
মিত্রসম্প্ৰাপ্তি
প্রকৃত অর্থেই এই সংসারে দানের থেকে বড় সঞ্চয় মানুষের দ্বিতীয়টি নেই। যথার্থ ব্যক্তিকে দান করলে দাতার জীবনে পুণ্য এবং যশ দু’টিই আসে এবং তার ক্ষয় নেই—সে অক্ষয়। ঠিক যেমন লোভের মতো শত্রু আর দ্বিতীয়টি হয় না, তেমনই সদাচরণই মানুষের একমাত্র আভূষণ সদাচারী মানুষের নিজেকে সাজাবার জন্যে অন্য কোনও বাহ্যিক অলঙ্কারের প্রয়োজন হয় না। সেই রকমই মনের সন্তুষ্টির থেকে বড় ধন আর কিছুই নেই। যিনি মানসিকভাবে সন্তুষ্ট, অন্যান্য ভোগ্যবস্তু তাঁর কাছে এহবাহ্য বিষয় মাত্র। আসলে মানুষের সুখ-দুঃখ সবটাই মনের ব্যাপার।
মন্থরক একজন অভিজ্ঞ দার্শনিকের মতো হিরণ্যককে বোঝাচ্ছিলেন, যে সম্পদ ব্যবহার হয় না, তার থাকা না-থাকা সমান। ফলে তাই নিয়ে দুঃখ করবার কোনও কারণ নেই। মন্থরকের মতে, মানুষেরমানই হল শ্রেষ্ঠ সম্পদ।যেদিন সেই মানসম্মানটুকুও মানুষের থাকে না, তখনই তাকে দরিদ্র বলতে হয়। না হলে
মন্থরকের কথা শুনে কাক লঘুপতনকও হিরণ্যককে সস্নেহে বুঝিয়ে বললে, ওহে বন্ধু! আমাদের মিত্র মন্থকরক ঠিক কথাই বলছেন—আপনি এবার সেই সম্পদের শোক ত্যাগ করে শান্ত হোন। কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও কথাটা সঠিক। কারণ জগতে অন্যের মনমতো ভালো কথা বলবার এবং সেই কথা শোনবার লোক অনেক পাওয়া যায়, কিন্তু সত্য অথচ অপ্রিয় কথা বলবারলোক যেমন এ জগতে দুর্লভ, তেমনই সেই অপ্রিয় সত্য কথা শোনবার লোকও নেই। পণ্ডিতেরা বলেন—
ত এব সুহৃদঃ প্রোক্তা অন্যে স্যুর্নামধারকাঃ।।(মিত্রসম্প্রাপ্তি ১৬৭)

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭১: ধর্মকার্যের জন্য টাকা জোগাড় করা আর সাদা কাপড়ে ময়লা লাগিয়ে ধোয়া, দুই-ই সমান

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৬: জীবন নিয়ে কৌতুক আর ‘যৌতুক’
কচ্ছপ-মন্থরক, মূষিক-হিরণ্যক এবং কাক-লঘুপতনকেদের মধ্যে যখন এইসব নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই ব্যাধের তাড়া খেয়েকোথা থেকে চিত্রাঙ্গ নামে এক হরিণ সেই সরোবরের মধ্যে নেমে লুকিয়ে পড়ল। সেই হরিণটিকে এইভাবে হঠাৎ ছুটে আসতে দেখে লঘুপতনকও প্রাণভয়ে উড়ে গেলো এক উঁচু গাছের মাথায়। মূষিক-হিরণ্যকও পাশের এক শরঘাসের বনের মধ্যে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল। মন্থরকও গিয়ে লুকোলো সেই সরোবরের মধ্যেই।
লঘুপতনক গাছের উপর থেকে সেই হরিণ চিত্রাঙ্গকে বেশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে মন্থরককে বললো, বন্ধু মন্থরক! বেরিয়ে আসুন। লুকিয়ে থাকার আর প্রয়োজন নেই। হরিণটি তৃষ্ণার্ত হয়ে এই সরোবরে ছুটে এসেছে মাত্র। ওই শব্দটা আসলে এর ছুটে আসার শব্দ মাত্র, ওকে কেউ তাড়া করেনি। আসলে কেউ নেই।

