ছবি: সংগৃহীত।
‘হিংলা কুনুর জুড়ল এসে, করল তারে ভারি
কলকলিয়ে বইছে নদ, তরতরিয়ে তরী’—প্রমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
বর্ধমান জেলার অজয়ের অন্যতম প্রধান উপনদী কুনুর নদী উৎপন্ন হয়েছে পশ্চিম বর্ধমানের উখড়ার ঝানজিরা গ্রাম (সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা প্রায় ১০০ মিটার) থেকে। রেনলের মানচিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অতীতে কুনুর নদী, অজয় নদ থেকেই উৎপন্ন হয়ে এই নদেই মিশেছিল। অনেকটা ফিনিক্স পাখির মতোই। তবে অতীতে উৎপত্তিস্থলের নিকট বাঁধ নির্মাণের ফলে ওই খাতের প্রাথমিক কিছু অংশ শুষ্ক হয়ে গিয়েছে। জামুরিয়া থানার ডাহুক অঞ্চল থেকে পূর্বমুখে প্রসারিত একটি ধারা, তুমনি নাম নিয়ে মহেশপুর, গোগলা এবং কালিনগরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কাঁকসা থানার রাউতডিহির কাছে অজয় নদে মিলিত হয়েছে। রেনলের মানচিত্রে বর্ণিত এই খালগুলির মধ্যে অতীতে হয়তো যোগাযোগ ছিল। বর্তমানে বিভিন্ন স্থান বিচ্ছিন্ন হয়ে, এগুলি পৃথক পৃথক খালে পরিণত হয়েছে।
কলকলিয়ে বইছে নদ, তরতরিয়ে তরী’—প্রমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
বর্ধমান জেলার অজয়ের অন্যতম প্রধান উপনদী কুনুর নদী উৎপন্ন হয়েছে পশ্চিম বর্ধমানের উখড়ার ঝানজিরা গ্রাম (সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা প্রায় ১০০ মিটার) থেকে। রেনলের মানচিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অতীতে কুনুর নদী, অজয় নদ থেকেই উৎপন্ন হয়ে এই নদেই মিশেছিল। অনেকটা ফিনিক্স পাখির মতোই। তবে অতীতে উৎপত্তিস্থলের নিকট বাঁধ নির্মাণের ফলে ওই খাতের প্রাথমিক কিছু অংশ শুষ্ক হয়ে গিয়েছে। জামুরিয়া থানার ডাহুক অঞ্চল থেকে পূর্বমুখে প্রসারিত একটি ধারা, তুমনি নাম নিয়ে মহেশপুর, গোগলা এবং কালিনগরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কাঁকসা থানার রাউতডিহির কাছে অজয় নদে মিলিত হয়েছে। রেনলের মানচিত্রে বর্ণিত এই খালগুলির মধ্যে অতীতে হয়তো যোগাযোগ ছিল। বর্তমানে বিভিন্ন স্থান বিচ্ছিন্ন হয়ে, এগুলি পৃথক পৃথক খালে পরিণত হয়েছে।
উৎসস্থল থেকে ভূ-প্রাকৃতিক ঢাল অনুসারে পূর্বমুখে প্রবাহিত এই কুনুর প্রথমার্ধে কর্কশ লাল ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে নরম পলিমাটির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নতুনহাটের পশ্চিমাংশে কোগ্রামে (২৩°৩২`N, ৮৭°৫৪`E) অজয় নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ছোট কুনুর তার ১১২ কিলোমিটার গতিপথে অন্ডাল, রানিগঞ্জ, জামুরিয়া, গুসকরা, আউসগ্রাম, মঙ্গলকোট ও নতুনহাট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটির প্রবাহপথ হল-২৩°২৫`N থেকে ২৩°৪০`N ও ৮৭°১৫`E থেকে ৮৭°৫৪`। এটি তার গতিপথে প্রায় ২৭৭টি গ্রাম ও ৩টি শহরাঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি অজয়ের ডানদিকের উপনদী। উভয় নদীর মিলিত ধারা শেষ পর্যন্ত ভাগীরথীতে এসে পড়েছে।
আরও পড়ুন:
স্বামী বিবেকানন্দ জীবন বদলে দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী বন্ধু চুনিলাল বসু-র
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা
