মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

রাজা যথাযথভাবে প্রজাবর্গকে রক্ষা করলে যে তার ধর্মার্জনের ষড্ভাগ ফল সে লাভ করেন—ধারণাটা বহু প্রাচীন। ধর্মশাস্ত্রকারেরা এইটাকেই রাজার বৃত্তি বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থশাস্ত্রে যদিও রাজার রোজগারের অনেক পন্থাই বলেছেন। কিন্তু প্রজাদের রক্ষা করাটাই রাজার আসল দ্বায়িত্ব আর প্রজাগণ রক্ষা পেলে সেই ‘হিউম্যান রিসোর্স’ই রাজার রাজকোষ পূর্ণ করতে সক্ষম হয় এটা আমরা সকলেই জানি। সেই কারণেই মনুষ্যবতী ভূমিকে কীভাবে লাভ করা যায় এবং তাকে কীভাবে পালন করা যায়—অর্থশাস্ত্রে এইসব নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে।

মহাভারতের অনুশাসন পর্বে এক মারাত্মক কথা বলা হয়েছে। পিতামহ ভীষ্ম সেখানে যুধিষ্ঠিরকে রাজনীতির উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন, যে রাজা প্রজাকুলকে রক্ষা করে না অথচ তাদের থেকে ধনসম্পত্তি হরণের পাশাপাশি তাদের অধিকারও খর্ব করে সে রাজা আসলে রাজা নয়, সে সাক্ষাৎ কলি। প্রজাবর্গের উচিত সকলে মিলিত হয়ে এইরকম নির্ঘৃণ্য রাজাকে হত্যা করা। ভীষ্ম বলেছেন—

অহং বো রক্ষিতেত্যুক্ত্বা যো ন রক্ষতি ভূমিপঃ।
স সংহৃত্য নিহন্তব্যঃ শ্বেব সোন্মাদ আতুরঃ।। (অনুশাসনপর্ব, ৬১/৩৩)


অর্থাৎ, পাগলা কুকুরকে যেমন পিটিয়ে মারা উচিত সেইরকম ভাবে রাজাকেও পিটিয়ে মারতে হবে, যদি কোনও রাজা “আমি তোমাদের রক্ষা করবো”—এই কথা বলেও প্রজাগণকে রক্ষা না করেন। তাই প্রজাপীড়নের ফল যে কতটা মারাত্মক হতে পারে পঞ্চতন্ত্রে গরুড়ের কাছে এসে বায়সকুলের আকুল আর্তিতে সেই ভাবনাটাই প্রতিফলিত হয়েছে। প্রাচীন ভারতে রাজাকে ভগবানের অংশ রূপে কল্পনা করা হলেও সে একজন “service provider” মাত্র, আর কিছুই নন। তাই ধর্মশাস্ত্র হোক বা অর্থশাস্ত্র সব জায়গাতেই রাজাকে নিজের কাজের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবার কথা বলা হয়েছে। প্রজাবর্গকে অবহেলা করলে তার ফল যে মারাত্মক হতে পারে সে সম্পর্কে প্রাচীন শাস্ত্রকারেরা বারে বারে রাজাকে স্মরণ করিয়েছেন।
সমস্ত পাখীরা তাদের দুঃখ কষ্ট নিয়ে তাই পক্ষীরাজ গরুড়ের কাছে হাজির হয়ে বললেন, রাজাই হলেন অসহায় ব্যক্তির সহায়—তার ভরসার জায়গা; অন্ধব্যক্তির তিনিই চোখ এবং ন্যায়পথে যাঁরা জীবনযাপন করেন রাজাই হলেন তাঁদের পিতা-মাতার মতন আশ্রয়। যেমন ভাবে ফললাভে ইচ্ছুক ব্যক্তি সযত্নে গাছে সার-জল দিয়ে তার পালন-পোষণ করেন, ঠিক তেমনই ভাবে রাজারও উচিত দান-মান এবং সত্কার্য করে প্রজাকুলকে সযত্নে রক্ষা করা। কারণ প্রজাবর্গের সমৃদ্ধিতেই রাজা ও রাজ্যের সমৃদ্ধি। সামান্য ছোট একটি বীজকে সযত্নে জল দিয়ে বড় করলে সেটি এক সময়ে যেমন ফল দেয়, তেমনই ভাবে সামান্য প্রজাকেও যদি রাজা সযত্নে রক্ষা করেন। একদিন সেই প্রজাই রাজাকে সুফল প্রদান করে। তাই সোনা, রূপা, ধান্যাদি যা কিছু রাজকোষে থাকে তা সবই আসলে প্রজাবর্গের—রাজার ব্যক্তিগত কিছুই নয়।

