শনিবার ১০ মে, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

 

কাকোলূকীযম্‌

উজ্জীবীর কথা শেষ হলে বায়সরাজ মেঘবর্ণ সঞ্জীবীকে ডেকে বললেন, “ভদ্র! তবাভিপ্রাযমপি শ্রোতুমিচ্ছামি”। হে ভদ্র! আপনার অভিমতও আমি শুনতে চাই।

উজ্জীবী তখন বললেন, হে দেব! আমার মনে হয় শত্রুর সঙ্গে সন্ধি করাটা উচিত হবে না। শাস্ত্রে বলে, শত্রুর সঙ্গে সন্ধি করলেও তার সঙ্গে বেশি মেলামেশা করাটা একদম উচিত নয়। আগুনে তপ্ত হয়ে জল অত্যন্ত গরম হলেও সে কিন্তু আগুনের সঙ্গে সখ্যতা করে না, অনায়াসেই সে আগুনকে নিভিয়ে দিতে পারে। জলের সঙ্গে অগ্নির যেমন সহজাত বিরোধ তেমনই অর্থাৎ সন্ধি করলেও জাত শত্রু কখনই শত্রুতা ত্যাগ করে না।

তাছাড়া এই উলূকরাজ অরিমর্দন হল একজন অত্যন্ত ক্রুর-স্বভাব, লোভী এবং অধার্মিক একজন ব্যক্তি। এইরকম লোকের তোমার সঙ্গে সন্ধি করাটা উপযুক্ত হবে না। কারণ রাজনীতিশাস্ত্রের পণ্ডিতেরা বলেন, যে পুরুষ সত্য এবং ধর্ম রহিত তার সঙ্গে কখনই সন্ধি করা উচিত নয়। কারণ এই সমস্ত লোকেরা স্বভাবত দুর্জন হয় বলেই এদের সঙ্গে ভালোভাবে সন্ধি করলেও শীঘ্রই তারা বিকারগ্রস্ত হন, অর্থাৎ সন্ধির নিয়ম তারা উলঙ্ঘন করে। তাই এদেরকে বিশ্বাস করে সন্ধি করাটা কখনই সমীচীন নয়। তাই হে রাজন্‌! আমার অভিমত এইরকম দুর্বৃত্ত শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করাটাই সঠিক সিদ্ধান্ত হবে। কারণ কথায় আছে, যে শত্রু নিষ্ঠুর, লোভী, অলস, অসত্যবাদী, ভীতু এবং চঞ্চল মনোবৃত্তিযুক্ত, যে বিবেকহীন এবং কথায় কথায় নিজের সৈন্যদের অপমান করে। এই রকম শত্রুকে সহজেই উচ্ছেদ করা সম্ভব। কারণ এদের অনুগত মানুষেরাও এর ব্যবহারের জন্য তার উপর ক্রুদ্ধ হয়ে থাকে। তাই সহজে ভেদনীতি প্রয়োগ করে এইসব শত্রুদের নিঃশেষ করে দেওয়া সম্ভব।

এছাড়া সত্যি বলতে, এই উলূকরাজ অরিমর্দন আমাদের অপমান করেছে। তাই এখন যদি তার সঙ্গে আমরা সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে কথাবার্তা শুরু করি তাহলে সে আরও ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের এই অক্ষমতার সুযোগ নেবে। কূটনীতিশাস্ত্র বলে, সাম, দান, ভেদ আর দণ্ড। এই চারটি উপায়ের মধ্যে চতুর্থ উপায় দণ্ড বা যুদ্ধের দ্বারা বশযোগ্য শত্রুকে শান্তি মানে সন্ধির প্রস্তাব দেওয়াটা মোটেও বুদ্ধিমানের কথা নয়। ঠিক যেমন যে সাধারণ জ্বর ঘাম দিয়ে আপনিই ছেড়ে যায়, কোনও বৈদ্যই, তার জন্য জল দিয়ে গা ধুইয়ে দেওয়ার বিধান দেন না। ব্যাপারটা হল সাধারণ জ্বর যা ঘাম দিয়ে আপনিই ছেড়ে যায় সেক্ষেত্রে যদি তাকে শান্ত করার জন্য গা-হাত-পা ঠাণ্ডা জল দিয়ে মোছানো হয়, তাহলে একজন ক্রুদ্ধ শত্রুর মতো সে জ্বর তখন কমে না বরং তার প্রকোপ বৃদ্ধি করে। তপ্ত ঘিয়ে জলের ফোঁটা পড়লে যেমন সেটা চিড়বিড় করে ওঠে তেমনই ক্রুদ্ধ শত্রুর কাছে এসে সন্ধির কথা বলা মানে তাকে রাগিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৭: পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যাঁর জীবনের আকাশে কখনও শত্রুতার মেঘ জমেনি

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-৪৮: রান্নার জ্বালানি নারী স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ?

