বুধবার ২৬ মার্চ, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

মিত্রসম্প্ৰাপ্তি

উন্নতিকামী যে কোনও পুরুষের মধ্যে উত্সাহ গুণ থাকাটা সর্বদা আবশ্যক। যেক্ষেত্রে আলস্য ত্যাগ করে উত্সাহের সঙ্গে কোনও কার্য করা হয় এবং ন্যায়নীতির সঙ্গে মানুষের পৌরুষও যেখানে মিলে থাকে, লক্ষ্মীশ্রী সেখানেই অচঞ্চল হয়ে অবস্থান করে। ব্যবসায় উন্নতি করতে গেলে যেকোনও ব্যবসায়ীর মানসিকতাটা ঠিক এইরকমই হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। সব কিছুই হল ভাগ্যের খেলা। এইসব ভেবে মানুষের কখনই নিজের উদ্যোগ ত্যাগ করা উচিত নয়। তিল থেকেও উদ্যোগ ছাড়া তেল বেরোয় না, তার জন্যেও পরিশ্রম করতে হয়। সুতরাং পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। উত্সাহের সঙ্গে ধৈর্য ধরে কোনও জিনিষ নিয়ে লেগে থাকে সিদ্ধি আসবেই। কিন্তু মন্দবুদ্ধি যে ব্যক্তি সামান্যতেই সন্তুষ্ট হয়ে যায়, সেইরকম ভাগ্যহীন পুরুষের কাছে সম্পদ এলেও তা বিনষ্ট হয়ে যায়।

শৃগালী বলল, আর তুমি যে সন্দেহটা করছ, ঐ মাংসখণ্ড দুটো আদৌ পড়বে কি পড়বে না? এ নিয়ে পণ্ডিতেরা কি বলে জানো? তাঁরা বলেন, সমাজে মানুষ কোনো বড় পদ লাভ করলেও কিন্তু প্রশংসিত হয় না; সে প্রশংসিত হয় যদি সে দৃঢ় চরিত্র হয়। নিজ কর্তব্যে যে দৃঢ় ও নিশ্চিত থাকে সেই উন্নতি করে। দৃষ্টান্ত দিতে গেলে বলতে হয়, চাতকপাখিকেই দেখো। তার তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে বৃষ্টির জল পড়বেই এই বিশ্বাস তার এতোটাই দৃঢ় যে স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রও পর্যন্ত বাধ্য হন জলধারা বর্ষণ করতে।

আসলে শৃগাল-পত্নীর মাথাটা গরম হয়েছিল তখন থেকেই যখন তার পতি তাকে মূষিকের মাংস খেতে বলেছিল। আমাদেরও এমন হয় অনেক সময়েই; হয়তো কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার আগে দেখে এলাম যে বাড়িতে সুস্বাদু শূল্যপক্ব মাংস সহোযোগে পরমান্ন তৈরির আয়োজন চলছে। মনের মধ্যে আশা জাগলো যে বাড়ি ফিরে হয়তো জুটবে। কিন্তু বাড়ি ফিরে যদি রুটি আর কুমড়োর ছক্কা জোটে তাহলে কি মাথা ঠিক থাকে? শৃগালনীর ব্যাপারটাও হয়েছিল ঠিক সেইরকমই। সেই বৃষ’র অণ্ডকোষ দু’টিকে দেখে শরীর থেকে ঝুলন্ত চর্বির খণ্ড ভেবে তার স্বাদটা কেমন হতে পারে কল্পনা করেছিল সে। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে কেউ যদি তাকে তখন গন্ধময় মূষিক ধরে খেতে বলে তাহলে তার মাথাটা গরম হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৯: টাকা-পয়সা থাকলে চোর-ডাকাতকেও লোকে সম্মান দেখায়

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৫: রবীন্দ্রনাথ ভয় পেতেন মহর্ষিদেবকে