পক্ষীকুলের মুখে তাদের এইরকম দুঃখ-দুর্দশার কথাবার্তা শুনে সমুদ্রের উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে মনে মনে স্থির করলেন, এই পক্ষীকুল ঠিক কথাই বলছে—এখনই এই দাম্ভিক সমুদ্রকে শোষণ করা দরকার।

গরুড় যখন এইসব চিন্তা করছেন ঠিক সেই সময়েই বৈকুণ্ঠ্য থেকে ভগবান বিষ্ণুর দূত এসে উপস্থিত হলেন তাঁর কাছে। সুপর্ণ গরুড়কে বললেন, হে গরুত্মন্! ভগবান নারায়ণ আমাকে আপনার কাছে পাঠালেন। তাঁকে এখনই দেবকার্যে ইন্দ্রপুরী অমরাবতীতে যেতে হবে। আপনি দ্রুত চলুন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪১: প্রতিকার না করেও রাজা যদি প্রজার দুঃখটুকুও শোনেন তাহলেও যথেষ্ট

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৬: সুন্দরবনের লৌকিক চিকিৎসায় ম্যানগ্রোভ—হরগোজা ও কেয়া

গরুড় দেখলেন এইটাই সুযোগ আর যিনি সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেন তিনিই প্রকৃত রাজনীতিবিদ। অভিমানের সুরে গরুড় বললেন, “ভো দূত! কিং মযা কুভৃত্যেন ভগবান্ করিষ্যতি?” —হে দূত! আমার মতন এইরকম এক খারাপ সেবক নিয়ে ভগবান কী করবেন? তাঁকে গিয়ে বলুন, আমার স্থানে অন্য কোনও সেবককে নিযুক্ত করতে। আর হ্যাঁ—ভগবান নারায়ণকে আমার প্রমাণ নিবেদন করতে ভুলবেন না। শাস্ত্রে বলে—
যো ন বেত্তি গুণান্ যস্য ন ত সেবেত পণ্ডিতঃ।
ন হি তস্মাৎ ফলং কিঞ্চিৎ সুকৃষ্টাদূষরাদিব।। (মিত্রভেদ ৩৮১)


মানেটা হল, যে প্রভু নিজের সেবকের গুণাবলি সম্পর্কে জানেন না, কার্যসিদ্ধির জন্য কেন সেই সেবককেই তাঁর প্রয়োজন, অন্য কাউকে নয়—সেইটাই জানেন না। নীতিজ্ঞ সেবকের উচিত সেইরকম প্রভুর সেবা না করা। যেমন বন্ধ্যাভূমিতে শত চেষ্টাতেও ফসল ফলে না, তেমনই প্রাণপাত করে সেইরকম প্রভুর সেবা করলেও সেবকের তাঁর কাছে কোনও গুরুত্ব থাকে না। তাই আমার স্থানে অন্য কাউকেই নিযুক্ত করতে বলুন ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে।

দূত বুঝলেন গরুড়ের এইরকম কথার পিছনে নিশ্চয়ই কোনও না কোনও কারণ আছে। বললেন, হে বিনতার পুত্র বৈনতেয়! আপনি ভগবানের সম্পর্কে এমন করে তো কখনও কথা বলেন না। আপনি নিঃশঙ্কচিত্তে বলুন—নিশ্চয়ই ভগবানের কোনও কর্মে আপনি অপমানিত বোধ করেছেন। আমি ভগবানকে আপনার বার্তা যথাযথভাবে নিবেদন করবো।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬০: আধুনিক ভারতীয় রাজনীতির চালচিত্রে কি দশরথ ও কৈকেয়ীর ছায়া?

গরুড় বললেন, ভগবান অনন্ত শয়নে যে সমুদ্রে শায়িত থাকেন ভগবানের আশ্রয়স্থল সে সমুদ্র অনুগত টিট্টিভের ডিমগুলি অপহরণ করে নিয়েছে। যদি সেই দাম্ভিক সমুদ্রকে তিনি দ্রুত দণ্ডিত না করেন, তবে আমিও তাঁর সেবা করবো না— এই আমার প্রতিজ্ঞা। আপনি দ্রুত ভগবানের কাছে বৈকুণ্ঠলোকে ফিরে যান এবং আমার এই নিশ্চিত প্রতিজ্ঞার কথা তাঁকে জানান।

