ছবি: প্রতীকী।
মিত্রসম্প্ৰাপ্তি
কেউ যদি ভাবে আমি গুণবান, কারও ক্ষতি করি না। নিজের কাজকর্ম নিয়েই থাকি অন্যের সাতে-পাঁচে থাকি না। তাই কেউ আমার ক্ষতি করবে না, তাহলে বলতে হয় এটা একটা ভ্রম মাত্র। যারা মূর্খ তাদের কাছে মুড়ি আর মুড়কি সমান। অর্থাৎ হীরের মতো পাথরের মূল্য যে জানে না, তার কাছে সেই হীরে আর পাঁচটা সামান্য পাথরের মতোই লাগে, আলাদা কিছু মনে হয় না। তাই যারা মূর্খতাদের কাছে সবাই সমান। গুণীজনের গুণকে তারা বোঝে না। তার পশুর মতো। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, যে ব্যাকরণের অষ্টাধ্যায়ী সূত্রের রচয়িতা পাণিনির প্রাণ হরণ করেছিল এক সিংহ। মীমাংসাসূত্রের প্রণেতা জৈমিনিমুনির প্রাণ গিয়েছিল হাতির আক্রমণে। তেমনই বৈদিক ছন্দসূত্রের রচয়িতা আচার্য পিঙ্গলে টেনে নিয়ে গিয়েছিল এক কুমীর।
পশু বলেই তারা অজ্ঞান, ভালোমন্দ বোঝে না। না হলে ভগবান পাণিনি, জৈমিনি কিংবা আচার্য পিঙ্গলের মতন গুণবান মানুষকে কি কোনও শিক্ষিত-জ্ঞানীলোক অকারণে মারতো? তাই অশিক্ষিতরা ভালোলোক মন্দলোক বোঝে না। তাই কেবল আমি গুণবান তাই রাষ্ট্রের জন্য আমি অপরিহার্য, মানুষের আমাকে প্রয়োজন এইসব ভেবে আত্মতৃপ্তি পাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। কারণ অশিক্ষিত, পশুর মতো যারা তার এই সব বোঝে না। তাই তারা অকারণেই ক্ষতি করে দেয়।
এই রকম অনেক দৃষ্টান্ত দিয়ে মুষিক হিরণ্যক বলল, ওহে লঘুপতনক! তাই তোমার মতো ব্যক্তির সঙ্গে আমি মোটেও মিত্রতা করতে ইচ্ছুক নই। দয়া করে আপনি চলে যান। বায়স লঘুপতনক তখন বলল, ভাই তুমি সঠিক বললেও সবটা ঠিক বলোনি। এবার আমার কথাগুলো একটু শোনো। দু’জন মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বটা কখন হয় জানো তো? যখন পরস্পর পরস্পরের কোনও না কোনও উপকার করে। পশুপক্ষীদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ কারণ উপস্থিত হলে। মূর্খদের মধ্যে আবার বন্ধুত্ব হয় ভয় আর লোভের কারণে, কিন্তু সজ্জনদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় কেবল দর্শন মাত্রেই। ভাই যখন তুমি কপোতরাজ চিত্রগ্রীবের উপকার করলে সেই সময়ে তোমাকে দেখা মাত্রই আমার ভালো লেগেছে। কোনও প্রয়োজনে তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে আসিনি আমি। এসেছি হৃদয়ের টানে। এটা সজ্জন ব্যক্তিদের মধ্যে বন্ধুত্বের লক্ষণ।
সজ্জনরা মানুষ বুঝে বন্ধুত্ব করে। অজানা লোকের সঙ্গে দুদিনের পরিচয়ের শুরুতেই দাদারে-ভাইরে বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। তাঁরা সম্পর্কের শুরুতে সময় দেয়, একে অন্যেকে বুঝে তারপর মেলামেশা করে। এ যেন ঠিক দিনের পূর্বাহ্ন আর অপরাহ্ণের ছায়ার মতো। সকাল বেলায় সূর্য যখন পুব আকাশে থাকে ছায়া তখন দীর্ঘ থাকে। কিন্তু বেলা যতোই এগোতেথাকে ছায়াও হালকা হতে শুরু করে। কিন্তু অপরাহ্ণে পশ্চিম আকাশে সূর্য যতো ঢলতে শুরু করে, ছায়া ততোই ঘন আর দীর্ঘ হয়। সজ্জনদের বন্ধুত্বটা অপরাহ্ণের ছায়ার মতন। মধ্যাহ্নে স্বল্প থাকলেও, যতোই সময় যায় সেটা দীর্ঘ এবং ঘন হতে থাকে— “ছাযেব মৈত্রী খলসজ্জনানাম্” । খলচরিত্রের লোকেদের বন্ধুত্ব পূর্বাহ্নের ছায়া মতো হয়, যতো সময় যায় কমতে থাকে।
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৮: চরম শত্রুর সঙ্গেও মতের মিল হলে বন্ধুত্ব হয়, আবার মতের মিল না হলেই শত্রুতা
সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস
হিরণ্যক তখন বলল— ‘ন মেঽস্তি তে শপথৈঃ প্রত্যযঃ’। আপনার শপথ বা প্রতিশ্রুতি এসব কিছুতেই আমার কোনও ভরসা নেই। রাজনীতিশাস্ত্রে বলে—
শপথৈঃ সন্ধিতস্যাপি ন বিশ্বাসং ব্রজেদ্রিপোঃ।
শ্রূযতে শপথং কৃত্বা বৃত্রঃ শক্রেণ সূদিতঃ।। (মিত্রসম্প্রাপ্তি ৪০)
প্রতিশ্রুতি বা শপথ করে সন্ধি করে নিলেও শত্রুকে কখনই বিশ্বাস করা উচিত নয়। কারণ শোনা যায়, স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রও নাকি বৃত্রাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে প্রথমে তাঁর সঙ্গে সন্ধি করেন এবং পরে সুযোগ বুঝেতাঁকেই আবার হত্যা করেন।