কুনুর নদী অববাহিকাটির ক্ষেত্রফল হল ৮২৬.৫০ বর্গকিমি এবং এর পরিসীমা হল ১৭৪ কিমি। নদী অববাহিকাটি প্রায় বৃক্ষরূপী, উপর থেকে দেখলে বহু শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট মনে হয় এবং এটি সমুদ্রতল থেকে ৪৩ মিটার থেকে ১০০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট। এই নদীর গতিপথ এবং তার অববাহিকাটি ভূপ্রাকৃতিকগত, ভূতত্ত্বগত ও মৃত্তিকাগত ভাবে বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এই অববাহিকাতে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়। এই বৃষ্টিপাতের প্রায় ৯০ শতাংশই হয়ে থাকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর দ্বারা এবং ১০ শতাংশ বৃষ্টিপাত হয় উত্তর-পশ্চিম বায়ুর প্রভাবে। এই নদী অববাহিকায় সারা বছরে, পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে প্রায় ১২৭৫ মিমি এবং মধ্যভাগে ১২২৫ মিমি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এই বৃষ্টিপাতের প্রায় ৮০ শতাংশ হয়ে থাকে জুন-অক্টোবর মাসে। নদীর চর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অতি উর্বর চাষযোগ্য জমি দেখা যায়। বৃষ্টির জলে পুষ্ট এই নদীটির গভীরতা খুব একটা বেশি না থাকার জন্য অল্প বৃষ্টিতেই নদীর দুকুল প্লাবিত হয়। এছাড়াও, অজয় নদের জলের উচ্চতা, বর্ষায় কুনুরের জলের উচ্চতা থেকেও বেশি হওয়ার জন্য, প্রায় প্রতি বর্ষায় এই নদীতে বন্যা দেখা যায়। নদীর বুক থেকে ব্যাপকহারে বালি তোলার ফলে কুনুর নদী আজ ধুঁকছে। পুরসভার নিয়মকে থোড়াই কেয়ার করে, নদীর পাড়ে যত্রতত্র বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭০: পাভেল কোথায়?
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা
সরকারি নিয়ম আছে, নদী থেকে অন্তঃত পক্ষে একটা কিলোমিটার পর্যন্ত কোন বাড়ি তৈরি করা উচিত নয়। ফলে, সর্বতোভাবে নদীর চর এবং তার আশেপাশের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নদীর পাড় বরাবর ব্যা পকহারে বনভূমি ধ্বংস এবং বৃক্ষছেদন করা হচ্ছে, ফলে নদীর পাড় ক্ষয়ে যাচ্ছে। ফলে নদীর গভীরতা হ্রাসের সাথে সাথে নদী তার নাব্যতা হারাচ্ছে ও শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে। এই নদীর তীরে পশ্চিম বর্ধমান জেলায়, প্রচুর শালবাগান ছিল। কিন্তু চোরাচালানকারীদের প্রতিনিয়ত অত্যাচারের ফলে সেই শালবাগানও আজ ধ্বংসের মুখে।
ছোট্ট এই নদী তীরে মলনদিঘি, বননবগ্রাম, নাচন, গুসকরা, মঙ্গলকোটের মতো বেশ কিছু ঐতিহাসিকস্থান ও গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নকীর্ত রয়ে গিয়েছে। সাম্প্রতিককালে খননকার্যের ফলে কুনুর নদীর চরে মসৃণ পাথরের কুঠার আবিষ্কৃত হয়েছে, যা থেকে মনে হয় নব্য প্রস্তর যুগের বন্য মানুষ সেখানে বাস করত। এই নদীর পাড়ে কাঁকসা বনভূমির নিকট স্থানগুলিতে পান্ডুরাজার ঢিবি, সাতকাহানিয়া, শিলীভূত গাছের অংশ নির্মিত আয়ূধ (মাইক্রোলিথ) আবিষ্কৃত হয়েছে।
ছোট্ট এই নদী তীরে মলনদিঘি, বননবগ্রাম, নাচন, গুসকরা, মঙ্গলকোটের মতো বেশ কিছু ঐতিহাসিকস্থান ও গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নকীর্ত রয়ে গিয়েছে। সাম্প্রতিককালে খননকার্যের ফলে কুনুর নদীর চরে মসৃণ পাথরের কুঠার আবিষ্কৃত হয়েছে, যা থেকে মনে হয় নব্য প্রস্তর যুগের বন্য মানুষ সেখানে বাস করত। এই নদীর পাড়ে কাঁকসা বনভূমির নিকট স্থানগুলিতে পান্ডুরাজার ঢিবি, সাতকাহানিয়া, শিলীভূত গাছের অংশ নির্মিত আয়ূধ (মাইক্রোলিথ) আবিষ্কৃত হয়েছে।
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৪: পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
