শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


 

মিত্রসম্প্ৰাপ্তি

প্রকৃত অর্থেই এই সংসারে দানের থেকে বড় সঞ্চয় মানুষের দ্বিতীয়টি নেই। যথার্থ ব্যক্তিকে দান করলে দাতার জীবনে পুণ্য এবং যশ দু’টিই আসে এবং তার ক্ষয় নেই—সে অক্ষয়। ঠিক যেমন লোভের মতো শত্রু আর দ্বিতীয়টি হয় না, তেমনই সদাচরণই মানুষের একমাত্র আভূষণ সদাচারী মানুষের নিজেকে সাজাবার জন্যে অন্য কোনও বাহ্যিক অলঙ্কারের প্রয়োজন হয় না। সেই রকমই মনের সন্তুষ্টির থেকে বড় ধন আর কিছুই নেই। যিনি মানসিকভাবে সন্তুষ্ট, অন্যান্য ভোগ্যবস্তু তাঁর কাছে এহবাহ্য বিষয় মাত্র। আসলে মানুষের সুখ-দুঃখ সবটাই মনের ব্যাপার।

মন্থরক একজন অভিজ্ঞ দার্শনিকের মতো হিরণ্যককে বোঝাচ্ছিলেন, যে সম্পদ ব্যবহার হয় না, তার থাকা না-থাকা সমান। ফলে তাই নিয়ে দুঃখ করবার কোনও কারণ নেই। মন্থরকের মতে, মানুষেরমানই হল শ্রেষ্ঠ সম্পদ।যেদিন সেই মানসম্মানটুকুও মানুষের থাকে না, তখনই তাকে দরিদ্র বলতে হয়। না হলে

মন্থকর একটু থেমে বললেন, ওহে মিত্র হিরণ্যক! আপনি একজন আর্য পুরুষ—শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। আর্য পুরুষ কন্দুক বা বলের মতো স্বভাবযুক্ত হন। মাটিতে বল পড়লে সেটি যেমন আবার মুহূর্তে উপরের দিকে লাফিয়ে ওঠে, আর্য পুরুষও সেইরকম। পতন মাত্রই সে আবার উচ্চস্থানে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু অধমব্যক্তি মাটির ডেলার মতো। একবার যদি তা মাটিতে পড়ে তো ভেঙে খান খান হয়ে যায়। তাই হে ভদ্র হিরণ্যক! সেই অব্যবহৃত সম্পদ নিয়ে আর দুঃখ করবেন না—মনকে সন্তুষ্ট করুন।
মন্থরকের কথা শুনে কাক লঘুপতনকও হিরণ্যককে সস্নেহে বুঝিয়ে বললে, ওহে বন্ধু! আমাদের মিত্র মন্থকরক ঠিক কথাই বলছেন—আপনি এবার সেই সম্পদের শোক ত্যাগ করে শান্ত হোন। কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও কথাটা সঠিক। কারণ জগতে অন্যের মনমতো ভালো কথা বলবার এবং সেই কথা শোনবার লোক অনেক পাওয়া যায়, কিন্তু সত্য অথচ অপ্রিয় কথা বলবারলোক যেমন এ জগতে দুর্লভ, তেমনই সেই অপ্রিয় সত্য কথা শোনবার লোকও নেই। পণ্ডিতেরা বলেন—
অপ্রিযাণ্যপি পথ্যানি যে বদন্তি নৃণামিহ।
ত এব সুহৃদঃ প্রোক্তা অন্যে স্যুর্নামধারকাঃ।।(মিত্রসম্প্রাপ্তি ১৬৭)
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭১: ধর্মকার্যের জন্য টাকা জোগাড় করা আর সাদা কাপড়ে ময়লা লাগিয়ে ধোয়া, দুই-ই সমান

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৬: জীবন নিয়ে কৌতুক আর ‘যৌতুক’

অর্থাৎ এই সংসারে একমাত্র মিত্রই হল এমন একজন ব্যক্তি যে সর্বদা অপ্রিয় কিন্তু হিতকার কথা স্পষ্টভাবে বলে। অন্যান্যরা নামেই মাত্র বন্ধু, যারা স্পষ্টভাবে অপর বন্ধুকে সত্য কথা স্পষ্টভাবে বলে না। মন্থরক সঠিক কথাই বলেছেন। ফেলে আসা অব্যবহৃত সেইসব সম্পদ নিয়ে আর আফশোস করে কিছু লাভ নেই, ও কথা ভুলে যাওয়াই ভালো।
কচ্ছপ-মন্থরক, মূষিক-হিরণ্যক এবং কাক-লঘুপতনকেদের মধ্যে যখন এইসব নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই ব্যাধের তাড়া খেয়েকোথা থেকে চিত্রাঙ্গ নামে এক হরিণ সেই সরোবরের মধ্যে নেমে লুকিয়ে পড়ল। সেই হরিণটিকে এইভাবে হঠাৎ ছুটে আসতে দেখে লঘুপতনকও প্রাণভয়ে উড়ে গেলো এক উঁচু গাছের মাথায়। মূষিক-হিরণ্যকও পাশের এক শরঘাসের বনের মধ্যে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। মন্থরকও গিয়ে লুকোলো সেই সরোবরের মধ্যেই।