আর যাঁরা বলছেন শত্রু বলবান তাই তার সঙ্গে যুদ্ধ করাটা অনুচিত, সেটাও কিন্তু আসলে যুদ্ধ না করবার সঠিক কারণ নয়। কারণ, তুলনামূলক কম শক্তি সম্পন্ন অসল সিংহও কিন্তু বলবান হাতির মাথায় তার থাবা বসাতে পারে। তাই রাজনীতিবিদ ভরদ্বাজের মত হল, উত্সাহ শক্তি থাকা একান্ত প্রয়োজন। উত্সাহ শক্তি থাকলে দুর্বল লোকেও বলবান লোককে হত্যা করতে পারে, ঠিক যেমন স্বল্পকায় হলেও সিংহ বিরাটাকার হাতিকে মারতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা যেটা সেটা হল, যে শত্রুকে বলপ্রয়োগ করে মারা যায় না, কূটনীতিশাস্ত্র বলে তাকে ছলনা এবং কপটতা প্রয়োগ করে মারতে হয়। উদাহরণ দিতে গেলে বলতে হয় ভীম যেমন স্ত্রীলোকের ছদ্মবেশে কীচককে হত্যা করেছিল সেইরকম। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত হল ছলযুদ্ধের এই উপমাটি হয়তো পঞ্চতন্ত্রকার সঠিক দেননি। ছলনার উপযুক্ত পৌরাণিক উদাহরণ হল, মগধরাজ জরাসন্ধকে বধ করার জন্য অর্জুন, ভীম এবং বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ যখন ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে তাঁকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং সেখানে মগধরাজ জরাসন্ধ যখন মহাবল ভীমের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে প্রাণ হারালেন, সেইটাই প্রকৃত ছলযুদ্ধের উদাহরণ।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৫: এ কেমন রঙ্গ জাদু, এ কেমন রঙ্গ…/৩

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১১২: প্রশাসক রামচন্দ্রের সাফল্য কী আধুনিক কর্মব্যস্ত জীবনে সফল প্রশাসকদের আলোর দিশা হতে পারে?

উজ্জীবীর মতে, রাজা তাঁর শত্রুদের প্রতি দণ্ডপ্রয়োগে যমরাজের মতো কঠোর হন, সকল শত্রু তার অধীনস্ত হন। কিন্তু শত্রুর যাবতীয় উপদ্রব সহ্য করে নিয়ে যে রাজা তার প্রতিকার না করে চুপ করে থাকে, শত্রুরাজা তাকে তৃণের মতো তুচ্ছজ্ঞান করে। যে পুরুষ তাঁর নিজের পরাক্রমে তেজস্বী পুরুষদের পরাজিত করতে পারেন না। এই পৃথিবীতে সে একজন অপাঙ্‌তেয়, নির্বীর্য ব্যক্তি ছাড়া কিছুই নন। মাতার যৌবন নষ্ট করে সে জন্ম নিয়েছে মাত্র জগতের কোনও কাজেই সে লাগে না। যে রাজ্যের সম্পদ শত্রুর রক্তকুমকুমে লিপ্ত হয়নি, সে রাষ্ট্রসম্পদ রমণীয় হলেও মনস্বীপুরুষেদের সেই সম্পদের প্রতি ভালোবাসা উত্পন্ন হয় না। অর্থাৎ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে মানুষ যা লাভ করে, মানুষ তাকেই মূল্য দেয়। অযাচিতভাবে পাওয়া জিনিষকে মানুষ মূল্য দিতে পারে না—
যা লক্ষ্মীর্নানুলিপ্তাঙ্গী বৈরিশোণিতকুঙ্কুমৈঃ।
কান্তাঽপি মনসঃ প্রীতিং ন সা ধত্তে মনস্বিনাম্‌।। (কাকোলূকীযম্‌ ৩৩)
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৭: শ্রীমার কথায় ‘ঠাকুরের দয়া পেয়েচ বলেই এখানে এসেচ’

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৫: সর্বত্র বরফ, কোত্থাও কেউ নেই, একেবারে গা ছমছম করা পরিবেশ

