রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

 

মিত্রভেদ

শৃগাল চতুরক তখন শঙ্কুকর্ণের কাছে গিয়ে বলল, ওহে শঙ্কুকর্ণ! স্বামী বজ্রদংষ্ট্রের অবস্থা তো খুব একটা সুবিধের বুঝছি না। এখনই কিছু একটা তাঁর অন্তত খাওয়া দরকার। না হলে খিদেয় মৃত্যু তাঁর একেবারে নিশ্চিত। আর তিনি মারা গেলে আমাদের অবস্থা আর দেখতে হবে না। উনি শিকার করেন বলেই আমরা খেয়ে পরে বেঁচে আছি। তাই স্বামী বজ্রদংষ্ট্রের যাতে ভালো হয় তাই তোমাকে কতোগুলো কথা বলতে চাই— খুব মন দিয়ে শোনো।

শঙ্কুকর্ণ শশব্যস্ত হয়ে বললে, তাড়াতাড়ি বলুন ভাই। প্রভুর ভালোর জন্য কাজ করাটা তো পুণ্যকর্ম। তাঁর ভালোর জন্য তো প্রয়োজনে আমি নির্দ্বিধায় একশোটা এমন কাজ করতে আমি প্রস্তুত।

শেয়াল-চতুরক তখন বলল, হে ভদ্র! নিজের শরীরটাকে দ্বিগুণ সুদে প্রভুর কাছে সমর্পণ করো। মনে করোস্বামীকে এখন তোমার শরীরটা ঋণরূপে দিলে এই শর্তে যে তিনি ভবিষ্যতে তোমার এই শরীরকে দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দেবেন—রাজা তো সাক্ষাৎ ভগবান। দেখো এতে তোমাদের দু’জনেরই লাভ। স্বামীও প্রাণে বাঁচবেন আর তুমিও দ্বিগুণ শরীর লাভ করবে।
আসলে উট ক্রথনক এখানে বোকা মানুষের প্রতিনিধি। অশিক্ষিত বোকা মানুষকে কেউ যদি বলে যে তুমি তোমার সন্তানকে সাগরের জলে ফেলে দাও, তাতে তোমার অখণ্ড পুণ্যলাভ করবে, সে তাই করে। আজকের বিজ্ঞানের এই জয়যাত্রার দিনেও আমরা নিত্যই সংবাদপত্রে এমন বিভিন্ন খবর দেখতে পাই যেখানে তন্ত্রে সিদ্ধিলাভ করতে কোনও শিশুকে হয়তোসেই শিশুর পিতা বা নিকট আত্মীয় বলি দিয়েছে। তাই অকাট-মূর্খ বোকা লোক চিরকাল সংসারে ছিল, আছে এবং থাকবেও। খবরের কাগজ খুলে দেখবেন প্রেমে-বাধা কিংবা বশীকরণের হাজার একটা বিজ্ঞাপন সেখানে আছে যেখানে পত্রযোগে, কিছু না হোক, পাঁচশো টাকার বিনিময়েও প্রতিকার করা হয় বলে দাবি করা হয়ে থাকে। তাই রাজাকের সাক্ষাৎ ভগবানের স্বরূপ বলে যে মানুষরা জানতেন তিনি যে অনায়াসে সুদে আসলে কারও শরীরকে দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দিতে পারেন— একথায় বিশ্বাস না করার মতন আর আছেটা কি? অধিকাংশ প্রাচীন সভ্যতাতেই সর্বোচ্চ শাসককে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বা সাক্ষাৎ ঈশ্বর বলে মনে করা হতো। মিশরের ইতিহাস ঘাঁটলেও আপনারা দেখবেন ফারাও-কে সে দেশের জনগণ জীবিত দেবতা হিসেবে গণ্য করতেন। তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠানে তাঁকে দেবতা রা-এর সন্তান বলে উল্লেখ করা হতো—দেবলোক এবং মর্ত্যলোকের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল একমাত্র ফারাও, যিনি মিশরকে শাসন করতেন। আসলে শাসকের উপর দেবত্ব বা অলৌকিকত্ব আরোপ হলে অধিকাংশ জনগণই তাঁকে বিনা প্রশ্নে মেনে নেন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৪: দুষ্টরা সুযোগ পেলেই যোগ্য ব্যক্তিকে সরিয়ে অধিকার কায়েম করে

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—গরিয়া, গোলপাতা ও হেতাল

এই উট শঙ্কুকর্ণ হল এমনই অশিক্ষিত জনগণের প্রতিনিধি। তাঁদেরকে ঈশ্বরের নামে যা বলা হয় তাই তারা নির্দ্বিধায় অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। চতুরকের প্রস্তাব শুনেসে বিন্দুমাত্র চিন্তাভাবনা না করেই বলল, হে ভদ্র! যদি তাই হয় তবে শীঘ্রই আপনি স্বামীকে গিয়ে নিবেদন করুন যে আমি তাঁর হিত সাধনে প্রস্তুত; কেবল এই দেওয়া-নেওয়ার বিষয়টার মাঝে ধর্মকে সাক্ষাৎথাকতে হবে “পরমত্র ধর্মঃ প্রতিভূঃ”—এইটুকুই মাত্র দাবি আমার।