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০২: অন্ধকারে কে?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১১: মৃণালিনীর মৃত্যুর পর বিবাহ-প্রস্তাবের মুখোমুখি রবীন্দ্রনাথ
মন্থরকের কথা শুনে হরিণ-চিত্রাঙ্গ তাঁকে বলল, হে মন্থরক! আমার ভয় পাওয়ার কারণটি তুমি নির্ভুলভাবে অনুমান করেছো। আমি শিকারীর ছোড়া বাণ থেকে কোনোমতে বেঁচে এখানে এসে লুকিয়েছি। আমার দলের অন্যান্যদের সেই ব্যাধটি হয়তো এতক্ষণে হত্যা করে দিয়েছে। তাই আমি এখন আপনাদের শরণাগত। আমাকে এমন কোনও স্থানের সন্ধান দিন যেখানে সেই ব্যাধটি পৌঁছাতে পারবে না।
হরিণ-চিত্রাঙ্গের কথা শুনে মন্থরক বলল, আপনাকে প্রথমে রাজনীতিশাস্ত্রের একটা বচন শোনাতে চাই। পণ্ডিতেরা সেখানে বলেছেন—
হস্তযোশ্চালনাদেকো দ্বিতীযঃ পাদবেগজঃ।। (ঐ, ১৬৯)

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮৭: সুন্দরবনের পাখি — ফিঙে

আকাশ এখনও মেঘলা/৪
লঘুপতনক বসে ছিল উঁচু গাছের উপরে। সেখান থেকে লক্ষ্য রাখছিল সেই ব্যাধটির গতিবিধি। ঠিক তখনই সেই গাছের উপর থেকে শীঘ্র উড়ে এসে সে বলল, ওহে মন্থরক! ওই দুষ্ট ব্যাধটি অনেক পরিমাণে মাংস নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে গিয়েছে। সুতরাং হে চিত্রাঙ্গ! তুমি নির্ভয়ে এখন জল থেকে উঠে এসো।
এরপর থেকে তাদের চারজনের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তারা চারজনে মনের সুখে সেই সরোবরের ধারে বাস করতে লাগলো। দুপুরের চড়া রোদে গাছের ছায়ায় বসে অনেক ভালো কথাবার্তা আলোচনা করে তারা সুখেই দিন যাপন করছিল। বলা ভালো—যে পণ্ডিত বা রসিক লোকেরা মনের মতো সুস্থ আলোচনার রসাস্বাদনের রোমাঞ্চকেই অঙ্গবস্ত্রের মতো গায়ে পরে থাকেন তাঁরা স্ত্রীসম্ভোগ ছাড়া দিব্যি সুখেই থাকেন। আসলে ভালো আড্ডার রোমাঞ্চের নেশা নারীসম্ভোগের ইচ্ছার থেকেও প্রবল। মানুষ আড্ডার নেশায় স্ত্রী-পুত্র-সংসারকে পর্যন্ত ভুলে যায়। যে ব্যক্তি আলাপ-আলোচনার সময়ে উঠে আসা মনোহর সুন্দর উক্তিগুলিকে সংগ্রহ করে না, সে পারস্পরিক বার্তালাপরূপী এই আড্ডা যজ্ঞে দক্ষিণারূপে আর কিই বা দেবে? অর্থাৎ কথাবার্তার সময়ে অন্যান্য লোকেদের তখন সে কিভাবে প্রসন্ন করবে? প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি একবার বলা কথাকে মনে রাখতে পারে না বা যে নিজেই ভালো কথা নিজের থেকে তৈরি করতে পারে না বা যিনি সুন্দর সুন্দর উক্তিকে সংগ্রহ করে কণ্ঠস্থ না করে রাখেন সেই ব্যক্তি অন্যের সঙ্গে বার্তালাপের সময়ে কীভাবে অন্যের মনোহর করবে?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০১: অর্জুন প্রমাণ করলেন, রাজধর্ম পালনের ক্ষেত্রে মিথ্যাচারের কোনও স্থান নেই

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৪: ‘…জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়’, লরেন্স ও ফ্রিডা/২
কিমু দৃষ্টবহ্বপাযপ্রতিভযকান্তারমধ্যস্থে।।(ঐ, ১৭৩)
কূর্ম-মন্থরক কাককে ডেকে বলল, ওহে লঘুপতনক! আমি আর হিরণ্যক—দু’জনেই ধীর গতি সম্পন্ন প্রাণী। তাই তুমি আকাশ পথে উড়ে তাড়াতাড়ি জঙ্গলের মধ্যে চিত্রাঙ্গের খোঁজ করো। দেখো যদি জীবিত অবস্থায় তাকে কোথাও খুজে পাও।—চলবে।