লঘুপতনক গাছের উপর থেকে সেই হরিণ চিত্রাঙ্গকে বেশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে মন্থরককে বললো, বন্ধু মন্থরক! বেরিয়ে আসুন। লুকিয়ে থাকার আর প্রয়োজন নেই। হরিণটি তৃষ্ণার্ত হয়ে এই সরোবরে ছুটে এসেছে মাত্র। ওই শব্দটা আসলে এর ছুটে আসার শব্দ মাত্র, ওকে কেউ তাড়া করেনি। আসলে কেউ নেই।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০২: অন্ধকারে কে?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১১: মৃণালিনীর মৃত্যুর পর বিবাহ-প্রস্তাবের মুখোমুখি রবীন্দ্রনাথ

মন্থরক সবটা বুঝে নিয়ে বলল, ওহে মিত্র লঘুপতনক! এই হরিণটি লম্বা-লম্বা পা ফেলে লাফিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যে ভাবে এই সরোবরে এসে লুকিয়ে পড়ল তাতে নিশ্চিত যে কোনও লুন্ধক শিকারীর তাড়া খেয়েই ও এসেছে। দৌড়াবার সময় সে কেমন মাঝে মধ্যেই পিছন ফিরে দেখছিল সেটা খেয়াল করেছিলে কি? ওকে কিন্তু দেখে আমার তৃষ্ণার্ত মনে হয়নি। ও কিন্তু ভীত। তাই আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যে আদৌ এর পিছনে কোনও শিকারী আসছে কি না। কারণ একমাত্র ভয়ে ত্রস্ত হলেই মানুষ এইরকম ঘন-ঘন লম্বা ও দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। চারিদিকে সে যেমন ভাবে চাইছে দেখে মনে হচ্ছে এর কোথাও শান্তি নেই, কোনও জায়গাই তার নিরাপদ মনে হচ্ছে না।
মন্থরকের কথা শুনে হরিণ-চিত্রাঙ্গ তাঁকে বলল, হে মন্থরক! আমার ভয় পাওয়ার কারণটি তুমি নির্ভুলভাবে অনুমান করেছো। আমি শিকারীর ছোড়া বাণ থেকে কোনোমতে বেঁচে এখানে এসে লুকিয়েছি। আমার দলের অন্যান্যদের সেই ব্যাধটি হয়তো এতক্ষণে হত্যা করে দিয়েছে। তাই আমি এখন আপনাদের শরণাগত। আমাকে এমন কোনও স্থানের সন্ধান দিন যেখানে সেই ব্যাধটি পৌঁছাতে পারবে না।
হরিণ-চিত্রাঙ্গের কথা শুনে মন্থরক বলল, আপনাকে প্রথমে রাজনীতিশাস্ত্রের একটা বচন শোনাতে চাই। পণ্ডিতেরা সেখানে বলেছেন—
দ্বাবুপাযাবিহ প্রোক্তৌ বিমুক্তৌ শত্রুদর্শনে।
হস্তযোশ্চালনাদেকো দ্বিতীযঃ পাদবেগজঃ।। (ঐ, ১৬৯)
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৭: সুন্দরবনের পাখি — ফিঙে

আকাশ এখনও মেঘলা/৪

অর্থাৎ শত্রু একেবারে সামনা-সামনি এসে উপস্থিত হলে তার হাত থেকে বাঁচবার দু’টি মাত্র উপায় আছে, হয় হাত চালাতে হবে, অর্থাৎ দক্ষতার সঙ্গেশত্রুকে লক্ষ্য করে অস্ত্র চালাতে হবে, অথবা পায়ের গতিবেগ বাড়াতে হবে। মানে তীব্র গতিতে দৌড়ে পালাতে হবে। এছাড়া শত্রুর হাত থেকে বাঁচবার দ্বিতীয় কোনও উপায় নেই। নয় লড়াই করো, নয়তো প্রাণ হাতে করে পালাও। তাই যতক্ষণ না সেই দুষ্টব্যাধটি এসে পৌঁছচ্ছে ততক্ষণে তুমিগিয়ে ঘন ওই জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে লুকিয়ে পড়ো।