এ একেবারে কর্মচারী ধর্মঘট। তবে আজকের দিনে ধর্মঘট শব্দটি যে অর্থে আমরা ব্যবহার করি প্রাচীনকালে এর সঙ্গে একটু হলেও তফাৎ। পুরাণগুলিতে ধর্মঘট বলে এক মহাব্রতের খবর পাই আমরা, যেটি সৌরবৈশাখে পালন করা হতো। ব্রতকর্তাকে যাতে নরকে যেতে না হয়, তাই ধর্ম-প্রতিজ্ঞা করে তাকে প্রত্যহ সুগন্ধজলে ভরা ঘট পাততে হতো। সেইটাই ধর্মঘট। ধর্ম অর্থাৎ কর্তব্য-কর্ম থেকে আমরা যেন বঞ্চিত না হই—সত্যপথ ভুলে আমরা যেন নরকের পথে গমন না করি। এইটাই ছিল ধর্মঘট ব্রতের বিষয়। আজকের দিনে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা যেটিকে সত্য মনে করেন সেইটাকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যেই কর্মবিরতি ডাকেন। আজকের ধর্মঘট শব্দের মাহাত্ম্য কিছুটা হলেও হয়তো সঙ্কুচিত হয়েছে।

যাইহোক, আমরা আবার কাহিনিতে ফিরে আসি। যথা সময়ে প্রভুর যখন তাঁর সেবককে প্রয়োজন ঠিক সেই সময়েই নীতিজ্ঞ গরুড় শ্রীভগবানের বিরুদ্ধে কর্মবিরতির ডাক দিলেন। সেবককে প্রভুর যখন প্রয়োজন হয় ঠিক সেই সময়ে ধর্মঘট বা কর্মবিরতি করলে তবেই সমস্যার আশু সমাধান হয়। না হলে সেবকের প্রয়োজনের কথা স্বামীর মনে থাকে না। মানেটা হল রাজা যখন সুস্থ আছেন তখন যদি চিকিত্সকেরা তাঁদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কর্মবিরতি ডাকেন তখন তা পাত্তা পায় না। কিন্তু রাজা যদি অসুস্থ থাকেন আর চিকিত্সকরা যদি ঠিক সেইসময়েই কর্মবিরতি ডাকেন তখন যথা সময়ে চিকিত্সা না পাওয়ার কারণেই চিকিত্সকদের কর্মবিরতিকে সহানুভূতির সঙ্গে রাজা বিবেচনা করতে বাধ্য হন। তাই রাজনীতিতে কর্মবিরতির মাধ্যমে কার্যসিদ্ধি করতে গেলে কর্মবিরতির সময়টিকেও যথাযথাভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন, না হলে সেটি ব্যর্থ হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৩: শ্রীমার বড় ভাইজিরা—নালু ও মাকু

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৬: যন্ত্রণাদগ্ধ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রাঁচিতে পেয়েছিলেন সান্ত্বনার প্রলেপ

দূতমুখে বৈনতেয় গরুড়ের প্রণয়কুপিত হওয়ার কথা শুনে ভগবান চিন্তা করতে শুরু করলেন। পাঠকদের বলবো পঞ্চতন্ত্রকারের উল্লিখিত ‘প্রণয়কুপিত’ বিশেষণটা খেয়াল করবেন। যে ক্রোধে শত্রুতার থেকে ভালোবাসার দাবি বেশি সেইটাই ‘প্রণয়কোপ’। নিজপক্ষীয় রাজার বিরুদ্ধে কর্মবিরতি করলে গেলে প্রণয়কুপিত হয়ে করাটাই পন্থা, নচেৎ সেই কোপে বিদ্বেষ যদি প্রাধান্য পেয়ে যায় তাহলে স্বপক্ষ রাজার পক্ষ হতে কিন্তু বেশি সময় লাগে না। বিদ্বেষের থেকে অনুরাগের জোরটাই সংসারে বেশি।

শ্রীভগবান দূতমুখে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে তখন চিন্তা করলেন, গরুড়ের রাগ করার পিছনে যথেষ্ট কারণ আছে। তাই স্বয়ং আমারই তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর অভিমান ভাঙিয়ে নিয়ে আসাটা উচিত। কারণ, একজন রাজা যদি নিজের কল্যাণকামী হন তবে সত্কুলজাত, সমর্থ সেবক যে তাঁর প্রতি ভক্তিভাব রাখেন তাঁকে কখনও অপমান করা উচিত নয়, বা তাঁর মানহানি হতে পারে এমন কোনও কাজকে সমর্থন করাটাও উচিত নয়। বরং সেই সেবককে পুত্রের মতন লালন-পালন করা উচিত।

কারণ একটাই, সেবকের উপর প্রসন্ন হলে রাজা তাঁকে কেবল ধন-সম্পত্তি দান করেন মাত্র। কিন্তু একজন সেবক যদি রাজার কাছে সম্মানিত হন তবে সে তাঁর নিজের প্রাণটিকেও পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে সেই রাজা বা তাঁর স্বামীর প্রত্যুপকার করার চেষ্টা করে।
এই সব চিন্তা করে ভগবান নারায়ণ স্বয়ং রুক্মপুরে যেখানে গরুড়ের বাস সেখানে এসে উপস্থিত হলেন।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content