সকলে দিনের শেষে তখন সিংহের কাছে গিয়ে উপস্থিত হল। চতুরক বলল, হে দেব! সারাদিন খুঁজেও জঙ্গলে কোনও জন্তু পেলাম না।এদিকে সূর্যও অস্তাচলে। আপনি যদি দ্বিগুণ শরীর সুদ হিসেবে ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তবে এই উষ্ট্র-শঙ্কুকর্ণ স্বেচ্ছায় নিজের শরীর আপনাকে ঋণ হিসেবে দিতে পারে; কিন্তু হ্যাঁ মাঝখানে সাক্ষাৎ ধর্মকে প্রতিভূ মানে গ্যারেন্টার হিসেবে থাকতে হবে; যাতে এই দেওয়া-নেওয়ার মাঝে, কোনও পক্ষের তরফ থেকে হয়তো কোনও অন্যায় হয় তবে তিনি যেন তার বিচার করেন।

সিংহ খুশি হয়ে বলল, বেশ তবে তাই হোক— “যদ্যেবং তত্সুন্দরতরম্‌”। এর থেকে সুন্দর প্রস্তাব আর কিছু হতেই পারে না। শঙ্কুকর্ণের প্রস্তাব মতন, ধর্মকেইতবে এই ঋণাদান সংক্রান্ত বিষয়ের মধস্থ ব্যক্তি করা হোক।

সিংহের মুখের কথাটুকু শেষ হতে যেটুকু মাত্র সময় লাগলো, নেকড়েআর শেয়াল দুজনে দু’দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে শঙ্কুকর্ণের পেটটা তখনই চিরে দু-ভাগ করে ফেললো আর তত্ক্ষণাৎতারমৃত্যু হল।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৯: বাইনাচ-গানেরও কদর ছিল ঠাকুরবাড়িতে

পাঠকদেরকে একটি বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে বলবো। শাসক, যিনি নিজেকে দেবতার প্রতিনিধি রূপে প্রচার করেন, তিনি আসলে খুব ভালোভাবেই জানেন যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে কি? অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য বলেছেন, “সংবরণমাত্রং হি ত্রয়ী লোকযাত্রাবিদ ইতি”। যাঁরামানবসম্পদ নিয়ে নাড়াঘাটা করেনঅর্থাৎ দেশ কিভাবে শাসন করতে হয়। এসব যাঁরা জানেন তিনিই লোকযাত্রাবিদ। এই লোকযাত্রাবিদদের কাছে ত্রয়ী হল একটা সংবরণ অর্থাৎ আবরণ মাত্র। ত্রয়ী বলতে সে আমলে ঋক্‌, যজুঃ ও সামবেদ ছাড়াও অথর্ববেদ থেকে শুরু করে সমস্তনির্দেশাত্মক সাহিত্যকেই বোঝাতো যেখানে মানুষের ধর্ম-অধর্ম বা কর্তব্যাকর্তব্য সংক্রান্ত আলোচনা লিপিবদ্ধ ছিল।লোকযাত্রাবিদরা দেশ শাসনের ক্ষেত্রে এইসব নির্দেশাত্মক সাহিত্যকে একটা ঢাল বা আবরণ হিসেবে ব্যবহার করতো মাত্র। ঠিক এই সিংহ বজ্রদংষ্ট্রের মতন। শঙ্কুকর্ণ উটকে হত্যা করাটা ছিল তার উদ্দেশ্য কিন্তু ধর্মভীরু উটের কথায় “ধর্ম”কে মাঝখানে টেনে আনলো সে। ইতিহাস সাক্ষী যে এই ধরণের শাসক বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা নিজস্বার্থ সিদ্ধির জন্য বারেবারে ধর্মকে মাঝে টেনে আনে আর তাতে প্রাণ যায় শঙ্কুকর্ণ উটের মতো ধর্মভীরু সাধারণ মানুষদেরই। বজ্রদংষ্ট্রের মতো লোকযাত্রাবিদরা ঠিক তাদের প্রয়োজন সিদ্ধি করে নেয় সেই ধর্মকে সামনে রেখেই।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৭: সারদা মা ও তাঁর রাধু

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৪: প্রজাদের আনন্দ, স্বস্তি, আশ্রয় রাম—তাঁর কাছে প্রজাদের আনুগত্যের স্থান কোথায়?