লঘুপতনক বসে ছিল উঁচু গাছের উপরে। সেখান থেকে লক্ষ্য রাখছিল সেই ব্যাধটির গতিবিধি। ঠিক তখনই সেই গাছের উপর থেকে শীঘ্র উড়ে এসে সে বলল, ওহে মন্থরক! ওই দুষ্ট ব্যাধটি অনেক পরিমাণে মাংস নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে গিয়েছে। সুতরাং হে চিত্রাঙ্গ! তুমি নির্ভয়ে এখন জল থেকে উঠে এসো।

এরপর থেকে তাদের চারজনের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তারা চারজনে মনের সুখে সেই সরোবরের ধারে বাস করতে লাগলো। দুপুরের চড়া রোদে গাছের ছায়ায় বসে অনেক ভালো কথাবার্তা আলোচনা করে তারা সুখেই দিন যাপন করছিল। বলা ভালো—যে পণ্ডিত বা রসিক লোকেরা মনের মতো সুস্থ আলোচনার রসাস্বাদনের রোমাঞ্চকেই অঙ্গবস্ত্রের মতো গায়ে পরে থাকেন তাঁরা স্ত্রীসম্ভোগ ছাড়া দিব্যি সুখেই থাকেন। আসলে ভালো আড্ডার রোমাঞ্চের নেশা নারীসম্ভোগের ইচ্ছার থেকেও প্রবল। মানুষ আড্ডার নেশায় স্ত্রী-পুত্র-সংসারকে পর্যন্ত ভুলে যায়। যে ব্যক্তি আলাপ-আলোচনার সময়ে উঠে আসা মনোহর সুন্দর উক্তিগুলিকে সংগ্রহ করে না, সে পারস্পরিক বার্তালাপরূপী এই আড্ডা যজ্ঞে দক্ষিণারূপে আর কিই বা দেবে? অর্থাৎ কথাবার্তার সময়ে অন্যান্য লোকেদের তখন সে কিভাবে প্রসন্ন করবে? প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি একবার বলা কথাকে মনে রাখতে পারে না বা যে নিজেই ভালো কথা নিজের থেকে তৈরি করতে পারে না বা যিনি সুন্দর সুন্দর উক্তিকে সংগ্রহ করে কণ্ঠস্থ না করে রাখেন সেই ব্যক্তি অন্যের সঙ্গে বার্তালাপের সময়ে কীভাবে অন্যের মনোহর করবে?
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০১: অর্জুন প্রমাণ করলেন, রাজধর্ম পালনের ক্ষেত্রে মিথ্যাচারের কোনও স্থান নেই

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৪: ‘…জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়’, লরেন্স ও ফ্রিডা/২

এই ভাবেই হাসি-ঠাট্টা-আড্ডা-আলোচনায় ভালোই দিন কাটছিল তাদের। হঠাৎ-ই একদিন সেই আড্ডায় চিত্রাঙ্গ এল না। অন্যান্যরা একটু চিন্তিত হয়ে পরস্পর পরামর্শ করতে শুরু করল, আজ কেন বন্ধু চিত্রাঙ্গ এল না! কোনও সিংহের হাতে কি মারা পড়লো? না কি কোনও ব্যাধের হাতে ধরা পড়লো? না কি কোনও দাবানলের মধ্যে পড়লো? নতুন ঘাসের লোভে কোনও ভয়ানক গর্তে গিয়ে পড়লো না তো? সত্যি বলতে প্রিয় মানুষেরা যদি বাড়ির বাগানেও যায় তখনও পর্যন্ত তার প্রতি মোহের কারণেই আত্মীয়বন্ধুরা সবসময় তার অনিষ্ট আশঙ্কা করে; সেক্ষেত্রে বিভিন্ন সঙ্কটপূর্ণ গভীর এই জঙ্গলের মধ্যে যদি কোনও প্রিয়জন থাকে তবে তার সুহৃদরা তো অনিষ্ট চিন্তা করবেই।
স্বগৃহোদ্যানগতেঽপি স্নিগ্ধৈঃ পাপং বিশঙ্ক্যতে মোহাৎ।
কিমু দৃষ্টবহ্বপাযপ্রতিভযকান্তারমধ্যস্থে।।(ঐ, ১৭৩)


কূর্ম-মন্থরক কাককে ডেকে বলল, ওহে লঘুপতনক! আমি আর হিরণ্যক—দু’জনেই ধীর গতি সম্পন্ন প্রাণী। তাই তুমি আকাশ পথে উড়ে তাড়াতাড়ি জঙ্গলের মধ্যে চিত্রাঙ্গের খোঁজ করো। দেখো যদি জীবিত অবস্থায় তাকে কোথাও খুজে পাও।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content