ছবি: প্রতীকী।
মিত্রসম্প্ৰাপ্তি
জগতের এইটাই নিয়ম। যখন কোনও দাবিতে গণ-অভ্যুত্থান বা রাষ্ট্র বিপ্লব শুরু হয় তখন বিক্ষুব্ধরা যতক্ষণ একসঙ্গে একাত্ম হয়ে বিদ্রোহ করেন ততক্ষণ বলবান শাসকওতাঁদেরকে ভয় পায়। কিন্তু যখনই তারা বিভিন্ন দাবি নিয়ে আলাদা হন, আলাদা আলাদা ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, তখনই সেই গণ-অভ্যুত্থান লঘু হতে শুরু করে। বিক্ষুব্ধরা যতই নিজেদের মধ্যে ভিন্নভিন্ন দাবিতে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করতে শুরু করেন শাসকের সুবিধা ততই বৃদ্ধি পায়। কোনও গণ-আন্দোলনের ক্ষেত্রে একদফা দাবি হলে শাসকের বিরুদ্ধে যে চাপ তৈরি হতে পারে, দাবি একাধিক হয়ে গেলে সেই চাপও হালকা হয়ে যায়।
এটা ভৌতবিজ্ঞানের ধর্ম। বড় নদীর গতিপথে বাঁধ দেওয়া হলে বন্যার সময়ে একমুখী জলের চাপে সে বাঁধ ভেঙে যাওয়া খুব অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেই নদীর গতিপথে বাঁধের আগেই যদি অনেক খাল থাকে, তবে তা দিয়ে সে নদীর জলস্রোত বহু জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে জলের সব চাপটা কেবল ওই বাঁধের উপর পড়ে না। ফলে বাঁধও ভাঙে না। গণ-আন্দোলনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকম। শাসক সব সময় চায় বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা যাতে বহু দাবিতে একে-অপরের থেকে আলাদা হয়ে যায়। তাহলে সরকারের উপর তীব্র চাপ সৃষ্টি হয় না, সরকার ভেঙে পড়ে না। উল্টে আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
কিন্তু কপোতরাজ চিত্রগ্রীবের নেতৃত্বে পায়রার দল একজোট থাকায় লুব্ধকের উদ্দেশ্য সিদ্ধি হলো না। জাল শুদ্ধ নিয়ে পায়রার দল উড়ে গেল তার চোখের আড়ালে। কিছুদূর তাদের দলকে অনুসরণ করে শেষে হতোদ্যম হয়ে ফিরে গেল সেই লুব্ধক।হতাশ হয়ে অদৃষ্টবাদীদের মতো সেই লুব্ধকের মনে হল, লোকে ঠিকই বলে। যা হওয়ার নয় তা কখনই ঘটবে না আর যা হওয়ার তা বিনা চেষ্টাই ঘটে যাবে।সত্যি বলতে দৈব সহায় না হলে, যা হওয়ার নয়, পরিস্থিতি অনুকূল থাকলেও তা হয় না। হাতের মুঠোর মধ্যে থাকা জিনিষও বিনষ্ট হয়ে যায়।
করতলগতমপি নশ্যতি যস্য হি ভবিতব্যতা নাস্তি।। (মিত্রভেদ ১০)
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৫: পতন আসন্ন হলেই সবার বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮০: বুধন মাহাতো কেস
এদিকে লঘুপতনক সেইদিন খাবার-দাবার সংগ্রহের কথা ভুলে ছুটল সেই পায়রার দলের পিছনে পিছনে। শিকারীর হাত থেকে বাঁচলেও কি করে সেই পায়রার দল নিজেদেরকে রক্ষা করবে তার মাথায় তখন সেই চিন্তাই ঘুড়ছে।
আকাশ পথে যেতে যেতে কপোতরাজ চিত্রগ্রীব যখন দেখলো সেই শিকারী যখন আর তাদের দলকে অনুসরণ করছে না তখন সকল সাথীদেরকে সে বলল, বন্ধুগণ! আমরা একত্রিত থাকায় সেই দূরাত্মা লুব্ধক অবশেষে হতাশ হয়ে ফিরে গিয়েছে। এখন সকলে নিশ্চিন্ত হয়ে মহিলারোপ্য নগরের উত্তরে উড়ে চলো। সেখানে আমার বন্ধু ইঁদুর-হিরণ্যক আছে। সত্যি বলতে, এই জগতে একমাত্র বন্ধুই আছে যে মানুষের বিপদে-আপদেকেবল মুখের কথাতেই সাহায্য করতে এগিয়ে চলে আসে —“বাঙ্মাত্রেণাপি সাহায্য মিত্রাদন্যো ন সন্দধে”। বন্ধু ছাড়া আর কেউ এইভাবে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে সঙ্গে সঙ্গে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না।
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— কেরালি ও নোনা হাতিশুঁড়
দশভুজা, পর্ব-৩৬: মৃণালিনী— রবি ঠাকুরের স্ত্রী-র লেখকসত্তা
