শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

 

মিত্রভেদ

সেই শ্রেষ্ঠীর পুত্র তখন স্নানের উপকরণ নিয়ে প্রসন্ন মনে নির্ভয়ে সেই বণিক জীর্ণধনের সঙ্গে চলে গেল। লৌহনির্মিত তুলাযন্ত্রটি যে ইঁদুরে খেতে পারে না এটা সে জীর্ণধন বেশ ভালো করেই জানতো। স্নান সেরে সেই শ্রেষ্ঠীর শিশু পুত্রটিকে সে নদীতীরের কাছেই পর্বতের একটি গুহার মধ্যে লুকিয়ে তার প্রবেশ পথটি একটি বড় পাথর দিয়ে ঢেকে রাখল, যাতে শত চেষ্টাতেও সেই শিশুটি সেই পাথরটি সরিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে না আসতে পারে। তাড়াতাড়ি সেই শ্রেষ্ঠীর বাড়িতে ফিরে এল সে হাঁপাতে হাঁপাতে। সেই শ্রেষ্ঠী তখন তাঁর পুত্রটিকে জীর্ণধনের সঙ্গে না দেখে অত্যন্ত বিচলিত হয়েজিজ্ঞাসা করল, হে অভ্যাগত অতিথি! আমার শিশুটি কোথায়, যে তোমার স্নানের উপকরণ নিয়ে তোমার সঙ্গে গিয়েছিল?

জীর্ণধন তখন অম্লানবদনে বলল, সে যখন নদী তীরে আমার জন্য প্রতীক্ষা করছিল তখন কোথা থেকে এক বিরাট বাজপাখি এসে তাকে অপরণ করে নিয়ে আকাশে উড়ে গিয়েছে— “নদীতটাৎ স শ্যেনেন হৃতঃ”।

শ্রেষ্ঠী রেগে গিয়ে বলল, ওরে মিথ্যাবাদী! বাজপাখি কখনও এত বড় বাচ্চাকে অপহরণ করে আকাশে উড়তে পারে? আমাকে কি বোকা পেয়েছিস? যা বলবি তাই বিশ্বাস করবো? এখনই আমার বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে দে না হলে রাজদরবারে যাব আমি তোর বিরুদ্ধে নালিশ করতে।

বণিক জীর্ণধন তখনঅত্যন্ত ধীর কণ্ঠে বলল, ওরে সত্যবাদী! বাজপাখি যদি শিশুকে তুলে না নিয়ে যেতে পারে তবে সহস্রপণ ওজনের লোহার তুলাযন্ত্রটিকেও ইঁদুরে খেতে পারে না। তাই ভালোয় ভালোয় আমার তুলাযন্ত্রটি আমাকে ফিরিয়ে দাও যদি নিজের ছেলেকে ফিরে পেতে চাও ‘তদর্পয মে তুলাম্‌, যদি দারকেণ প্রয়োজনম্‌”।

এ ভাবে দুজনে কথা কাটাকাটি করতে করতে রাজদরবারে এসে উপস্থিত হল। দুষ্ট-শ্রেষ্ঠীটি সেখানে গিয়ে তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করল—“ভোঃ! অব্রহ্মণ্যমব্রহ্মণ্যম্‌। মম শিশুরনেন চৌরেণাপহৃতঃ”। মহা অনর্থ হয়ে গিয়েছে। এই চোরটি আমার পুত্রকে অপহরণ করেছে।
ধর্মাধিকারীরা তখন সেই বণিক জীর্ণধনকে ধমক দিয়ে বলল, এখনই সেই শ্রেষ্ঠীপুত্রটিকে তার পিতার কাছে ফিরিয়ে দাও।

জীর্ণধন আগের মতোই অচঞ্চল ভঙ্গীতে বলল, আমি আর কি করতে পারি বলুন? আমার চোখের সামনেই কোথা থেকে একটা বিরাট বাজপাখী উড়ে এসে ছেলেটাকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গেল। আমার জন্য ছেলেটি তখন স্নানের উপকরণ নিয়ে নদীতীরে দাঁড়িয়ে ছিল।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫১: অকারণে প্রাপ্ত সম্মান খুব একটা সুখের হয় না

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৩: দুই মহর্ষির দ্বন্দ্বে কি ‘ইতি ও নেতি’র বিরোধেরই প্রতিফলন?

এই শুনে ধর্মাধিকারে নিযুক্ত লোকেরা বললে— “ভোঃ! ন সত্যমভিহিতং ভবতা”। ওহে তুমি সত্য বলছো না। একটা বাজপাখি কি এত বড় একটা মানুষের বাচ্চা তুলে নিয়ে যেতে পারে নাকি?
জীর্ণধন তখন বলল, আমার কথাটা একবার বোঝার চেষ্টা করুন ধর্মাবতার—
তুলাং লোহসহস্রস্য যত্র খাদন্তি মূষিকাঃ।
রাজংস্তত্র হরেচ্ছ্যেনো বালকং নাত্র সংশযঃ।। (মিত্রভেদ, ৪৪৭)


অর্থাৎ হে রাজন্‌! হাজার-পল ওজনের লোহার তুলাযন্ত্র যদি ইঁদুরে খেতে পারেতবে বাজপাখি যে মানুষের বাচ্ছাকেও অপহরণ করে নিতে পারে। এতে এতো সন্দেহ করবার কী আছে?
ধর্মাধিকারীরা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল— “কথমেতৎ”। ব্যাপারটা ঠিক কেমন?

