রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

 

মিত্রভেদ

পুরুষ টিট্টিভ পাখিটি ঠোঁটে করে সমুদ্রের সব জল শুষে নেবে। শুনে টিট্টিভী বলল, ওহে সমুদ্রের সঙ্গে এই লড়াইয়ের মানেটা কি? সমুদ্রের উপর রাগ করবার কোনও কারণ দেখছি না আমি। জ্বলন্ত মাটি যেমন নিজের সারা শরীরকে উত্তপ্ত করে মাটির কোমলতা হারিয়ে কঠিন হয়ে যায় তেমনই যে সব মানুষেরা কাজের নয় তাদের রাগ করাটা সাজে না। সে রাগ তাদের নিজের বিনাশেরই কারণ হয়। পণ্ডিতেরা বলেন, নিজের ক্ষমতা বা শত্রুর শক্তিকে না জেনে বুঝে যে ব্যক্তি উত্তেজিত হয়ে শত্রুর সঙ্গে লড়তে চলে যায়, তার অবস্থা সেই পোকামাকড়র গুলোর মতোই হয়। যারা না বুঝেই জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দিয়ে নিজেদেরকে মূর্খের মতো শেষ করে ফেলে।

টিটিভীর কথা শুনে পুরুষ পাখিটি বলল, “প্রিযে মা মৈবং বদ”। হে প্রিয়ে এমন কথা বলো না। যাদের মধ্যে উত্সাহ শক্তি থাকে তারা আকারে সামান্য হলেও বড় বড় শত্রুর সঙ্গে লড়ে নিতে পারে। ক্রোধী ব্যক্তিরা নিজের থেকে ক্ষমতাশালী শত্রুর দিকে ঠিক সেভাবেই এগিয়ে যেতে পারে, ঠিক যেমন ভাবে চন্দ্রকে লক্ষ্য করে রাহু তাকে গ্রাস করতে এগিয়ে যায়। জঙ্গলের উদাহরণ দিয়েই বলা যেতে পারে, যেমন হাতি বিশাল শরীরধারী হলেও সিংহই কিন্তু পশুরাজ; আকার ও আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও সেই সিংহই কিন্তু হাতির মাথায় পা রাখতে পারে। আবার সেই হাতিকেই একজন মাহুত কেমন করে তার মাথায় বসে সামান্য একটা অঙ্কুশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে সে ব্যাপারটাও কি তুমি খেয়াল করোনি?
আরও উদাহরণ দিতে পারি। সামান্য একটা প্রদীপ জ্বলে উঠলেই সে কেমন অন্ধকারকে দূর করতে পারে সে ব্যাপরটা কি তুমি জানো না? সেই প্রদীপ কি অন্ধকারের থেকে বড়? ব্রজের আঘাতে পর্বত ভেঙে পড়ে, তাই বলে বজ্র কি পাহাড়ের থেকেও বিশাল? তাই “তেজো যস্য বিরাজতে স বলবান্ স্থূলেষু কঃ প্রত্যযঃ?”। যার মধ্যে তেজ আছে সেই বলবান, শুধু আকারে বড়সড় হলেই কিছু হয় না। তাই এই সামান্য চঞ্চু দিয়েই আমি কেমন সমুদ্রের সমস্ত জল শুকিয়ে দিই সেটা দেখো।

টিট্টিভী তখন বলল, হে কান্ত! ব্যাপারটা তুমি যতটা সোজা ভাবছো ততটা নয়, প্রত্যহ শয়ে শয়ে ছোট-ছোট নদনদী নিয়ে গঙ্গা আর সিন্ধু সমুদ্রে এসে তাকে জলে পুষ্ট করছে। তাই এই ঠোঁটে করে এই সামান্য শরীর নিয়ে এই শত-শত নদীর জল কীভাবে তুমি পান করবে? তাই এই রকম আলতু-ফালতু বোকার মতো কথা বলার প্রয়োজনটা কী?

টিট্টিভ বললে, উত্সাহ শক্তিটাই সব। নিজের আত্মবিশ্বাস হারানোটা ঠিক নয়। এই সামান্য চঞ্চু দিয়ে একবারে হয়তো সমুদ্রকে শুষ্কস্থল বানানো সম্ভব নয়, কিন্তু দিন এবং রাত্রির পরিমাণ অনেক বড়। নিষ্ঠা সহকারে সারা দিন-রাত এই সামান্য চঞ্চু দিয়েই যদি জল শুষতে থাকি তাহলে একদিন না একদিন তার জল শুকাবেই শুকাবে। যতক্ষণ না মানুষ পুরুষার্থকে অবলম্বন করে ততক্ষণ সে উচ্চপদ লাভ করতে পারে না। তাই পরাক্রমটাই হল সব। একজন নির্বল ব্যক্তিও সবলের উপর বিজয়লাভ করে যদি সে পরাক্রমী হয়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৯: বিপরীত পরিস্থিতিতে পালিয়ে যাওয়াটাও ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে টিকে থাকার উপায়