অজয় নদীর তীরে বনকাটিতেও অনুরূপ আয়ূধ পাওয়া গেছে। তবে এগুলোর উপর, গভীরভাবে বৈজ্ঞানিক গবেষণা এখনো ঠিকঠাক হয় নাই। বিভিন্ন গবেষকদের মতে বর্ধমান জেলার কুনুর এবং অজয় নদের অববাহিকা বরাবর প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের বিচরণ ক্ষেত্র ছিল। আউসগ্রাম থানার পান্ডুক গ্রামে পান্ডুদাস বা পান্ডু বলে কোনও এক রাজার রাজধানী ছিল। তাঁরই নির্মিত সৌধ আজ ইতিহাস প্রসিদ্ধ পান্ডু রাজার ঢিবি নামে পরিচিত। অজয় নদের সঙ্গে কুনুর নদীর মিলনস্থলে অসংখ্য প্রত্নতত্ত্বের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিজ্ঞানীগণ। এই মিলনস্থলে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত খননকার্য চালানো হয় এবং এটির নেতৃত্ব দিয়েছিল ওই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এই খনন কাজের ফলে, সেখানে তাম্র এবং প্রস্তরযুগীয় বিভিন্ন নিদর্শন পাওয়া যায়। সেখানে লাল পোড়ামাটির বিভিন্ন টুকরো ও কৃষ্ণবর্ণের মসৃণ বা অমসৃণ মাটির বিভিন্ন পাত্র ও টুকরো পাওয়া যায়। এই পাত্রগুলির উপর নানান চিত্র অংঙ্কিত আছে। সেখানে বসবাসকারী আদিম মানুষেরা হাড়ের তৈরি হাতিয়ার ব্যবহার করত।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯২: মহর্ষিদেব নাতজামাইকে দিয়েছিলেন সোনার কলম
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৭: পাঞ্চালদেশে যাত্রাপথে পাণ্ডবদের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় কিসের ইঙ্গিত?
তবে সর্বাপেক্ষা চমকপ্রদ ব্যাপার যেটি তা হল, একেবারে মাটির নিম্নস্তর থেকে লোহার তৈরি নানান জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। এ থেকে জানা যায়, এই মানুষটা লোহার ব্যবহার জানতো। এছাড়াও পোড়ামাটির মূর্তি ও সিলমোহর পাওয়া যায়। এইসব প্রাপ্ত মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রীকে বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন এখানেই মৌর্য আমল থেকে শুরু করে পরবর্তী সময় পর্যন্ত, একটি পরিপূর্ণ নগরকেন্দ্র বিকশিত হয়েছিল। অজয় এবং কুনুরের মিলনস্থলে অবস্থিত উজানী ও ভ্রমরাদহের নাম মঙ্গলকাব্যে আছে। ফলে নদীটির প্রাচীনত্ব আমাদেরকে মুগ্ধ করে।
সকলকে উদ্যোগ নিতে হবে সুন্দরী কুনুর নদীকে বাঁচানোর জন্য। উপযুক্ত মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে, নদীর উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত ড্রেজিং করে, মজে যাওয়া নদীকে ঠিক করার প্রয়োজন। নদী বাঁচলে, বাঁচবে আমাদের এই নদীমাতৃক সভ্যতা, তাকে ঘিরে বিপুল জীব বৈচিত্র এবং সর্বোপরি নদীর ওপর নির্ভরশীল অগণিত মানুষ।
সকলকে উদ্যোগ নিতে হবে সুন্দরী কুনুর নদীকে বাঁচানোর জন্য। উপযুক্ত মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে, নদীর উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত ড্রেজিং করে, মজে যাওয়া নদীকে ঠিক করার প্রয়োজন। নদী বাঁচলে, বাঁচবে আমাদের এই নদীমাতৃক সভ্যতা, তাকে ঘিরে বিপুল জীব বৈচিত্র এবং সর্বোপরি নদীর ওপর নির্ভরশীল অগণিত মানুষ।
তথ্যসূত্র:
ড. উৎপল অধিকারী, আঝাপুর হাই স্কুল, আঝাপুর, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান
ড. সুনাম চট্টোপাধ্যায়, সাঁচড়া হাই স্কুল, সাঁচড়া, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান
ড. সুনাম চট্টোপাধ্যায়, সাঁচড়া হাই স্কুল, সাঁচড়া, জামালপুর, পূর্ব বর্ধমান