বলল, ‘ভোস্তাম্রচূড়! পরিজ্ঞাতঃ ন ত্বং সম্যক্‌ সুহৃৎ।” —ওহে তাম্রচূড়! আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি যে তুমি আমাকে তেমন সহৃদয় বন্ধু মনে করো না। আমার সঙ্গে যে খুব একটা আগ্রহ দেখিয়ে কথা বলছো এমনও নয়। আমার এখনই তোমার এই শৈবমঠ পরিত্যাগ করে যাওয়া উচিত। অতিথি সত্কার সম্পর্কে পণ্ডিতেরা বলেছেন, অভ্যাগত অতিথিকে দেখেই যে লোক ‘আসুন আসুন, এইখানে এই আসনে বসুন। অনেকদিন আপনার দেখা পেলাম। খবর কি? খুব দুর্বল রোগা দেখাচ্ছে! সবকিছু কুশল-মঙ্গল তো? আপনার দেখা পেয়ে আজ যে কি ভালো লাগছে!”

এইসব কথা বলে অতিথিকে স্বচ্ছন্দ বোধ করায় সেই সব লোকের বাড়িতে অনায়াসে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যে সব বাড়িতে অতিথি এলে গৃহস্থ অভ্যাগত অতিথির দিকে না তাকিয়ে এদিকে ওদিকে বিভিন্ন দিকে তাকায় কিংবা মুখ নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে সেই সকল লোকের বাড়িতে প্রাণ থাকতেও যাওয়া উচিত নয়। সত্যি বলতে যারা সেই সমস্ত মানুষের বাড়িতে অনাহুত হয়ে যায় তার শৃঙ্গহীন বলদ ছাড়া আর কিছু নয়; তারা বাস্তবিকই “শৃঙ্গরহিতা বৃষাঃ”। যেখানে গৃহস্থ উঠে দাঁড়িয়ে আগত অতিথিকে স্বাগত জানায় না, কিংবা মধুর মধুর কথা বলে তাকে আনন্দ দেয় না বা ভালোমন্দ চর্চা করে না – তার বাড়িতে কখনই যাওয়া উচিত নয়।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩৩: বীরচন্দ্রের রাজকার্যে বাংলা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

পাঠকদের বলবো কেমন করে অতিথি সত্কার করতে হয় এই গ্রন্থের মাধ্যমে রাজপুত্রদেরও শিখিয়ে দিলেন বিষ্ণুশর্মা। ভারতবর্ষে অতিথিকে দেবতূল্য সম্মান করা হয় —তাই অতিথিকে কিভাবে সম্মান করতে হয় সে শিক্ষাটিও শিশুকালেই প্রয়োজন।

এরপর সরাসরি তাম্রচূড়কে আক্রমণ করেই পিছন ভাড়ি সেই পরিব্রাজক বৃহৎস্ফিঙ্‌ বললে, তোমার তো দেখছি একটা মঠের দ্বায়িত্ব পেয়েই গর্বে লেজ মোটা হয়ে গিয়েছে। বন্ধুদেরও ভুলেছো। বুঝতে পারছো না যে মঠকে আশ্রয় করেই আসলে তুমি নরকের পথ প্রশস্ত করছো। সাধুরা বলে—
নরকায মতিস্তে চেৎ পৌরহিত্যং সমাচার।
বর্ষং যাবৎ কিমন্যেন মঠচিন্তাং দিনত্রযম্‌।। (মিত্রসম্প্রাপ্তি, ৬৯)


অর্থাৎ যদি নরকে যেতে চাও তো তবে একবছরের জন্য কোনও যজমানের বাড়িতে পৌরহিত্যের কাজ করো। কিংবা সে সবেরও কিছু দরকার নেই —দিন তিনেক মঠ-মন্দির তৈরি করার বিষয়ে চিন্তা করো। নরকফল তোমার নিশ্চিত। এইসব করলে প্রকৃত ধর্মচর্চা থেকে মানুষ দূরে চলে যায়।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content