যাঁরা রাজনীতি বোঝেন, তাঁরা আগামবিপদের কথা চিন্তা করেসব সময়েই ইঁদুরের মতনএইরকম শতদ্বার বিশিষ্ট দুর্গেই অবস্থান করেন। শাস্ত্রে দুর্গকে এমনই একটি সুরক্ষিত স্থান বলে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুর্গহীন রাজা সহজেই শত্রুর অধীন হয়ে যায়। অর্থশাস্ত্র মন্থন করে পঞ্চতন্ত্রকার বলেছেন, যুদ্ধের সময় হাজার হস্তিবাহিনী বা লক্ষ অশ্ববাহিনী যে কাজ সিদ্ধ করতে পারে না একটি দুর্গ সে কাজ করতে পারে। শুধু কি তাই? যুদ্ধে দুর্গের প্রাকার থেকে একজন ধনুর্ধর একশো জন সৈন্যের সঙ্গে একাই লড়তে পারে। তাই রাজনীতিজ্ঞরা সবসময়েই দুর্গের প্রশংসা করেছেন।
পায়রার দল নিয়ে কপোতরাজ চিত্রগ্রীব সেই মুষিক-হিরণ্যকের বিলদুর্গের সামনে এসে তারস্বরে ডাকাডাকি করতে লাগলো, ‘ভোঃ ভোঃ মিত্র হিরণ্যক! সত্বরমাগচ্ছ। মহতী মে ব্যসনাবস্থা বর্ততে’। — ওহে বন্ধু হিরণ্যক! শীঘ্র বেরিয়ে এসো। আমাদের সাংঘাতিক বিপদ।
দুর্গের ভিতর থেকে চেনা ব্যক্তির আওয়াজও ভিন্ন শোনায়। হিরণ্যক তাই বিলদুর্গের মধ্যে থেকেইচিত্কার করে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি কে? কি জন্য এখানে এসেছেন? কি কারণ? বিপদটাই বা কেমন? আমাকে ওখান থেকেই সবটা বলুন।
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬০: শ্রীমার রামেশ্বরম যাত্রা
কপোতরাজের নাম শুনে পুলকিত শরীরে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে নির্ভয়েচিত্রগ্রীব তখন বেরিয়ে এলো বিল দুর্গের থেকে। সত্যি বলতে, যে বন্ধুকে দেখে স্নেহে আর আনন্দে দু’চোখ জুড়িয়ে যায়, এইরকম বন্ধু ক্বচিৎ কদাচিৎ-ই মানুষের ঘরে আসে।সূর্যোদয়ে দৃশ্য, পানের স্বাদ, মহাভারতের কথা, মনের মতো স্ত্রীর এবং প্রকৃত বন্ধু প্রতিদিন নব নব রূপে প্রতিভাত হয়। প্রতিদিন সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখতে যেমন ভালো লাগে, পানের স্বাদ যেমন নেশার মতো লাগে, মহাভারতের কথার যেমন নতুন নতুন অর্থ বেরিয়ে আসে প্রকৃত বন্ধুও তেমন। মনের মতো সুগৃহিনীকে স্ত্রীর গুণকে স্বামী যেমন প্রতিদিন নতুন নতুন করে আবিষ্কার করেন, প্রকৃত বন্ধুর ভালোবাসাকেই তেমনই নতুন নতুন করে লোকে আবিষ্কার করে। প্রতিদিন মনে হয় এক নতুন মানুষকে চিনলাম—‘অপূর্বাণি দিনে দিনে’। এমনকি আধুনিক সমাজতাত্ত্বিকদের মতো প্রাচীন কালের দার্শনিকরাও বলেছেন—
চিত্তে চ তস্য সৌখ্যস্য ন কিঞ্চিৎ প্রতিমং সুখম্।। (ঐ, ১৮)
ব্যক্তির বাড়িতে নিত্যই বন্ধু সমাগম হয়, এ জগতে তার মতন সুখী আর কেউ হয় না। সুখী ব্যক্তি অনেকেই হতে পারেন কিন্তু যে ব্যক্তির কাছে সব সময় বন্ধুরা আসেন তাদের মতো সুখী আর দ্বিতীয় কেউ হন না।
বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
চিত্রগ্রীব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সবকিছু জেনে শুনেও আর কেন জিজ্ঞেস করে লজ্জা দিচ্ছো ভাই?বলা ভালো, মানুষ নিজের পূর্বজন্মে যে জায়গায়, যে কারণে, যে সময়ে, যেমন ভাবে, যা কিছু ভালো বা মন্দ কর্ম মানুষ করে ভাগ্যবশত এই জন্মে সেই জায়গায়, সেই কারণে, সেই সময়ে, সেইরকম ভাবেই, সেই কর্মের ভালো এবং মন্দ ফল সে লাভ করে। এ সব কিছুই ঘটেছে ভাই আমাদের লোভের কারণে।সেই বলে না? লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু।
এরপর সরাসরি কপোতরাজ চিত্রগ্রীব বন্ধু হিরণ্যককে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে বললো, ‘সাম্প্রতং ত্বং সত্বরং পাশবিমোক্ষ কুরু”। তোমাকে ভাই এখনই এই পাশ কেটে আমাদেরকে মুক্ত করে দিতে হবে।
হিরণ্যক সমবেদনা জানিয়ে বলল, দুর্ভাগ্য একেই বলে। যে পাখীরা আকাশ পথে যেতে যেতে শতযোজন দূর থেকে খাবার দেখতে পায় তারাই আবার সেই খাবারে লুকিয়ে থাকা ফাঁদ দেখতে পায় না।সূর্য এবং চন্দ্রের মতো স্বতঃপ্রকাশ নক্ষত্র দুটিকে রাহুর মতন সামান্য একটা গ্রহকে পীড়ন করতে দেখে কিংবা হাতির মতো বলবান প্রাণীকেও সাপের মতন বিষধর প্রাণীর হাতে আক্রান্ত হতে দেখে এবং বুদ্ধিমান লোককেও দারিদ্র ভোগ করতে দেখে আমার ইদানীং সব কিছুই ভাগ্যের খেলা বলেই মনে হয়।—চলবে।