বণিক জীর্ণধন তখন সকল সভাসদদের সামনে সমস্ত বৃত্তান্ত খুলে বলল। সভাসদের সকলে হেসে উঠলো বণিকের বুদ্ধি দেখে। তারা দুজনকে ডেকে তখন সমস্যার মীমাংসা করে দিল। লৌহ তুলাযন্ত্রটি ফেরত দিতেই সে জীর্ণধনসেই শ্রেষ্ঠী শিশুপুত্রটিকে গুহা থেকে বের করে এনে শ্রেষ্ঠীকে সমর্পণ করল এবং বিবাদের অবসান হল। পূর্বপুরুষের উপার্জিত তুলা হাতছাড়া হল না।
 

২১ কাহিনি সমাপ্ত

আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৬: নান্দনিক শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন শ্রীমা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৯: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—কালি লতা ও পান লতা

গল্প শেষ করে করটক বলল,এইজন্যেই আমি বলছিলাম, তুলাযন্ত্র ইঁদুরে খেয়ে নেওয়ার কথা। তাই ওরে মূর্খ! সঞ্জীবকের প্রতি রাজা পিঙ্গলকের ভালোবাসা তোমার সহ্য হলো না বলেই এই সব জঘন্য কাজ তুমি করে বসলে। লোকে ঠিকই বলে, এই সংসারে প্রায়ই দেখা যায় যে নীচবংশে জাত লোকেরা উচ্চবংশে জাত সজ্জন মানুষদের নিন্দা করে, তোমার মতন ভাগ্যহীনরা নিন্দা করে ভাগ্যবানদের; কৃপণরা দানবীর মানুষের নামে কুত্সা ছড়ায়; কুটিল স্বভাবের লোকজন সাদাসিধে সচ্চরিত্র মানুষের নামে অকথা-কুকথা বলে বেড়ায়; দরিদ্র নিন্দা করে ধনীব্যক্তির; কুরূপ ব্যক্তি সুরূপের কিংবা পাপী লোক নিন্দা করে পুণ্যাত্মাকে আর তোমার মতো মূর্খেরা সঞ্জীবকের মতো সর্বশাস্ত্রে কুশল ও বিদ্বানের নিন্দা করে অকপটে। এইটাই এখন জগতে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। অযোগ্য লোকেরা অনায়াসে যোগ্যদের নিন্দা করে বেড়ায়, তাদের নামে মিথ্যা অপবাদ রটায়। পণ্ডিতেরাও ঠিকই বলেন—
মূর্খাণাং পণ্ডিতা দ্বেষ্যা নির্ধনানাং মহাধনাঃ।
ব্রতিনঃ পাপশীলানামসতীনাং কুলস্ত্রিয়ঃ।। (ঐ, ৪৪৯)


মূর্খজনেরা পণ্ডিতের, দরিদ্রে লোকের ধনীর, পাপী ব্যক্তি পুণ্যাত্মার এবং কুলটা স্ত্রীরা সতীলক্ষ্মী কুলস্ত্রীদের বিদ্বেষ করে। রাজা পিঙ্গলক যে সর্বশাস্ত্রবিশারদ বৃষ সঞ্জীবককে স্নেহ করছেন, তার মন্ত্রণা নিচ্ছেন—এই সব তোমার মতো মূর্খের সহ্য হল না। তাই বৃষ সঞ্জীবকের ক্ষতি করতে গিয়ে আমাদের স্বামী পিঙ্গলককেও তুমি বিপদে ফেলেছো। সেই বলে না?
পণ্ডিতোঽপি বরং শত্রুর্ন মূর্খো হিতকারকঃ।
বানরেণ হতো রাজা বিপ্রাশ্চৌরেণ রক্ষিতাঃ।। (ঐ, ৪৫০)


হিতকারী অথচ মূর্খ বন্ধুর থেকে বরং একজন পণ্ডিতমানুষ শত্রু হওয়াও ভালো। ঠিক যেমন মূর্খ বানর রাজাকে হত্যা করেছিল আর পণ্ডিত চোর ব্রাহ্মণদের রক্ষা করেছিল।
দমনক বলল— “কথমেতৎ”। এই আবার কিরকম?
করটক বলতে শুতু করল।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৩: কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৫: বার্নার্ড শ ও শার্লটি—যদি প্রেম দিলে না প্রাণে/১

 