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫: কৃষ্ণ মাণিক্য সিংহাসনে বসেই উদয়পুর থেকে রাজধানী সরিয়ে আনেন আগরতলায়

অর্থশাস্ত্রে তিন রকম শক্তির কথা বলা হয়েছে—মন্ত্রশক্তি, প্রভুশক্তি আর উত্সাহশক্তি। রাজা যদি কোনও অলব্ধবস্তু বা অলব্ধভূমি লাভ করতে চান বা যে বস্তু বা ভূমিটি আগেই উনি লাভ করেছেন তাকে যদি যথাযথভাবে পালন করতে চান তবে প্রয়োজন মন্ত্রণাশক্তির, যা অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের মাধ্যমে লাভ করা যায়। রাজকোশ বা সৈন্যবলের নাম প্রভুশক্তি আর নিজের বিক্রমবলের নাম উত্সাহশক্তি। এর মধ্যে উত্সাহশক্তিই হল প্রধান। কারণ উত্সাহশক্তির অভাবে প্রভুশক্তি এবং মন্ত্রণাশক্তি দুটোই ব্যর্থ হয়ে যায়।

টিট্টিভী তখন বলল, যদি সত্যিই সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই করবে বলেই মনস্থির করে থাকো তাহলে বলবো, একা নয়, অন্যান্য সকল পক্ষীকুলকে ডেকে সকল মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে লড়াইটা শুরু করো। কারণ শাস্ত্রে বলে—
বহূনামপ্যসারাণাং সমবাযো হি দুর্জযঃ।
তৃণৈরাবেষ্ট্যতে রজ্জুর্যযা নাগোঽপি বদ্ধ্যতে।। (মিত্রভেদ, ৩৬১)


অর্থাৎ, দুর্বল বা অসহায় লোকেরা একত্র হলে তারাই অজেয় হয়ে ওঠেন। যেমন অনেক নরম তৃণ একসাথে বেঁধে তৈরি করা দড়ি দিয়ে কিন্তু হাতিকেও বেঁধে রাখা যায়। সেই গল্পটা জানো তো প্রিয়! একটা চড়াই পাখি, কাঠঠোকরা, একটি মৌমাছি আর একটি ব্যাঙ মিলে একত্রে বিরোধ করায় একটা বিরাট হাতিকে পর্যন্ত তারা মেরে দিয়েছিল? —
চটকাকাষ্ঠকূটেন মক্ষিকাদর্দুরৈস্তথা।
মহাজনবিরোধেন কুঞ্জরঃ প্রলযং গতঃ।। (ঐ, ৩৬২)
টিট্টিভ বলল, “কথমেতৎ?”

—ব্যাপারটা ঠিক কি রকম?
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪২: সুন্দরবনের বাঘের ভবিতব্য

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬২: ধনময়ী জ্ঞানময়ী-র পাশে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’

 

১৫: চড়াই আর হাতির গল্প

কোনও এক নাম না জানা বন প্রদেশে এক বিশাল তমাল গাছের মধ্যে বাসা বেঁধে এক চড়াই দম্পতি বাস করতো। কিছুদিন পরে স্ত্রী চড়াইটি কিছু ডিম প্রসব করল। একবার এক মদমত্ত হাতি সূর্যের তাপে ব্যাকুল হয়ে একটু ছায়ার সন্ধানে সেই তমাল বৃক্ষের নিচে এসে উপস্থিত হল। মদোন্মত্তত হওয়ার জন্য সেই হাতিটি সে বৃক্ষের একটি ডাল শুড় দিয়ে টেনে ভেঙে দিল যাতে সেই চড়াই দম্পতি ডিম প্রসব করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই সেই ডিমগুলো মাটিতে পড়ে সব ভেঙে গেলো আর সেই চড়াই দম্পতির শুধু আয়ু ছিল বলে প্রাণে বেঁচে গেল। ডিমগুলো সব ভেঙে যাওয়ায় সেই স্ত্রী চড়াইটি দুঃখে বিলাপ করতে লাগল। পাশেই এক কাঠঠোকরা থাকতো। সে আশেপাশেই কোথাও একটা ছিল। স্ত্রী চড়াইটির সেই আর্তবিলাপ শুনে সেই কাঠঠোকরাটি সেখানে এসে তাকে বলল, হে ভগবতি! এখন বৃথা প্রলাপ করে কি হবে? শাস্ত্রে বলে—
নষ্টং মৃতমতিক্রান্তং নানুশোচন্তি পণ্ডিতাঃ।
পণ্ডিতানাং চ মূর্খাণাং বিশেষোঽযং যতঃ স্মৃতঃ।। (ঐ, ২৬৩)