এই কাহিনিটির উল্লেখ মহাভারতের উদ্যোগপর্বের নবম অধ্যায়েআছে। রাজনীতি-কূটনীতির পাঠ প্রসঙ্গে এই গল্পটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এখানে সংক্ষেপে একটু জেনে রাখাটা প্রয়োজন। মহামতি শল্য জ্যেষ্ঠপাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে এই প্রাচীন কাহিনিটি বলেছিলেন। কোন প্রসঙ্গে এই কাহিনিটি এখানে বলা হয়েছিল সে বলতে গেলে সেটা অপ্রসঙ্গ হয়ে যাবে বলে সরাসরি কাহিনিটিতেই আমরা প্রবেশ করি। অতি প্রাচীন কালে ‘ত্বষ্টা’ নামে এক মহাতপা ঋষি ছিলেন। তিনি দেবতাদের সমান শ্রেষ্ঠগুণ সম্পন্নও ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন ইন্দ্রবিদ্বেষী। তাই তপোবলে তিনি ত্রিশিরা নামে এক পুত্র উত্পাদন করলেন যিনি ইন্দ্রের যথার্থ প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারবে। সেই পুত্র ছিল ইন্দ্রপদপ্রার্থী। সেই ছিল কামরূপী, অর্থাৎ নিজের ইচ্ছামতনই রূপ ধারণ করতে পারতো। সেই সঙ্গে ছিল মহাতেজস্বী চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নির মতন তার ছিল তিনখানা মুখ। এক মাথায় তো আর তিনখানা মুখ থাকতে পারে না, তাই সম্ভবত তাঁর মাথাও হয়তো তিনটে ছিল বলেই নাম হয়েছিল ত্রিশিরা।
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৫২: পুলক রাখিতে নারি (কেল)
মহাবল বৃত্র ইন্দ্রকে গিলে ফেলেছে দেখে তখন প্রধান দেবতারা সকলে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। মহাপ্রভাবশালী দেবতারা তখন মায়া করলেন। বৃত্রাসুরের জৃম্ভণ অর্থাৎ হাই উঠলো। মুখ প্রসারিত হতেই ইন্দ্র তাঁর সকল অঙ্গকে সঙ্কুচিত করে বৃত্রাসুরের মুখ থেকে বেরিয়ে এলেন। আবার শুরু হলো ভয়ানক যুদ্ধ আর সে যুদ্ধ চলতে থাকে দীর্ঘকাল। দেবতারা তখন ইন্দ্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে বৃত্রাসুরকে বধ করবার উপায় চিন্তা করতে শুরু করল।
অবশেষে ভগবান বিষ্ণুর পরামর্শে ঋষিগণ গেলেন বৃত্রাসুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মধ্যস্ততা করতে। তাঁরা বৃত্রকে বললেন, হে বৃত্র! আপনি দুর্জয়। আপন তেজে আপনি সমগ্র জগতে ব্যাপ্ত “ব্যাপ্তং জগদিদং সর্বং তেজসা তব দুর্জযঃ!” কিন্তু তবুও আপনি মহাবিক্রমশালী ইন্দ্রকে জয় করতে পারছেন না। অথচ এই যুদ্ধ দীর্ঘকাল চলতে বলে দেবগণ থেকে শুরু করে অসুর, মানুষ এমনকি জগতের সকল প্রাণীরাও অত্যন্ত পীড়িত হচ্ছে।তাই হে বৃত্র! আমাদের পরামর্শ ইন্দ্রের সঙ্গে আপনা সখ্যতা হোক “সখ্যং ভবতু তে বৃত্র! শক্রেণ সহ নিত্যদা”। তাতে আপনি সুখে থাকবেন এবং অনন্ত স্বর্গলোক লাভ করবেন।
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৩: বেলুড়মঠে শ্রীমায়ের অভিনন্দন
ঋষিগণ বললেন, ইন্দ্র সজ্জনদের মধ্যে অগ্রগণ্য একজন, মহাত্মাব্যক্তিদের তিনি অবলম্বন এবং ধর্মজ্ঞ ও সত্যবাদী একজন পুরুষ— “সত্যবাদী হ্যনিন্দ্যশ্চ ধর্মবিৎ সূক্ষ্মনিশ্চযঃ”। ইন্দ্রের সঙ্গে আপনার সন্ধি জগতের জন্য মঙ্গলকর। আপনি ইন্দ্রকে বিশ্বাস করুন। এ নিয়ে আর দ্বিধা করবেন না। আপনাদের মধ্যে একটি চিরস্থায়ী সন্ধি হোক আমরা সকলেই তাই চাই— “তেন তে সহ শক্রেণ সন্ধির্ভবতি শাশ্বতঃ”।
মহাতেজস্বী বৃত্র তখন ঋষিদের প্রণাম করে বললেন, আপনাদের কথা শিরোধার্য। কিন্তু ইন্দ্র যদি প্রতিশ্রুতি দেন যে শুকনো বা ভেজা পাথর বা কাঠ দিয়ে কিংবা কোনও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে, দিনে বা রাত্রে আমি অন্য কোনও দেবতা বা ইন্দ্রের দ্বারা বধ্য হবো না তবেই আমি তাঁর সঙ্গে সন্ধি করতে প্রস্তুত।
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
ফলে শাসক সাধু সেজে সন্ধি করার জন্য প্রতিপক্ষকে প্রতিশ্রুতি দিলেও প্রকৃত রাজনীতিতে এই সব প্রতিশ্রুতির কোনও মানে হয় না।—চলবে।