শনিবার ৯ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: লেখক।

বাইশে জুলাই জাতীয় ম্যাঙ্গো দিবস আর আর ২৯ জুলাই আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবস। আমে-বাঘে কিংবা আমে-রামে মিশলে কী হয়? আদৌ মেশে কি? হাওড়ার পুলে কী গড়ের মাঠে সকলেই আম, কিন্তু সেখান থেকে যে যার কোজি কর্ণারে পৌঁছলেই বাঘ! যাকে আম ভাবছেন, সে-ই টেবিলের ওপারে বাঘ। এই যে “খাস” হয়ে ওঠা, বেশ মজাদার, আর সাপ-লুডো খেলার মতো। কে কখন আম, কে কখন বাঘ বুঝে ওঠার আগেই আপেক্ষিকতার বলে গেছোদাদার সূত্রে বদলে যাবে।
ধরা যাক, শ্যামবাবু শ্যামবাজার থেকে বাসে উঠলেন। বাসে বেজায় ভিড়। খানিক পরে একটা সিট ফাঁকা হল, আমের ভিড়ে বাঘের মতো শ্যামবাবু সিটে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলেন, তার আগেই সেটা দখল হয়ে গেল। শ্যামবাবু আবার আমে মিশে গেলেন। তারপর, পরের স্টপ আসতেই খুব হল্লা হল, পকেটমার ধরা পড়েছে, শ্যামবাবু একবার পকেট চেপে ধরে উড়ে যেতে বসা প্রাণপাখিটা শূন্য থেকে নামিয়ে উঠলেন। তখন বাস থামিয়ে রাস্তায় নেমে আর পাঁচজন হাতের সুখ করছেন। শ্যামবাবু সিটটা হারিয়ে একটু বেজার ছিলেন। যে উড়ে এসে সিটে জুড়ে বসেছিল, নয় নয় করে পাঁচ বছরের ছোট হবে।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪৫: ইমোজির সাত-সতেরো

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭২: বনবাসজীবনে প্রকৃতির প্রভাব কি রামের দুঃখকে মুছে দিয়েছিল?

সিনিয়রদের এখন মান্যি করে না কেউ! সেই অজীর্ণের অম্বলটা এ বার ঢেকুর হয়ে উঠে এল। হাতের ছাতাটা শক্ত করে ধরে জোরসে একটা বাড়ি লাগলেন লোকটার পিঠে, তখন চারপাশ থেকে আরও কয়েকটা পাইকারি রেটেই পড়ল, “হতভাগা! পুজো যতো এগিয়ে আসে ততো তোদের জন্য রাস্তায় পা রাখা যায় না”, আরেক ঘা কষিয়ে শ্যামবাবুর শান্তি হল। নিজেকে বাংলার বাঘ মনে হচ্ছিল। এ বার ছাতার দিকে তাকিয়ে মুখ শুকিয়ে গেল শ্যামবাবুর। সেটা বেঁকে জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো হয়ে যেন হাসছে। আবারও আমে ফিরে এলেন শ্যামবাজারের শ্যামবাবু। একটু হেঁটেই ছাতা সারাইয়ের দোকান, বর্ষাকাল, না সারালেই নয়। বাঘ হতে গিয়ে সকাল সকাল গচ্চা!
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৬: নান্দনিক শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন শ্রীমা

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫০: পুত্রস্নেহে অন্ধ হলে পিতাকেও ধৃতরাষ্ট্রের মতো দুর্দশা ভোগ করতে হয়

ছাতার খোল নলচে বদলাতে হবে, এস্টিমেট শুনে শ্যামবাবু আকাশ থেকে পড়লেন, “এতো? এই দামে তো নতুন ছাতা… না, না দশটাকা কম দিতে টিতে নয়, ওটা পুরোপুরি করো, তাহলে ভাবা যেতে পারে, আমার থেকে এত দাম নেবে সাহস তো বড় কম নয়” আবার বাঘ হলেন তিনি। আপনি কে হে বাপু, না পোষালে আসুন গিয়ে জাতীয় কিছু শুনে শ্যামবাবু আবার আমে ফিরে এলেন। এরপর আপিসে গিয়ে হাফবেলার সি এল, দেরি হয়েছে, বড়সাহেব বাঘের মতো হম্বিতম্বি করেন। কাউকেই রেয়াত করেন না। সেই যে কখন শ্যামবাবু আমে নেমেছেন, সেই সেখানেই বসে আছেন। বিকেলবেলা হলে ভাঙা ছাতাটা হাতেই বাড়িমুখো হলেন।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৩: কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৩: টলস্টয় ও সোফিয়া—সে কি কেবলই যাতনাময়…/৩