২১: রাজসেবক বানরের কাহিনি

কোনও একদেশের রাজার এক অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং ভক্তিমান বানর ভৃত্য ছিল। রাজা তাকে সর্বদা সঙ্গে সঙ্গে রাখতেন রাজার গা-হাত পা টিপে দিত। রাজা ঘুমাতে তাকে হাওয়া করে দিত। সেবা যত্নে তার কোনও ত্রুটি ছিল না। রাজন্তঃপুরে তার ছিল অবাধিত যাতায়াত। যখন মন চাইতো তখনই সে রাজার কাছে চলে আসতে পারতো। পাঠকদের খেয়াল করতে বলব, এখানে পঞ্চতন্ত্রকার ভৃত্যটিকে একটি বানর হিসেবে নির্মাণ করায় সে যে স্বভাবে বুদ্ধিহীন এবং অবলীলায় না ভেবে চিন্তেই ধ্বংসলীলা চালাতে পারে, সেটা খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলেন।

একদিন রাজা আহার সেরেদ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা দিচ্ছেন। কোথা থেকে একটা মাছি উড়ে এসে রাজার বুকের উপর বসলো। পাখা জোড়ে হাওয়া দিয়ে বানরটি তাকে বহুবার তাড়াবার চেষ্টা করলেও সেটা কিছুতেই যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে এদিক-সেদিক ঘুরে আবার সেটা গিয়ে রাজার বুকে বসছে। বিরক্ত হয়ে সে মূর্খ বানরটি তখন তার স্বভাব চাপল্যে পাশে পড়ে থাকা একটি খড়্গ নিয়ে এলো। যেই সেই মাছিটি আবার রাজার বুকের উপর গিয়ে উড়ে বসল তখনই সেই খড়্গ নিয়ে তাকে মারতে গিয়ে রাজার বক্ষস্থলটি সে দুখণ্ড করে দিল। মাছিটি উড়ে গেলো কিন্তু রাজার মৃত্যু হল। তাই যে রাজা দীর্ঘ আয়ু কামনা করেন তাঁর তোমার মতন মূর্খ ভৃত্য না রাখাই উচিত।
 

২১ কাহিনি সমাপ্ত

করটক বলল, তোমার মূর্খতা ওই বানরভৃত্যেরই সমান। সঞ্জীবকের প্রতি তোমার নিজের আক্রোশটা মেটাবার জন্য আজ তুমি স্বামী পিঙ্গলককে এমন বিপদের মধ্যে ফেলেছো যে তার এখন প্রাণ হানির সম্ভাবনা পর্যন্ত তৈরি হয়েছে।
আর অপর দিকে।

আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৫৮: কালীর হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে মহানায়ক বলেছিলেন, ‘কাউকে বলো না’

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

 

২২: চোর-ব্রাহ্মণের কাহিনি

কোনও এক নগরে এক বিদ্বান্‌ ব্রাহ্মণ ছিল। কিন্তু পূর্বজন্মের পাপে বা স্বভাব দোষে সে ছিল এক মহাচোর। একবার সেখানে দূর দেশ থেকে চারজন ব্রাহ্মণ-বণিকএসেছিল বহু পণ্য নিয়ে। সেই নগরে সেসব পণ্য বিক্রি করে তারা অনেক টাকাপয়সা রোজগার করেছিল। সেই চার ব্রাহ্মণ-বণিকের এতো সম্পদ দেখে সেই চোর-ব্রাহ্মণটির বড়ো লোভ হল। সারাদিন তার মাথার মধ্যে খালি চিন্তা ঘুরতে লাগলো যে কিকরে ওদের সেই ধনরত্নগুলো চুরি করা যায়—“অহো! কেনোপাযেনৈষাং ধনং লভে?” শেষে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সে ঠিক করলো তাদের কাছে চাকরি নেবে। একে সে ব্রাহ্মণ আর তার উপর পড়াশুনা করা। কথায়-বার্তায় সে ছিল অত্যন্ত পরিশীলিত এবং শিক্ষিত। ফলে তাদের কাছে গিয়ে অনেক ভালোভালো কথাবার্তা বলে তাদের বিশ্বাস অর্জন করিয়ে নিতে সময় নিলে না সে একেবারেই। শেষ পর্যন্ত তাদের সেবাযত্ন করবার একটা চাকরী বাগিয়ে নিল। সেই শাস্ত্রে বলে না?

অসতী ভবতি সলজ্জা ক্ষারং নীরং চ শীতলং ভবতি।
দম্ভী ভবতি বিবেকী প্রিযবক্তা ভবতি ধূর্তজনঃ।। (ঐ, ৪৫১)


অর্থাৎকুলটা স্ত্রী অধিকাংশ সময়ে খুব লাজুক ভাবে নিজেকে সকলের সামনে প্রকাশ করে, ক্ষার জল খুব শীতল হয় কিন্তু তা পানযোগ্য হয় না; দম্ভী লোক সুযোগ পেলেই জ্ঞান প্রদান করেন। তেমনই ধূর্তলোকেরা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যে তারা খুব ভালো কথা বলতে পারেন। তাদের কথায় মানুষ ভুলে যায়। সেই চৌরব্রাহ্মণের সুন্দর মনোহর কথাতেও সেই বণিক ব্রাহ্মণের ভুলে গেল। সেই চৌর ধীরে ধীরে সেই বণিকদের একজন অত্যন্ত বিশ্বস্ত পাত্র হয়ে উঠল।—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content