পতির উপর একটানা বাক্যবাণ বর্ষণ করে শৃগালনী এবার কিছুক্ষণ থেকে বলল, আর আবার যদি মূষিকের মাংস খাওয়ার কথা বলো তাহলে স্পষ্ট কথায় বলে রাখি ওই সব খেতে কোনো দিনই আমার ভালো লাগে না। ওতে আমার কোনও রুচি নেই। বৃষের শরীরের ওই মাংসখণ্ড দুটো ঝুলছে, যেকোনও সময়েই ওটা খসে মাটিতে পড়বে। তাই তোমাকে এর জন্য বিন্দুমাত্রও কোনও চেষ্টা করতে হবে না।

অগত্যা সেই শেয়াল-দম্পতি তখন ওই ইঁদুর ধরার জায়গাটা ছেড়ে সেই মাংসখণ্ড দু’টোর লোভে ষাঁড় তীক্ষ্ণবিষাণের পিছন পিছন ঘুড়তে শুরু করল। পণ্ডিতরা ঠিকই বলেন—
তাবৎ স্যাৎ সর্বকৃত্যেষু পুরুষোঽত্র স্বযং প্রভুঃ।
স্ত্রীবাক্যাঙ্কুশবিক্ষুণ্ণো যাবন্নোদ্ধ্রিযতে বলাৎ।। (মিত্রসম্প্রাপ্তি, ১৪৮)
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৮: মা সারদার ‘পরকে আপন করা’

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৭: ভাগ নুনিয়া, ভাগ

এই সংসারে পুরুষ ততক্ষণই স্বাধীন যতক্ষণ স্ত্রীর বাক্যবাণে নিয়ন্ত্রিত হয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোড় করে তাকে কিছু করতে না হয়। স্ত্রী বাক্যে প্রেরিত হয়ে মানুষ যেমন অনেক অনুচিত কাজও করে, ঠিক তেমন ভাবে অনেক কঠিন কাজও সহজে করে পারে; আবার অখাদ্য জিনিষও খায়। ঠিক যেমন এখানে বৃষের অণ্ডকোষ দু’টি খাওয়ার জন্য স্ত্রীর কথায় শেয়াল-দম্পতী তার পিছন পিছন ঘুরতে লাগল। এ নজির যদিও সর্বত্রই আছে। পাঠকদের স্মরণ করতে বলবো খ্রিস্টানদের পবিত্রগ্রন্থ বাইবেলের জেনেসিস অংশের আদম ও ইভের গল্পটি। শয়তানের প্ররোচনায় প্রথম মানবী ইভ প্রথমে নিষিদ্ধ ফলটি খেয়ে আদম্‌-কে তার স্বাদ নিতে প্ররোচিত করে খাওয়ার জন্য, যে ফল খেতে ঈশ্বর তাদের নিষেধ করেছিল।
সেই শেয়াল-দম্পতি তখন থেকে তীক্ষ্ণবিষাণ ষাঁড়ের পিছন পিছন ঘুরতে শুরু করল। এইভাবে অনেকদিন কেটে গেলো, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই সেই মাংসখণ্ডদুটো তার শরীর থেকে খসে পড়লো না। এইভাবে বছর পনেরো কেটে যাওয়ার পর সেই শেয়াল একদিন তার স্ত্রীকে ওই কথাগুলো বলেছিল যে এই মাংসখণ্ডদুটো পড়বে কি পড়বে না এই ভাবতে ভাবতে পনেরো বছর কেটে গেলো, কিন্তু তার পরেও এগুলো পড়লো না। তাই নিজের আগের জায়গাতেই ফিরে যাওয়া ভালো।

৬ষ্ঠ কাহিনি সমাপ্ত

আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৬: রাজনৈতিক পরিসরে অখ্যাতি ও সন্দেহর আবিলতা থেকে কি মুক্তি সম্ভব?