রাস্তার মোড়ে যেখানে বড় টিভির দোকান, তার পাশেই আমের দোকান। পাশে নানা সাইজের টিভির স্ক্রিনে অ্যানিমাল চ্যানেলে বাঘ ছুটছে, অনেক, যতো স্ক্রিন ততো বাঘ দৌড়চ্ছে। আমের দামটা এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে ক’দিন। মিষ্টি হবে? চিনির মতো? ঠিক আছে দাও তাহলে, দশটাকা কম নেবে কেজিতে। না না, দশটাকাই কমাতে হবে। এককেজি দাও। বারোশো হয়ে গেল? তাই দাও। পাল্লা ঠিক আছে তোমার? খুব বুদ্ধি, কমালে না, বারোশো দিয়ে দিলে, ওজনে মারো যদি পরদিন এখানে আর বসো ক্যামন করে দেখবো। সবকটা টিভির স্ক্রিনে বাঘের মুখ। শ্যামবাবু বাঘ হয়ে উঠতে চাইছেন, পারছেন কই? সেই জোরটাই কোথায় যেন…. হাতে আম ঝুলিয়ে বাস, বাস থেকে নেমে পাড়ার গলি পার হয়ে দরজা।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— বাবুর ও বন জুঁই

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

“এই যে জ্যেঠু, দেখা হয়ে গেল”… পাশের বাড়ির গোপাল দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছে। “বলছিলাম, এবারের চাঁদার বিলটা রাখুন, পরশু এসে নিয়ে যাবো।”
“এত্তো চাঁদা, ইয়ার্কি, এটা কি আমার জন্য স্পেশাল নাকি”
“আলবাত্, আপনার তবুও কম ধরেছি, ঐ গলির প্রত্যেকটা বাড়ি…”
“দেখো ভাই, আমি সাধারণ মানুষ, এতো চাঁদা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই, আমি যেটা দেবো তুমি বরং সেটা নাও, আমি দুটো বিজ্ঞাপন জোগাড় করে দেব নাহয় দেখি।”
“ওসব হবে টবে না, নান্টুদা বলে দিয়েছে এক পয়সাও কম হবে না, আর আপনার কথা ইস্পেশালি বলে দিয়েছে, আপনি সিনিয়র লোক, ষষ্ঠীর দিন আপনি বেলতলার দ্বারোদ্ঘাটন করবেন। প্যাণ্ডেল তার আগেই খুলে যাবে, এবার স্টুডিওপাড়া থেকে ক্যাপ্টেন আসবে, ঐ যে
“খোকা যাবে শ্বশুরবাড়ি” সিরিয়ালে হিরোর ন’কাকার পার্ট করে, বজবজ যাওয়ার পথে পটল তুলেছিল, তারপর যে গাড়ির সঙ্গে অ্যাক্সিডেন্ট, সেখান থেকে ছোটবেলার প্রেমিকা নেমে এল, তার ডাকেই তো উঠে বসল, সামনের সপ্তার ফার্স্ট স্লটেই বিয়ে তো, হেব্বি জমে গেছে মাইরি, দেখেন তো থ্যাটারটা? যাইহোক, দেখুন আমাদের দুদিন দুজন উদ্বোধক, যার একজন হলেন আপনি, আমরা সিনিয়রদের সম্মান দিতে জানি কাকা, ক’দিন বাদেই হোর্ডিং পড়বে, বেলতলার উদ্বোধনে শ্রী শ্যামলাল কর! কী জ্যেঠু! এবার বিলটা…”

“দাও দাও” বাঘের গলায় বলেন শ্যামবাবু, হাতে আমের প্যাকেটটা সামলে, বিলটা নেন, বলেন “পরশু এসে নিয়ে যেও মনে করে কিন্তু….”

বৃষ্টি আসবে মনে হয়। একঝলক ঠান্ডা হাওয়া ভেসে আসে। দরজায় বেল দেন। বেশ লাগছে, কাল আপিসে গিয়ে বলার মতো একটা খবর বটে। আর চারমাস বাদেই রিটায়ারমেণ্ট। সকাল হলেই আমের ভিড়ে মিশে যাওয়া। সামনের শীতে সোঁদরবনের তিন দিন দুইরাতের ট্রিপটা করে নিলেই হয়।
* হুঁকোমুখোর চিত্রকলা : লেখক: ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

Skip to content