সর্বশেষে উজ্জীবী একজন আগ্রাসী রাজার মতো কথা বলে নিজ বক্তব্যের উপসংহার টানলেন। বললেন, যে রাজার অধীনস্ত ভূমি শত্রুসেনার রক্তে এবং শত্রুস্ত্রীদের অশ্রুতে সিক্ত হয় না, সেই রাজা এ জগতে প্রসংশা পায় না। উজ্জীবীর কথাটার মধ্যে চরমপন্থা প্রকাশ পেলেও পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে এই বক্তব্যের মাধ্যমে উজ্জীবী কিন্তু বিগ্রহমন্ত্রেরই বীজ বপন করলো। এক-এক মন্ত্রীর বক্তব্যের মাধ্যমে ভারতীয় রাজনীতি-কূটনীতির দীর্ঘ এক পরম্পরাকেই এখানে আসলে তুলে ধরতে চেয়েছেন পঞ্চতন্ত্রকার।

উজ্জীবীর বক্তব্য শেষ হলে, বায়সরাজ মেঘবর্ণ তৃতীয় মন্ত্রী অনুজীবীকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে ভদ্র! আপনিও আপনার অভিমত ব্যক্ত করুন। অনুজীবী বললেন, হে দেব! আমিও উজ্জীবীর সঙ্গে কিছুটা সহমত। সেই বলবান, দুষ্ট এবং শিষ্টাচারবিহীন শত্রুর সঙ্গে কখনই সন্ধি করা উচিত নয়, এমনকি বিগ্রহ করাও নীতিবিরুদ্ধ—“ন সন্ধির্ন বিগ্রহো যুক্তঃ”। একমাত্র ‘যান’ ছাড়া আমার মতে দ্বিতীয় কোনো পন্থা নেই। পণ্ডিতরা বলেন—
বলোত্কটেন দুষ্টেন মর্যাদারহিতেন চ।
ন সন্ধিবিগ্রহো নৈব বিনা যানং প্রশস্যতে।। (ঐ, ৩৫)
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৭: পাতি সরালি

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১৪: ঠাট্টা করলে যে বুঝতে পারত, ঠিক সময়ে হাসতে পারত

অর্থশাস্ত্র বলে, এই যান দু’রকমের হয়। এক হল শত্রুর থেকে ভয়ের কারণে যদি প্রাণ কিংবা ধন নাশের সম্ভাবনা দেখা দেয়; অর্থাৎ প্রাণ ও ধনের সংকট উপস্থিত হলে তাকে রক্ষা করা হল প্রথম প্রকার যান। দ্বিতীয় প্রকারের যানের উদাহরণ হল, যদি কোনও বিজিগীষু রাজা, যিনি শত্রুর উপর বিজয় চান, তিনি যদি তাঁর বিজয় নিশ্চিত বুঝে শত্রুকে আক্রমণ করেন। যান আসলে যুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই নয়। রাজনীতিশাস্ত্রে কার্তিক এবং চৈত্র মাস শত্রুরাজ্য আক্রমণের জন্য উপযুক্ত সময় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ বর্ষার পর যখন কৃষিক্ষেত্রে কার্তিত মাসে ব্রীহিধান পাকবে তখন শত্রুরাজ্য আক্রমণ করে ক্ষেতের ধান সবিশেষে নষ্ট করে দিতে পারলেই বিজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। কারণ সংবত্সরের খাদ্যের উত্স শেষ করে দিতে পারলেই বাকি যুদ্ধটা অনায়াসেই জেতা যায়। সেই সঙ্গে বর্ষায় পথঘাট কর্দমাক্ত থাকে বলে রথ পথ চলতে পারে না, তাই রাজারাও দিগ্বিজয় বন্ধ রাখেন। শরৎ কালে আবার সে যাত্রা শুরু করেন তাঁরা। শীতের পর চৈত্র মাসটিও বসন্তকাল। পরিবেশ অনুকূল। না থাকে তখন শীতের জড়তা আর না থাকে গ্রীষ্মের দাবদাহ। ফলে এই সময় দু’টিই শত্রুরাজ্য আক্রমণ করার জন্য উপযুক্ত। কিন্তু যদি কোনও বিজিগীষু রাজার নিজের বা শত্রুরাজার যদি কোনও বিপদের সম্ভাবনা দেখা দেয় কিংবা বিজিগীষুরাজার নিজের বা তাঁর শত্রুরাজার যদি কোনো দুর্বলতার কারণ উপস্থিত হয় তবে শাস্ত্রকাররা যেকোনও সময়কেই শত্রুরাজ্য আক্রমণ করবার উপযুক্ত সময় বলে উল্লেখ করেছেন। —চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content