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮১: সুন্দরবনের পাখি—বেনে বউ

কাহিনি শেষ করে সোমিলক বলল, এইজন্যেই আমি বলেছিলাম ‘ওটা শিথিল হয়ে খসে পড়বে কি পড়বে না এইভাবেই পনেরো বছর কেটে গেল’। সেই দিব্যপুরুষটি তখন বলল, তাই যদি হয় তাহলে আবার সেই বর্ধমানপুরেই ফিরে যাও। সেখানে দুই বণিকপুত্র বাস করে —একজনের নাম গুপ্তধন এবং দ্বিতীয়জনের নাম হল উপভূক্তধন। তুমি সেখানে গিয়ে তাদের আচার-আচরণ বুঝে তাদের একজন হওয়ার মতো বর চেয়ে নাও। পাঠকদের বলবো বণিকের নাম দুটিকে খেয়াল করতে। নাম দুটির মাধ্যমে দুইজন বণিকের দুটো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে। একজন গুপ্তধন অর্থাৎ যিনি সম্পদ রক্ষা করেন এবং অপরজন হলেন উপভূক্তধন অর্থাৎ যিনি সম্পদ ভোগ করে ব্যয় করে দিয়েছেন। যদি উপভোগ ব্যতিত ধনের তোমার প্রয়োজন সিদ্ধ হয় তাহলে তোমাকে আমি গুপ্তধন করে দেবো। অথবা দান এবং ভোগ করে যদি তোমার প্রয়োজন সিদ্ধ হয় তবে তোমাকে আমি উপভূক্ত ধন করে দেবো। এই কথা বলে সেই দিব্যপুরুষ অন্তর্হিত হয়ে গেলেন।
আরও পড়ুন:

শ্যাম বেনেগল সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১২: দর্দরজাতক

সোমিলকও খুবই আশ্চর্য হয়ে সেই দিব্য পুরুষের কথা অনুসারে আবার বর্ধমানপুরের দিকে যেতে শুরু করল। সন্ধ্যার সময়ে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে সেই নগরে পৌঁছে একে-ওকে জিজ্ঞেস করতে করতে গুপ্তধনের বাড়ি যখন সে খুঁজে পেলো তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। অন্ধকারের মধ্যে সোমিলক গুপ্তধনের বাড়ি প্রবেশ করল।

গুপ্তধনের স্ত্রী এবং পুত্র সেই সোমিলককে নানা ভাবে তাঁদের গৃহে প্রবেশ করতে নিষেধ করলেও কারো কথা না শুনেই সেই সোমিলক প্রায় জোর করেই তাঁদের বাড়ির মধ্যে ঢুকে বসে পড়ল। রাত্রে খাবারের সময়েও নিতান্তই অনাদরের সঙ্গে সেই সোমিলককেও গুপ্তধনের স্ত্রী কিছু খাবার দিলেন। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সোমিলক সেখানে যখন রাত্রে ঘুমালো তখন স্বপ্নে দেখলো সেই দুই পুরুষ তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। তাদের মধ্যে প্রথমজন বলল, হে কর্তা! সোমিলককে ভোজন দেওয়ার জন্য তুমি আজ গুপ্তধনের প্রতিদিনের খরচের অতিরিক্ত অর্থের খরচ কেন করিয়ে দিলে? তখন দ্বিতীয়জন বললেন, হে কর্ম! এতে আমার কোনও দোষ নেই। আমি তো মানুষকে লাভ করাই। এইটাই আমার কর্ম। কিন্তু তার পরিণাম কি হবে সেটা তো তোমার বশে।

এরপর পরদিন সকালে যখন সোমিলকের ঘুম ভাঙল তখন দেখলো যে গুপ্তধনের বিষূচিকা অর্থাৎ কলেরা হয়েছে এবং সে দুঃখিত হয়ে পড়ে আছে। পরেরদিন সেই কলেরা রোগের কারণে তাকে উপবাসও করতে হল। ফলে সোমিলকের জন্য আর অতিরিক্ত ভোজনের দরকার হলো না; গুপ্তধনকে উপবাস করতে হয়েছিল বলে গুপ্তধনের জন্য নির্দিষ্ট খাবারটি সোমিলকের ভাগ্যে জুটলো। এরপর সকাল সকালই পরদিন সে সোমিলক গুপ্তধনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে উপভূক্তধনের বাড়িতে এসে উপস্থিত হল।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content