অর্থাৎ যে জিনিষ নষ্ট হয়ে গিয়েছে, যে আত্মীয়-পরিজন মারা গিয়েছে বা যে ঘটনা ঘটে গিয়েছে সেই নিয়ে বিবেকী পুরুষ কোনও শোক করেন না। জ্ঞানী আর অজ্ঞানীদের মধ্যে এই তফাৎ টুকুই শাস্ত্রকারেরা চিহ্নিত করেছেন। যে অজ্ঞানী পুরুষ শোক না করার যোগ্য বিষয় নিয়ে শোক করেন তার সে দু’রকমের দুঃখ সাগরে নিমজ্জিত হন; প্রথমতঃ বস্তুনাশ জন্য দুঃখে সে দুঃখী হয় দ্বিতীয়ত, এক দুঃখ আরেক দুঃখের জন্ম দেয়; আসলে দুঃখের বৈশিষ্ট্যই এটা। যতই দুঃখকে যাপন করা হয় দুঃখ ততই বাড়ে “স্মৃত্বা স্মৃত্বা যাতি দুঃখং নবত্বম্” —স্মরণ করতে করতে দুঃখ যেন নতুন ভাবে জন্মায়। সেই রকম মানুষদের অনর্থ ছাড়া আর কিছুই হয় না। শাস্ত্রে বলে, আত্মীয়-পরিজনের মৃত্যুতে কেউ যদি শুধুই কান্নাকাটি করতে থাকেন সেই মৃত আত্মা তার শ্লেষ্মা আর অশ্রু পান করেন মাত্র, তাই আত্মীয় পরিজনের মৃত্যুতে কান্নাকাটি না করে বরং তাঁদের সুগতির জন্য নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী শ্রাদ্ধাদি প্রেতক্রিয়া করা উচিত।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩১: আমার মতে, তোর মতো কেউ নেই

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

তাই শুনে স্ত্রী চড়াইটি বললে, “অস্ত্বেতৎ”—তুমি সঠিক কথাই বলছ। কিন্তু সেই দুষ্ট হস্তিটি মদোন্মত্ত হয়ে আমার সন্তানদের মেরে ফেলেছে। তাই তুমি যদি সত্যিই আমার মিত্র হও তাহলে সেই নীচ হাতিটিকে কি করে মারতে পারি তার জন্য কোনও একটা উপায় চিন্তা করো। তাতে আমার সন্তান নাশের দুঃখটা কিছু হলেও প্রশমিত হবে। কারণ বিপদের সময় উপকার না করে যে অপকার করে কিংবা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে হাসাহাসি —এই দুই প্রকারের লোক আসলে পূর্বজন্মের দুরাচারের জন্যেই এই জন্মে আমার ফিরে এসেছেন বলেই আমি মনে করি।

কাঠঠোকরাটি তখন বলল, হে ভগবতি! আপনি সত্যই বলেছেন। যে অন্য জাতির হয়েও বিপদের সময়ে সহায়ক হয় সেই আসলে প্রকৃত সুহৃদজন। কারণ মানুষ যখন সুখৈশ্বর্য নিয়ে পূর্ণ থাকে তখন সকলেই তার সুহৃদ হয়। শাস্ত্রকাররা বলেন—
স সুহৃদ্বসনে যঃ স্যাৎ স পুত্রো যস্তু ভক্তিমান্।
স ভৃত্যো যো বিধেযজ্ঞঃ সা ভার্যা যত্র নির্বৃতিঃ।। (ঐ ২৬৮)


অর্থাৎ বিপদের সময়ের যে মিত্র সেই আসল মিত্র, যে পুত্র ভক্তিমান সেই হল প্রকৃত পুত্র, যে আজ্ঞা পালনে কুশল সেই হল সেবক আর যিনি আনন্দ প্রদান করেন তিনি হলেন সুভার্যা। এই বিপদে তোমাদের সহায়তার জন্য আমার বুদ্ধির প্রভাবটা এবার তোমরা দেখো। বীণারব নামে আমার একটি মৌমাছি বন্ধু আছে। আমি বরং তাকে গিয়ে ডেকে আনি, যাতে সে দুরাত্মা দুষ্ট হাতিটাকে আমরা সকলে মিলে বধ করতে পারি।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content