সেই উটের দেহ দিয়ে বেশ কয়েকদিনের ভোজন হয়ে যাবে দেখে সেই সিংহ বজ্রদংষ্ট্র তখন বেশ নিশ্চিত হয়ে চতুরককে বললে, “ভোশ্চতুরক! যাবদহং নদীং গত্বা স্নানং দেবতাঽর্চনবিধিং কৃত্বাঽঽগচ্ছামি, তাবত্ত্বযাঽত্রপ্রমত্তেন ভাব্যম্‌”। ওহে চতুরক! যতক্ষণ না আমি নদী থেকে স্নান করে পূজো-আচ্ছা শেষ করে ফিরে না আসছি ততক্ষণ তুমি এখানে সচকিত হয়ে থাকবে – যাতে এই খাবার কেউ নিয়ে যেতে না পারে।

সিংহ নদীতে স্নানে চলে গেলে চতুরক শেয়াল চিন্তা করতে শুরু করল কীভাবে একা সব উটটাকে খাওয়া যায়। সিংহ আর তার সঙ্গে নেকড়ে ক্রব্যমুখ খাওয়ার পর যেটুকু অবশিষ্ট থাকে সেটুকুই ভাগ্যে জোটে শেয়াল চতুরকের। দিনের পর দিন তাদের উচ্ছিষ্ট খেয়ে খেয়েই প্রাণ ধারণ করতে হয়তাকে; অথচ আজকে তাঁরই বুদ্ধিতে এই উটটাকে মারা হল কিন্তু খাদ্যবন্টনের সময় তাকে কোন প্রাধান্যই দিলে না সিংহ বজ্রদংষ্ট্র। ফলে চতুরকের বিপরীতবুদ্ধি হওয়াটাও অযৌক্তিক নয়। রাজা যদি নিজের সুদক্ষ-বুদ্ধিমান কর্মচারীর যোগ্যতাকে বিবেচনা করে অন্যের থেকে আলাদা করে তাকে স্বীকৃতি না দেন, তাহলে রাজার প্রতি রুষ্ট হওয়াটার যথেষ্ট কারণ আছে তার। ফলে যে পশুটাকে চতুরক নিজের বুদ্ধিপ্রভাবে হত্যা করলো তাকে কি করে কাউকে ভাগ না দিয়ে একাই ভোগ করা যায় সে কথাই চিন্তা করতে শুরু করলো সে।

নেকড়ে ক্রব্যমুখকে বলল, ভাই ক্রব্যমুখ সারাদিন ঘুরে ঘুরে তোমার মুখটা তো দেখছি একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে খুব খিদে পেয়েছে তোমার। তুমি খেতে শুরু করো। আমি মহারাজ বজ্রদংষ্ট্রের কাছে তোমাকে নির্দোষ প্রমাণ করে দেবো আর কতক্ষণই বা না খেয়ে এ ভাবে সামনে খাবার নিয়ে বসে থাকবে?

ক্রব্যমুখও সম্ভবতঃ মনে মনে এইটাই চিন্তা করছিল। অভূক্ত ব্যক্তির সামনে লোভনীয় খাবার পড়ে থাকলেও যদি সেটা সে খেতে না পারে, তাহলে তার মনের অবস্থাটা কেমন হয় নিশ্চয়ই বুঝতেই পারছেন। সেই সুযোগটাই নিলো চতুরক। ক্রব্যমুখ খেতে শুরু করলো। উটের দেহের সবচেয়ে রসালো অংশ মানে হৃদপিণ্ডটা বের করে খেতে শুরু করলো সে।
সবে সে খেতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই চতুরক তাকে বলল, ওহে ক্রব্যমুখ! স্বামী বজ্রদংষ্ট্র ফিরছেন। তুমি একটি দূরে গিয়ে দাঁড়াও, যাতে তুমি যে কিছু খেয়েছো সে বিষয়ে তাঁর কোনও সন্দেহ না হয়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৪: দুষ্টরা সুযোগ পেলেই যোগ্য ব্যক্তিকে সরিয়ে অধিকার কায়েম করে

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১২: ‘মিসা’ বন্দি সম্পাদকের চিঠি

ক্রব্যমুখ বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে তখনই উটের দেহটা ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। সিংহ বজ্রদংষ্ট্র ফিরে এসেই উটের দেহটা দেখেই হুংকার দিয়ে ভ্রুকুটি কুটিল করে বলল, “অহো কেনৈষ উষ্ট্র উচ্ছিষ্টতাং নীতঃ? যেন তমপি ব্যাপাদযামি।” কে এই উটের দেহটা উচ্ছিষ্ট করল—তাকেও আমি হত্যা করবো।

সিংহের হুংকারে ভয় পেয়ে দূরে ক্রব্যমুখ চতুরকের দিকে আকুতির দৃষ্টিতে তাকালো; মনোভাবটা এমন—এ বার তুমি কিছু তো একটা বলো, তোমার ভরসাতেই তো খাওয়াটা শুরু করেছিলাম।

চতুরক ক্রব্যমুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “ভাই ক্রব্যমুখ! তখন তো আমি হাজারবার নিষেধ করলেও আমার কথা না শুনেই তুমি এই উঠের মাংস খেতে শুরু করলে, এখন আমার দিকে তাকিয়ে কী হবে? আমি মহারাজের সামনে মিথ্যা বলতে পারবো না।এবার নিজের অশিষ্টাচারের ফল ভোগ করো।

আর ক্রব্যমুখ দাঁড়ায়? চতুরকের মুখে এইরকম কথা শুনে সিংহ যে বিচারেরও সময় নেবে না আর তার আগেই তাকে হত্যা করবে সেটা সে জানে। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করেই সে প্রাণ হাতে নিয়ে গভীর বনের মধ্যে পালিয়ে গেল।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content